করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে ‘কফি হাউসের সেই আড্ডা’ আপাতত বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কর্তৃপক্ষ। মারণ এই ভাইরাস আতঙ্কে গত কয়েকদিন ধরেই কলকাতার কলেজ স্ট্রিটের কফি হাউসে আসা মানুষের সংখ্যা কমে গিয়েছিল।
এমন পরিস্থিতিতে শুক্রবার বৈঠকে বসে ইন্ডিয়ান কফি হাউস ওয়ার্কার্স কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড কর্তৃপক্ষ। সেই বৈঠকেই সর্বসম্মত ভাবে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে করোনা সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসাবে এই মুহুর্তে কফি হাউস বন্ধ রাখা জরুরি। তাছাড়া এই পরিস্থিতিতে খোলা থাকলে কফি হাউসের কর্মীরাও সংক্রমিত হতে পারেন।
সেই আশঙ্কা থেকেই নির্দেশিকা জারি করে জানিয়ে দেওয়া হয় আজ শনিবার থেকে আগামী ৩১ মার্চ পর্যন্ত বন্ধ থাকবে এই কফি হাউজ। ৩১ তারিখ ফের কফি হাউসের কর্মী ও অন্য কর্মকর্তাদের সাথে নিয়ে একটি বৈঠক করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। যদিও সরকারের তরফে এই কফি হাউস বন্ধ রাখা নিয়ে এখনও কোন নির্দেশিকা আসেনি।
কলকাতার যাদবপুরে অবস্থিত ইন্ডিয়ান কফি হাউসের আরেকটি শাখাও বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
১৯৪২ সালে খোলা হয় কলেজ স্ট্রিটের কফি হাউস টি। পূর্বের অ্যালবার্ট হল নামে পরিচিত এই জায়গায় কফি পানের একটা জায়গা তৈরি করে কফি বোর্ড। বহু বিশিষ্ট ব্যক্তিরা ওই সেখানে কফি খেতে আসতেন। ১৯৪৭ সালে কেন্দ্রীয় সরকার ওই স্থানটির নামকরণ করে দেয় ‘কফি হাউস’ নামে। দেখতে দেখতে এটি শহরের ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতির সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। কবি, শিল্পী, সাহিত্য এবং বিশ্বের নানা প্রান্তের শিল্প ও সংস্কৃতি মনস্ক মানুষের এক মিলন স্থান হয়ে ওঠে। পরিচালক সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন, অপর্না সেন, নোবেল জয়ী অমর্ত্য সেন, নাট্যব্যক্তিত্ব রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্তের মতো ব্যক্তিরাও কোন না কোন সময়ে এই কফি হাউসে আড্ডা দিতেন। কফি হাউসকে নিয়েই মান্না দে’র কণ্ঠে সেই বিখ্যাত গান ‘কফি হাউসের আড্ডাটা আজ আর নেই’ আজও অত্যন্ত জনপ্রিয়।
জানা গেছে সকাল ৯টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত দৈনিক গড়ে ১৫০০ মানুষ আসেন কলেজ স্ট্রীটের এই কফি হাউসে। কিন্তু গত সোমবার থেকে তা নেমে ৩০০ থেকে ৫০০ হয়েছে। সোসাইটির সেক্রেটারি তপন পাহাড়ি জানান, ছুটির দিন বাদে সপ্তাহের অন্য দিনগুলোতে এই মুহূর্তে মাত্র ৫০ জন করে খদ্দের আসছেন, যা কোনদিনই কল্পনা করতে পারিনি। খদ্দেরের সংখ্যা কম থাকায় এখানকার কর্মচারীরাও আমাকে বলছিলেন রাত ৯ টার বদলে হাউস আগে বন্ধ করে দেওয়া যায় কি না।
কলেজ স্ট্রিট ও যাদবপুর-এই দুইটি শাখা মিলিয়ে মোট ৬৫ জন কর্মী কাজ করেন। এর মধ্যে বেশিরভাগই পূর্ব মেদিনীপুর, উড়িষ্যা এবং বিহারের বাসিন্দা। যদিও কফি হাউস বন্ধ থাকায় কর্মচারীদের বেতন কাটা হবে না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে কর্তৃপক্ষ।
স্বাভাবিকভাবে স্মৃতি বিজড়িত এই কফি হাউজের সাম্প্রতিক ইতিহাসে এই ধরনের ঘটনা নজিরবিহীন বলেই জানিয়েছেন তার সাথে যুক্ত কর্মী ও কর্মকর্তারা।
গত ৪০ বছর ধরে কলেজ স্ট্রীটের কফি হাউসে কর্মরত রাধাকান্ত মিশ্র জানান, এখানে এত মানুষের সমাগম, কোলাহল আমার খুব ভাল লাগে, এবার তা মিস করবো। তবে আপাতত এই পরিস্থিতে আমাদেরকে দূরে সরিয়ে রাখাটা আমাদের পক্ষে ভালই হবে।
কফি হাউসে নিয়মিত আসা ফটোগ্রাফার নভনীল বসু জানান, কফি হাউস হল আমাদের পুরনো বন্ধুদের সাথে দেখা করার একটা আদর্শ জায়গা। তাই যদি এটা বন্ধ থাকে তবে সত্যিই নিজেকে গৃহবন্দী বলেই মনে হবে। যদিও এই মুহূর্তে এছাড়া আর কোন উপায়ও নেই।
এর আগে ১৯৫৮ সালে নকশাল আন্দোলনের সময়ে কর্তৃপক্ষ একবার এই কফি হাউজ বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু সেবছর তৎকালীন প্রেসিডেন্সি কলেজ এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকরা মিলিতভাবে ওই ঐতিহ্যবাহী স্থানটি বাঁচাতে সরকারের কাছে বিশেষ অনুরোধ জানানোর পরই পুনরায় খোলা হয়।
উল্লেখ্য, পশ্চিমবঙ্গে এই ভাইরাসে আক্রান্তের বেড়ে হয়েছে ৩। তিন জনকেই রাখা হয়েছে বেলেঘাটা আইডি হাসপাতালের আইসোলেশন ওয়ার্ডে। আর গোটা ভারতে আক্রান্তের সংখ্যা ২৭০, মৃত্যু হয়েছে ৪ জনের।
বিডি প্রতিদিন/ফারজানা