দেশের পোশাকশিল্পের নিজস্ব ব্র্যান্ড ‘সারা’ লাইফস্টাইল লিমিটেড। এটি রপ্তানিমুখী পোশাকশিল্পের সঙ্গে জড়িত স্নোটেক্স গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান। স্নোটেক্স গ্রুপ তাদের ২০ বছরের অভিজ্ঞতা নিয়ে শুরু করেছে তাদের লাইফস্টাইল ব্র্যান্ড ‘সারা’। মিরপুর, বসুন্ধরা সিটি এবং মোহাম্মদপুরের পর সম্প্রতি রাজধানীর উত্তরাতে ‘সারা’র ৪র্থ আউটলেটের উদ্বোধন হয়েছে।
দেশের বাজারের পর ব্র্যান্ড হিসেবে ‘সারা’ বিশ্ববাজারেও প্রতিষ্ঠিত হতে চায়। সেই উদ্দেশেই এগিয়ে চলছে দেশের পোশাকশিল্পের নিজস্ব ব্র্যান্ড ‘সারা’ লাইফস্টাইল লিমিটেড। ‘সারা’ লাইফস্টাইল লিমিটেডের যাত্রা শুরুসহ ব্র্যান্ডটির ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে বাংলাদেশ প্রতিদিনের সঙ্গে কথা বলেছেন প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক শরীফুন নেসা।
খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে সারা সবার মাঝে বেশ ভালো একটি স্থান করে নিয়েছে। এই অবস্থান ধরে রাখার জন্য কিভাবে ভাবছেন?
২০১৮ সালের মে মাস থেকে সারা শুরু করে সারা। মাত্র দেড় বছরের ইতোমধ্যে ৫ টা শো রুম চালু হয়েছে সারা'র। ৪ টা শো-রুম ওপেন হয়ে গেছে। আর অপরটি বারিধারার জে ব্লকে এক মাসের মধ্যে চালু হয়ে যাবে। ইচ্ছা আছে ২০২০ সালের মধ্যে রাজধানী ঢাকায় আরও ৫ টি শো-রুম ওপেন করার। এরপর ঢাকার বাইরে বিভাগীয় শহরে শো-রুম ওপেন করার ইচ্ছা আছে। দেশের মধ্যে শীর্ষে পৌঁছানোর পর সারাকে ইন্টারন্যাশনাল ব্র্যান্ড হিসেবে পরিচিত করতে চাই।
সারা'কে ইন্টারন্যাশনাল ব্র্যান্ড হিসেবে দেশের বাইরে কতদিনের মধ্যে পরিচিত করতে পারবেন বলে মনে করছেন?
আমার আসল উদ্দেশ্য সারাকে ইন্টারন্যাশনাল ব্র্যান্ড হিসেবে দেশের বাইরে পরিচিত করা। এর জন্য আমি সময় নিতে চাই। সময় নিয়ে ধীরে ধীরে এগোতে চাই। রাজধানী ঢাকা ও বিভাগীয় শহরে শো-রুম চালু হলে এখান থেকে অনেক কিছু শেখার আছে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যেতে হলে দেশের মার্কেটে আগে নিজেদের অবস্থান শক্ত করতে হবে। দেশে অবস্থান মজবুত হলে সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে দেশের বাইরে নিজেদের আত্মপ্রকাশ করবে সারা। তার জন্য আমাদের ২ বছর সময় লাগতে পারে, আবার ৫ বছরও লাগতে পারে। তবে সময় নিয়ে এগোতে চায় সারা।
'সারা' মানেই সুলভ মূল্যে ভালো পোশাক। এই যে দারুণ এক সংযোগ...এটা কিভাবে সম্ভব হলো??
সারা'র প্রোডাক্টের মূল্য কম আর গুনগত মান ভালো- এই দারুন কম্বিনেশনের আইডিয়া এসেছে স্নোটেক্স থেকে। মূলত এটা আমার হাজবেন্ড (এস এম খালেদ, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, স্নোটেক্স)-এর আইডিয়া। কম দামে কোয়ালিটি ভালো হওয়ায় সারা'র সব ধরণের পোশাক গ্রাহকদের কাছে প্রাধান্য পাচ্ছে। ঠিক একই কারণে সব ধরণের গ্রাহকের কাছে পৌঁছাতে পেরেছে সারা। যে কারণে সারা'র প্রতিটি শো-রুমে বিক্রি বেশি হচ্ছে। গ্রাহক বেশি আসায়, বিক্রি বেশি হওয়ায় লাভবান হচ্ছে সারা। শীত না আসতেই চলতি বছর সারা তাদের শীতের পোশাক বিক্রি করতে শুরু করেছে অনেক বেশি।
সুলভ মূল্যে ভালো পোশাক বিক্রি করার এই ধারা কী অব্যাহত থাকবে ভবিষ্যতেও ?
অন্য ব্র্যান্ড নিজেদের প্রোডাক্টের দাম বাড়ালেও সারা পরবর্তী ২০ বছরেও তাদের এই নীতিতে পরিবর্তন আনবে না। কারণ 'সারা' চায় কম দামে ভালো প্রোডাক্ট দিতে। অনেক বেশি গ্রাহক রাখাই সারা'র লক্ষ্য।
দেশের বাজারে ২০১৮ সালে সারা লাইফস্টাইল লি. এর যাত্রা শুরু হয়। কিন্তু তার আরও অনেক আগে থেকে স্নোটেক্সের যাত্রা শুরু। স্নোটেক্সের পথচলা শুরুর ঘটনাটা যদি শেয়ার করতেন-
২০০১ সালে আমার বিয়ে হয়। প্রথমে একটি বায়িং হাউজ ছিল। এরপর ২০০৪ সালে স্নোটেক্সের শুরু। ২০০৫ সালে স্নোটেক্স এপারেল নামে ফ্যাক্টরি শুরু। তখন লোকবল ছিল ৮০০। ২০১১ সালে মালিবাগে কাট এন্ড সিউ নামে আরেকটা ফ্যাক্টরি চালু হয়। এরপর আরও বড় পরিসরে কিছু করার পরিকল্পনা করে স্নোটেক্স। ধামরাইতে নিজস্ব জমিতে গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি দেয় 'স্নোটেক্স আউটারওয়্যার লিমিটেড' নামে। ২০১৯ সালে স্নোটেক্স 'স্পোর্টস ওয়ার' চালু করে। ৯০০০ স্টাফকে স্নোটেক্স ফ্রি লাঞ্চ করায় স্নোটেক্স তার এই ফ্যাক্টরিতে। আমার হাজবেন্ড (এস এম খালেদ) প্লান করে, স্টাডি করে স্নোটেক্সের ডেভেলপমেন্টের কাজ করে। কম দামে প্রোডাক্ট কোয়ালিটি ভালো হওয়ায় বায়ারদের কাছে প্রাধান্য পায় স্নোটেক্স। যেখানে অন্য ফ্যাক্টরি বায়ারদের পেছনে ঘুরছে প্রোডাক্ট বিক্রি করার জন্য, সেখানে স্নোটেক্স অর্ডার নিয়ে শেষ করতে পারে না। শুধুমাত্র এমন আইডোলজির জন্য। শুরু থেকেই এই আইডোলজি ফলো করায় 'সারা' লাভবান হচ্ছে। 'স্নোটেক্স' আর 'সারা'-এর সেট আপ আলাদা। তবে স্নোটেক্স'র কিছু অভিজ্ঞ লোক আছে। যাদের অভিজ্ঞতা সারা কাজে লাগাতে পারছে। স্নোটেক্স থেকে সারা এই সুবিধা নিচ্ছে।
সারা'র প্রথম টিভিসি দেশে হলেও দ্বিতীয় টিভিসি দেশের বাইরে। ব্র্যান্ডিংয়ের ক্ষেত্রে এটি একটি সাহসী পদক্ষেপ। এর পেছনের উদ্দেশ্য আর পরিকল্পনা নিয়ে জানতে চাই-
সারা'র প্রথম টিভিসি দেশে হলেও দ্বিতীয় টিভিসি দেশের বাইরে হবার কারণ ভিন্ন কিছু করা। মূলত ব্র্যান্ডিনের জন্যই সারা দেশের বাইরে টিভিসি করেছে। এবারের টিভিসিতে শীতকালীন পোশাককে হাইলাইটস করা হয়েছে। সারা'র প্রতিটা সেক্টরে আলাদা টিম রয়েছে। তারা মিলে সব পরিকল্পনা করেছে আর সে অনুযায়ী কাজ করছে। দেড় বছরের মাথায় দেশের বাইরে টিভিসির প্লান সারা'র সকল গ্রুপ মিলেই করেছিল। আর সকলের সম্মিলিত চেষ্টায় এটা সফল হয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছেন । সেখান থেকে এখন একজন সফল ব্যবসায়ী। সম্পূর্ণ ভিন্ন পথ। শুরুটা যদি বলতেন?
ঢাকা ইউনিভার্সিটি থেকে গগণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করার পর প্রায় ৫ বছর সাংবাদিকতা করেছি। যদিও দ্বিতীয় বর্ষ থেকেই বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি শুরু করি। তারপর ২০০১ সালে বিয়ে হয়। বিয়ের পর দুই বছর সাংবাদিকতায় ছিলাম। এরপর পুরাপরি সংসার আর প্রথম সন্তান (সারাফ)-এর জন্ম হয়। সারাফকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। এরপর আমার দ্বিতীয় সন্তান (রাফান)-এর জন্ম। দুই সন্তান আর স্বামী-সংসার নিয়ে আরও ব্যস্ততা বাড়ে। তাই সাংবাদিকতা পেশায় আর ফেরা হয় না। ২০১৫ সাল থেকে 'সারা' লঞ্জ করার পরিকল্পনা শুরু করি। ২০১৮ সালের মে মাসে 'সারা' লঞ্জ হয়।
প্রায় ৭ বছর সাংবাদিকতা করেছেন। এখন পুরোদস্তুর ব্যবসায়ী। পরবর্তীতে কী আপনাকে সাংবাদিকতায় বা কলামিস্ট হিসেবে দেখা যেতে পারে?
এখন পরিবার আর সারা'কে নিয়ে থাকতে চাই। সাংবাদিকতায় আর ফেরা হবে না। অনেকদিনের গ্যাপ হয়ে গেছে। তবে ভালো প্রস্তাব পেলে কলামিস্ট হিসেবে দেখা যেতে পারে। পরিবেশ সময় আর সুযোগ হলে অবশ্যই কলাম লিখব।
২০১৫-১৮, সারা'কে লঞ্জ করার মধ্যকার এই সময়ে কী কী প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হয়েছেন?
***সারা'কে মার্কেটে আনার ক্ষেত্রে তেমন কোনও প্রতিবন্ধকতায় পড়তে হয় নাই। এর কারন স্নোটেক্স'র অভিজ্ঞ কর্মী আর লোকবল। স্নোটেক্সের সহযোগিতায় সারা সফল। আইডিয়া থেকে শুরু করে লোকবল, সব ধরনের সহযোগিতায় পায় 'সারা' স্নোটেক্স থেকে। স্নোটেক্স থেকে প্রাপ্ত অভিজ্ঞতা, আমার হাজবেন্ড (এস এম খালেদ)-এর আইডোলজি, আর সবার টিম ওয়ার্কের ফলে সারাকে খুব অল্প সময়ে 'সারা'-কে ব্র্যান্ড হিসেবে পরিচিত করতে পেরেছি।
ব্যক্তিগত জীবন কিভাবে সামলাচ্ছেন? স্বামী, ছেলে-মেয়ে, সংসার...
ফ্যামিলি ঠিক রেখেই সারা'কে টাইম দেই। ফ্যামিলি ফাস্ট প্রাইয়োরিটি। আমি একজন গুছানো মানুষ। যার কারণে সবকিছু সুন্দর করে মানিয়ে চলতে পারছি।
আপনাদের ই-কমার্স নিয়ে জানতে চাই...
ই-কমার্স আপডেট করার জন্য আমি নিজেও অনেক সময় দেই। দ্বারাজ, প্রিয়শপ আজকের ডিল'র মতো মার্কেট প্লেসে কাজ করছে 'সারা'। শো-রুম প্রাইজ আর অনলাইনে মার্কেটেও পোশাকের মূল্য একই রাখছে 'সারা'। E-orange এবং Adi-আমাদের সাথে কন্টাক্ট করেছে, তারা দেশের বাইরে আমাদের প্রোডাক্ট সেল করবে। এছাড়া আমাজন-এর সাথেও আমাদের কথা বার্তা চলসে। আমাদের ই-কমার্সের নেক্সট প্লান হলো বিভিন্ন স্কুল কলেজে 'সারা'-এর ক্যাম্পেইন করা। আমাদের ই-কমার্সের ১২-১৩ জন কর্মী নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছে। সোশ্যাল মিডিয়াতে পিক আপডেট আর আপলোডসহ আরও অনেক কাজ করছে। যার ফলে অনলাইনে 'সারা' ভালো রেসপন্স পাচ্ছে। সম্প্রতি খুব ভালো ফ্লোতে চলছে সারা অনলাইন শপ।
বাংলাদেশের মিডিয়াতে বর্তমানে খুবই পরিচিত মুখ সারা। ভবিষ্যতে মিডিয়ার সাথে কাজের ধারা কেমন হতে পারে সারা'র?
মিডিয়াতে সারা খুবই পরিচিত মুখ হয়ে উঠেছে। সারা চায় ছোট-বড় সব রকম মিডিয়ার সাথে কাজ করতে। সারা চেষ্টা করবে এখন যতটুকু মিডিয়া তাদের সাথে আছে ২০২০ সালে আরও মিডিয়া রেসপন্স বাড়াতে। সারা মিডিয়ার মাধ্যমে আরও বেশি করে মানুষের কাছে পৌঁছাতে চায়। কারণ যত ব্র্যান্ডিং বাড়বে তত বিক্রি বাড়বে। ২০২০ সালে মিডিয়া মিডিয়া নিয়ে আরও বড় প্লান আছে সারার আর সেই প্লান অনুযায়ী তারা বাজেট ফিক্স করবে। শুধুমাত্র প্রিন্ট আর অনলাইন মিডিয়া আর ইলেক্ট্রিক মিডিয়া নয়, সারা ধীরে ধীরে ম্যাগাজিনের সাথেও কাজ শুরু করেছে।
আপনি একজন সফল নারী উদ্যোক্তা। কর্মজীবী নারীদের কর্মক্ষেত্রে কেমন পরিবেশ পাওয়া উচিত বলে আপনি মনে করেন ?
কর্মজীবী নারীদের কর্মক্ষেত্রে অবশ্যই সুরক্ষিত হওয়া উচিত। নারীদের পুরুষদের সমান সুযোগ সুবিধা দেওয়া উচিত। 'সারা' তার নারী কর্মীদের এমন সুযোগ সুবিধা দেওয়ার চেষ্টা করে। ১৬ সপ্তাহের জন্য মাতৃকালীন ছুটি দেয়। যেসব নারীরা শারীরিকভাবে অক্ষম তাদের সিটিং'র ব্যবস্থা করে ও একই সঙ্গে ফ্রি লাঞ্চ করায়। 'সারা' নারী পুরুষদের আলাদা ভাবে দেখে না, সবাই সমান।
একজন উদোক্তা হিসেবে অন্যদের উদ্দেশে আপনার পরামর্শ-
নারী উদোক্তা হতে হলে প্রথমেই রাখতে হবে স্বচ্ছতা, ধৈর্য। স্বচ্ছতা থাকতে হবে। অন্যের মতামতকে সম্মান দিতে হবে। পরিকল্পনা করে ধৈর্য ধরে ধীরে ছোট পরিসরে যেতে হয়।
বিডি-প্রতিদিন/ সিফাত আব্দুল্লাহ