২২ মার্চ, ২০১৭। বিদ্যুৎ বিভাগের সচিবের সঙ্গে দায়িত্ব পেয়েছেন ড. আহমদ কায়কাউস। কিছু গুরুত্বপূর্ণ ফাইল দেখে তাঁর চোখ কপালে উঠল। ফলে দ্রুত তিনি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর অ্যাপয়েন্টমেন্ট চাইলেন। অ্যাপয়েন্টমেন্ট পেয়ে গেলেন সেদিনই। রাতেই শেখ হাসিনা তাঁকে গণভবনে ডাকলেন। ফাইল নিয়ে সময়ের আগেই পৌঁছে গেলেন গণভবনে। সব ফাইলেই বিপুর বিপুল পরিমাণ দুর্নীতি, যে দুর্নীতির টাকার অঙ্ক প্রায় ১০ হাজার কোটি। শেখ হাসিনা ফাইলগুলো নিবিড়ভাবে দেখলেন। তারপর বললেন, বিপুকে পদত্যাগ করতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে তিনি ডাকলেন তৎকালীন মন্ত্রিপরিষদ সচিব শফিউল আলমকে। তিনি বললেন, ‘বিপুকে বলো পদত্যাগ করতে, না হলে আমি তাকে সরিয়ে দেব।’ মুহূর্তের মধ্যে সেই কথা বিপুর কানে চলে গেল। তৎকালীন গণভবনের ব্যক্তিগত কর্মচারীরা যারা শেখ হাসিনাকে চা-পানি ইত্যাদি সরবরাহ করতেন, তারা এ তথ্য ফাঁস করে দিলেন বিপুর কাছে। বিপু মুহূর্তে যোগাযোগ করলেন যুক্তরাষ্ট্রে সজীব ওয়াজেদ জয়ের সঙ্গে এবং সেই সময় ব্যাংককে অবস্থান করা রিদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববির সঙ্গে। দুজনকে তিনি জানালেন তাঁর ওপর শেখ হাসিনার ক্ষোভের কথা। কিছুক্ষণের মধ্যেই ফোন এলো শেখ হাসিনার কাছে। প্রথম ফোনটি এলো জয়ের। তিনি বললেন, ‘মা, বিপু মামাকে এখনই সরাইও না।’ কিছুক্ষণ পরই ফোন এলো ববির। এটুকুই শেষ না। শেখ হাসিনাকে ফোন করলেন তাঁর ছোট বোন শেখ রেহানা। তিনজনের প্রবল প্রতিরোধের মুখে শেষ পর্যন্ত বিপুর পদত্যাগের সিদ্ধান্ত স্থগিত করলেন শেখ হাসিনা। দুই দিন পর মন্ত্রিসভার বৈঠকে এ ঘটনা নিজেই বললেন শেখ হাসিনা। বললেন, ‘চুরি ধরলেই জয়, ববি, রেহানার কাছে তদবির করে।’
এটাই ছিল বিপুর খুঁটির জোর। বিপু লাগামহীন দুর্নীতি করবেন, লুটপাট করবেন কিন্তু কেউ তাঁকে কিছু বলতে পারবে না। যখনই তাঁর দুর্নীতি ধরা হবে তখনই হয় জয়, না হলে ববি অথবা শেখ রেহানা তাঁকে উদ্ধারের জন্য এগিয়ে আসতেন। অনুসন্ধানে দেখা যায়, বিপুর মন্ত্রিত্ব রক্ষার জন্য রেহানা, জয়, ববির তদবির ভালোবাসার জন্য ছিল না। বিপুর লুটের টাকার ভাগ পেতেন এঁরা তিনজন। আর বিপুর সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ ছিলেন ববি। ববির গোটা পরিবারই চলত বিদ্যুতের লুটের টাকায়। সর্বশেষ এ পদত্যাগ কাহিনির ঘটনা যদি অনুসন্ধান করা যায়, দেখা যাবে ২০১৭ সালের মার্চের এ ঘটনার তিন দিনের মাথায় রিদওয়ান মুজিব ববি দেশে আসেন। পরদিনই ধানমন্ডিতে সিআরআই অফিসে বৈঠক করেন নসরুল হামিদ বিপুর সঙ্গে। এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে সিদ্ধান্ত হয়, পয়লা বৈশাখে ‘লেটস টক’ নামে একটি অনুষ্ঠান করা হবে, যাতে শেখ হাসিনা কথা বলবেন তরুণসমাজের সঙ্গে। সে অনুযায়ী লেটস টক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এ রকম একটি অনুষ্ঠান করতে খরচ হয় সাকল্যে ১০ থেকে ১২ লাখ টাকা। কিন্তু ১০ কোটি টাকার একটি চেক সিআরআইকে দিলেন নসরুল হামিদ বিপু। প্রিয়প্রাঙ্গণের এ চেক সিআরআইয়ের নামে দেওয়া হয় ৪ এপ্রিল। এ টাকাটি নগদায়ন হয় ৬ এপ্রিল। সেই লেটস টক অনুষ্ঠানের গেটে এবং চারপাশে প্রিয়প্রাঙ্গণের বিভিন্ন প্ল্যাকার্ড ছিল। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ লেটস টক অনুষ্ঠানে যোগ দেন এবং চারপাশে প্রিয়প্রাঙ্গণের বিজ্ঞাপন দেখে তিনি একটুও হতবাক হননি। বরং বিপুর সঙ্গে দুষ্টামিও করেন।
শুধু এখানেই শেষ নয়, এরপর শেখ হাসিনাকে খুশি করার জন্য আর নসরুল হামিদকে রক্ষার জন্য নতুন প্রকল্প হাতে নেন ববি। যোগাযোগ করেন এশিয়াটিকের সঙ্গে। এশিয়াটিকের ইরেশসহ কয়েকজনের সঙ্গে বৈঠক করেন রিদওয়ান মুজিব ববি। এরপর আসাদুজ্জামান নূরের সঙ্গেও তাঁর একটি বৈঠক হয়। এ বৈঠকে তাঁরা সিদ্ধান্ত নেন শেখ হাসিনার জীবনের ওপর একটি প্রামাণ্যচিত্র বানানো যেতে পারে। সবাই পরামর্শ দেন এশিয়াটিকের একান্ত অনুগত নির্মাতা পিপলু খানকে এ পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়ার জন্য। এ রকম একটি প্রামাণ্যচিত্র করতে বড়জোর খরচ হয় ২৫ থেকে ৩০ লাখ টাকা। এ সময় পিপলু খান বাজেট দেন ১ কোটি টাকা। রিদওয়ান মুজিব ববি নসরুল হামিদ বিপুকে জানান যে এ রকম একটি প্রামাণ্যচিত্র করতে খরচ হবে ২০ কোটি টাকার মতো। বিপু তো টাকার খনি। বিপু সঙ্গে সঙ্গে ২০ কোটি টাকা মঞ্জুর করেন। পিপলু খানকে সিআরআইয়ের পক্ষ থেকে তিন কিস্তিতে টাকা দেওয়া হয়। তিন কিস্তিতে ৮৫ লাখ টাকা পান পিপলু খান। ছবি মুক্তির পর ১৫ লাখ টাকা নগদে দেওয়া হয় এবং বিপু নগদে এ টাকা পিপলু খানকে দেন। অথচ এ প্রামাণ্যচিত্রে শেখ হাসিনা আর শেখ রেহানার সাক্ষাৎকার ছাড়া ছিল কিছু স্টক ফুটেজ। এর মাধ্যমে নসরুল হামিদ বিপুর হাজার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি হালাল হয়ে যায়। সবার ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যান তিনি।
নসরুল হামিদ বিপু যখন বিদ্যুৎ খাতে বেপরোয়া হয়ে ওঠেন, তখন ড. আহমদ কায়কাউসেরও দুর্নীতির হাতেখড়ি শুরু হয়। ড. আহমদ কায়কাউস তখন নিজেই বিভিন্ন ফাইলে আপত্তি দেওয়া শুরু করেন, নানা রকম প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে বিপুকে কোণঠাসা করতে শুরু করেন। এ সময় আবার বিপুর সহযোগিতার জন্য হাত বাড়ান জয় এবং ববি। সজীব ওয়াজেদ জয় ড. আহমদ কায়কাউসকে ডেকে নিয়ে যান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। সেখানে উড়ে যান নসরুল হামিদ বিপুও। সে সময় ড. আহমদ কায়কাউসকে ওয়াশিংটনে একটি বিলাসবহুল বাংলো কিনে দেন নসরুল হামিদ বিপু। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানরত আওয়ামী লীগের একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতার মাধ্যমে এ বাড়িটি ড. আহমদ কায়কাউসকে দেওয়া হয়। এরপর অবশ্য আহমদ কায়কাউস বেশিদিন থাকেননি। ২০১৮ সালের নির্বাচনের পরপরই তাঁকে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিবের দায়িত্ব দেওয়া হয়। এরপর কায়কাউস নিজেই হয়ে ওঠেন দুর্নীতির গডফাদার। অনুসন্ধানে দেখা গেছে ববি, জয় কিংবা শেখ রেহানার যখন যা প্রয়োজন হতো সেই ফাইফরমাশ খাটতেন নসরুল হামিদ বিপু। সজীব ওয়াজেদ জয় যখন দেশে আসতেন তখন তাঁর আমোদপ্রমোদের জন্য ব্যবস্থা করতেন বিপু। বিপু তাঁর নিজস্ব খামারবাড়িতে এ ধরনের প্রাইভেট পার্টির আয়োজন করতেন, যেখানে শোবিজের বিভিন্ন তারকার উপস্থিতির সন্ধানও পাওয়া যায়। রিদওয়ান মুজিব ববির ফিনল্যান্ডের বাড়ি, ব্যাংককের বাড়ি নসরুল হামিদ বিপু করে দিয়েছেন। বিপু ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে ব্যাংকক যান। সরকারি পরিপত্রে বলা হয় তাঁর চিকিৎসার জন্য সফর। কিন্তু সেখানে ববির বাড়ি এবং অন্যান্য আর্থিক লেনদেনের কাজ সম্পন্ন করেন। এ কাজ সম্পন্ন করার জন্য তাঁকে সহায়তা করে একটি ঋণখেলাপি ব্যবসায়িক গ্রুপ। যারা দেশের অর্থ পাচার করে থাইল্যান্ডে সম্পদের পাহাড় গড়েছে। এভাবেই ববি এবং জয়কে সন্তুষ্ট করে লাখ কোটি টাকা লুট করেছেন নসরুল হামিদ। লুটের প্রায় পুরো টাকাই পাচার হয়েছে বিদেশে। শেষের দিকে বিপু সব সময় বলতে থাকেন, ‘আমাকে শেখ হাসিনাও সরাতে পারবে না।’ তখন সবাই অবাক হয়ে যেত। কিন্তু পরে দেখা যায় কারণটি খুব স্পষ্ট। ববি আর জয় ছিলেন এতই ক্ষমতাবান যে শেখ হাসিনা তাঁদের কাছে অসহায় হয়ে ছিলেন। আর এজন্যই এ ধরনের সীমাহীন দুর্নীতি নীরবে প্রশ্রয় দিয়েছিলেন শেখ হাসিনা। ২০২৪-এর ডামি নির্বাচনের আগে শেখ হাসিনা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন কোনো অবস্থায়ই বিপুকে তৃতীয় দফায় মন্ত্রী করা যাবে না। কিন্তু এ সিদ্ধান্তে তিনি অটল থাকতে পারেননি। আবার ববি এবং জয় হস্তক্ষেপ করেন। তাঁদের হস্তক্ষেপের কারণে এবার শেখ হাসিনা শুধু বিদ্যুৎ নয়, বিদ্যুৎ এবং জ্বালানি দুটি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দিয়েছিলেন বিপুকে। এ দুষ্টচক্রের কারণে বিদ্যুতের লুটপাট হয়েছে। বিদ্যুৎ ক্ষেত্রে কোনো জবাবদিহি ছিল না। বিপুর স্বেচ্ছাচারিতার কাছে অসহায় হয়ে পড়েছিল পুরো বিদ্যুৎ খাত। সিঙ্গাপুরে জয়ের যে ব্যবসা, তার বিনিয়োগ প্রায় ৫০০ কোটি টাকা বিপুর দেওয়া। বিপুর সিঙ্গাপুরের পাওয়ারকোর কোম্পানির নথি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, সেখান থেকে জয়কে বিভিন্ন মাসে বিপুল অঙ্কের টাকা দেওয়া হয়েছে। এখনো পাওয়ারকোর ব্যাংক গ্যারান্টি দিয়ে জয় সিঙ্গাপুরের একটি ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করেন। এ গডফাদার থাকার কারণেই বিদ্যুৎ খাতে নির্বিচার হরিলুট করেছেন নসরুল হামিদ বিপু।