ইরানের পরমাণু স্থাপনায় মার্কিন বিমান হামলার জেরে বিশ্ব বাণিজ্য বিশেষ করে তেল ও গ্যাস সরবরাহের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ জলপথ হরমুজ প্রণালি নিয়ে শঙ্কা দানা বেঁধেছে। ‘অপারেশন মিডনাইট হ্যামার’ নামে ওই হামলার জেরে পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে এ প্রণালি বন্ধের প্রাথমিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে তেহরান। এ সিদ্ধান্তের পরপরই বিশ্ববাজারে ইতোমধ্যে বেড়েছে জ্বালানি তেলের দাম। বিবিসির প্রতিবেদন বলছে, মার্কিন হামলার পরপরই বৈশ্বিক তেলের বাজারে তাৎক্ষণিক প্রভাব লক্ষ্য করা গেছে। ব্রেন্ট ক্রুড নামে পরিচিত আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের অপরিশোধিত তেলের দাম ৩ শতাংশের বেশি বেড়ে প্রতি ব্যারেল ৭৯ মার্কিন ডলারের ওপরে উঠে গেছে। এদিকে, হরমুজ প্রণালি খোলা রাখতে ইরানের ওপর চাপ দেওয়ার জন্য বেইজিংয়ের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে ওয়াশিংটন। রবিবার সিবিএস নিউজের ‘ফেস দ্য নেশন’কে এক সাক্ষাৎকারে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও বলেছেন, ইরান যদি প্রণালিটি বন্ধ করে তাহলে চীন সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এ ছাড়া অন্যান্য দেশের ওপরও এর প্রভাব পড়বে। রুবিও বলেন, ‘ইরান যদি হরমুজ প্রণালি বন্ধ করে তাহলে সবার আগে চীন সরকারের ক্ষুব্ধ হওয়া উচিত কারণ তাদের অনেক তেল ওই প্রণালি দিয়ে আসে। যদি ইরান হরমুজ প্রণালিতে মাইন স্থাপন করে, তাহলে চীনকে চড়া মূল্য দিতে হবে এবং অন্যান্য দেশকেও মূল্য দিতে হবে। আমাদেরও দিতে হবে। প্রণালি বন্ধ হলে কিছু প্রভাব আমাদের ওপর পড়বে। পুরো বিশ্বের ওপর ব্যাপক প্রভাব পড়বে। ইরান যদি এ কাজ করে তাহলে এটি তাদের জন্য বাণিজ্যিক আত্মহত্যা হবে।’ তবে রুবিও দাবি করেছেন, ইরান হরমুজ প্রণালি বন্ধ করলে এর বিরুদ্ধে পাল্টা ব্যবস্থা নেওয়ার সক্ষমতা যুক্তরাষ্ট্রের আছে। অপরদিকে, ইরান-ইসরায়েল সংঘাত যাতে বিশ্বের অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলতে না পারে সেজন্য এ সংঘাত বন্ধের লক্ষ্যে প্রচেষ্টা জোরদারের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে বেইজিং। গতকাল চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নিয়মিত প্রেস ব্রিফিংয়ে এ আহ্বান জানান মুখপাত্র গুয়ো জিয়াকুন। এ সময় তিনি পারস্য উপসাগর ও পার্শ্ববর্তী সমুদ্র এলাকাকে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের গুরুত্বপূর্ণ রুট হিসেবে উল্লেখ করেন। হরমুজ প্রণালি ইস্যুতে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পক্ষে ওই আহ্বানের পর তার ওই বক্তব্য এলো। গত শনিবার ভোরে ইরানের তিনটি পারমাণবিক স্থাপনায় বিমান হামলা চালায় যুক্তরাষ্ট্র। এতে তিনটি স্থাপনাই সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে গেছে বলে দাবি করেছে হোয়াইট হাউস। আন্তর্জাতিক নিয়মনীতি লঙ্ঘন করে এ হামলা চালানোর জেরে পরদিনই ইরানের পার্লামেন্টে হরমুজ প্রণালি বন্ধ করে দেওয়ার একটি প্রস্তাব পাস হয়। এই প্রস্তাবে হরমুজ প্রণালি বন্ধের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। ওইদিন ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনের খবরে বলা হয়, পার্লামেন্টে পাস হওয়া প্রস্তাব বাস্তবায়ন হবে কিনা এ সিদ্ধান্ত নেবে দেশটির সর্বোচ্চ নিরাপত্তা পরিষদ (সুপ্রিম সিকিউরিটি কাউন্সিল)। এ বিষয়ে ইরানের বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর (আইআরজিসি) কমান্ডার ইসমাইল কোসারি দেশটির বার্তা সংস্থা ইয়াং জার্নালিস্ট ক্লাবকে বলেন, ‘হরমুজ প্রণালি বন্ধের বিষয়টি আমাদের এজেন্ডায় রয়েছে, প্রয়োজন হলে তা বাস্তবায়ন করা হবে।’
বিশ্ববাজারে মোট তেল ও গ্যাস সরবরাহের প্রায় ২০ শতাংশই পরিবহন করা হয় ইরানের উপকূল লাগোয়া বিশ্বের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ জলপথ হরমুজ প্রণালি দিয়ে। সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ প্রধান তেল রপ্তানিকারক দেশগুলো এ পথ ব্যবহার করে উন্মুক্ত সমুদ্রে পৌঁছায়। এ প্রণালি বন্ধ হলে বৈশ্বিক জ্বালানির জোগান ব্যাহত হবে। আর এর প্রভাব পড়বে বিশ্ববাজারে। ফলে তেলের দাম হঠাৎ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ ছাড়া সাময়িকভাবে হলেও মার্কিন যুদ্ধজাহাজগুলোর পারস্য উপসাগর থেকে বের হওয়া কঠিন হতে পারে।
বিশ্ববাজারে বেড়েছে জ্বালানি তেলের দাম : ইরানে হামলার পর বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম ব্যাপক হারে বেড়েছে। হামলার পরদিন রাতেই যুক্তরাষ্ট্রের শেয়ারবাজারে তেলের দাম বেড়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের মূল্য ৩ দশমিক ৬ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে প্রতি ব্যারেলের দাম দাঁড়িয়েছে ৭৬ দশমিক ৪৭ ডলার। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড হিসেবে পরিচিত ব্রেন্ট ওয়েলের (তেল) দাম ৩ দশমিক ২ শতাংশ বেড়ে দাঁড়ায় ৭৪ দশমিক ৫৯ ডলার। তবে বিশ্ববাজারে এই অস্থিরতার মধ্যেই মার্কিন ডলারের মান বেড়েছে প্রায় শূন্য দশমিক ৩ শতাংশ। বৈশ্বিক সংকট ও অনিশ্চয়তার সময়ে ডলারের মান সাধারণভাবে বৃদ্ধি পায়। তবে ট্রাম্প প্রশাসনের ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতির কারণে এ প্রবণতা এবার কতটা স্থায়ী হবে, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। বিশ্লেষকেরা বলছেন, ইরান-ইসরায়েল সংঘাতে নতুন মাত্রা ও মার্কিন পদক্ষেপের প্রতিক্রিয়ায় বাজারে উদ্বেগ বাড়ছে, যার প্রভাব সরাসরি জ্বালানি ও বিনিয়োগ খাতে পড়ছে।
হরমুজ প্রণালি থেকে ফিরে গেল দুই তেলবাহী জাহাজ : মার্কিন হামলার পর হরমুজ প্রণালিতে ইতোমধ্যে জাহাজ চলাচলের ওপর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। মার্কিন গণমাধ্যম ব্লুমবার্গের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, হামলার পর হরমুজ প্রণালি থেকে দুই তেলবাহী জাহাজ ফিরে গেছে। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে জাহাজগুলোর হরমুজ প্রণালি এড়িয়ে চলার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, রবিবার ‘কোসউইজডম লেক’ ও ‘সাউথ লয়্যালটি’ নামের দুটি খালি সুপারট্যাংকার হরমুজ প্রণালিতে প্রবেশ করলেও তারা আচমকা গন্তব্য বদলে ফেলে। দুটি জাহাজের প্রতিটিতে প্রায় ২০ লাখ ব্যারেল অপরিশোধিত তেল পরিবহনে সক্ষম। ব্লুমবার্গ আরও জানায়, চলমান উত্তেজনার মধ্যে জাহাজগুলোর ফিরে যাওয়া মধ্যপ্রাচ্যে বিকল্প রুটে চলাচল শুরুর প্রথম ইঙ্গিত হিসেবে দেখা হচ্ছে। চলমান সংকট সরবরাহ ও পরিবহনব্যবস্থায় কী ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে, সে বিষয়ে জাহাজের মালিক ও ব্যবসায়ীরা সতর্কভাবে নজর রাখছেন।