রাজধানীর খামারবাড়ির কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন (কেআইবি) চত্বরে অনুষ্ঠিত হলো তিন দিনব্যাপী জাতীয় ফলমেলা। রাজধানীসহ দেশের ৬৪ জেলার ৪৩১ উপজেলায় এ ফলমেলা অনুষ্ঠিত হয়েছে। জাতীয় ফলমেলার এবারের প্রতিপাদ্য ছিল ‘দেশি ফল বেশি খাই, আসুন ফলের গাছ লাগাই’।
কৃষি ও স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন, ‘দেশীয় ফল উৎপাদনে প্রত্যাশিত অগ্রগতিতেও বিদেশি ফল আমদানি করতে হচ্ছে। প্রতি বছর দেশে প্রায় সাড়ে আট লাখ টন ফল আমদানি করতে ১০ হাজার কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা চলে যায়। আমদানীকৃত ফলের প্রায় ৮৫ শতাংশই আপেল, কমলা, মাল্টা ও আঙুরের দখলে।’ তিনি বলেন, ‘তবে আশার কথা, দেশেও সীমিত পরিসরে কমলা ও মাল্টার চাষ হচ্ছে, যা ক্রমান্বয়ে আমদানিনির্ভরতা কমাবে। জনগণের পুষ্টিচাহিদা পূরণে দেশীয় ফলের উৎপাদন বাড়াতে হবে।’ কৃষি উপদেষ্টা বলেন, জেলা-উপজেলায় মেলার উদ্দেশ্য হলো দেশীয় ফল সবার কাছে পরিচিত করা। অনেকেই দেশি ফল চেনেন না। তারা আঙুর, আপেলের মতো বিদেশি ফল খান। অথচ আমাদের ফলের গুণগত মান ও স্বাদ বিদেশি ফলের চেয়েও বেশি।
দেশবাসীকে দেশি ফল খাওয়ার আহ্বান জানিয়ে উপদেষ্টা বলেন, ‘দেশি ফল খেলে বৈদেশিক মুদ্রাও সাশ্রয় হবে। আমরা বিদেশে প্রচুর দেশি ফল পাঠাচ্ছি। যার মধ্যে রয়েছে আম, কাঁঠাল ও পেয়ারা। চীনে নতুনভাবে আম পাঠানো শুরু হয়েছে। রপ্তানি বাড়লে কৃষকরা উপকৃত হবে।’ ফলমেলার গুরুত্ব অপরিসীম। এটি দেশীয় ফল উৎপাদন ও গ্রহণ বৃদ্ধিতে সহায়ক, সেই সঙ্গে পুষ্টির চাহিদা পূরণ ও অর্থনৈতিক উন্নয়নেও অবদান রাখে। ফলমেলা একটি গুরুত্বপূর্ণ প্ল্যাটফর্ম যেখানে কৃষক, ব্যবসায়ী এবং ভোক্তারা একত্র হয়ে ফল ও ফল প্রক্রিয়াজাত পণ্য সম্পর্কে জানতে ও পারস্পরিক অভিজ্ঞতা বিনিময় করতে পারে। পুষ্টির চাহিদা পূরণে ফলমেলার মাধ্যমে বিভিন্ন প্রকার দেশি ফলের সঙ্গে মানুষের পরিচয় ঘটে এবং তাদের পুষ্টিগুণ সম্পর্কে ধারণা বাড়ে। অর্থনৈতিক উন্নয়নে ফলমেলা স্থানীয় ফলচাষিদের জন্য একটি বাজার তৈরি করে, যা তাদের অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হতে সাহায্য করে। কৃষি ও ফলের প্রচার বাড়াতে ফলমেলা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ফলমেলা ফল চাষ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ-বিষয়ক বিভিন্ন প্রযুক্তি ও পদ্ধতি প্রদর্শনের মাধ্যমে কৃষকদের উৎসাহিত করে। স্বাস্থ্যসচেতনতা বাড়াতে মেলায় ফল খাওয়ার উপকারিতা সম্পর্কে আলোচনা করা হয়, যা মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্যকর জীবনযাপনের প্রতি আগ্রহ বাড়ায়। বাজার সংযোগ বাড়াতে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে পারে। ফলমেলা দেশীয় ফলের জন্য একটি নতুন বাজার তৈরি করে এবং রপ্তানির সুযোগ বাড়ায়। পর্যটক আকর্ষণে ফলমেলা ইতিবাচক ভূমিকা রাখে। সাংস্কৃতিক বিনিময় বাড়াতে ফলমেলা বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের মধ্যে সাংস্কৃতিক আদানপ্রদানে সহায়তা করে। মূল কথা একটি আধুনিক ফলমেলার মূল উদ্দেশ্য হলো ফল উৎপাদক, ভোক্তা, গবেষক ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করা এবং উদ্ভাবনী প্রযুক্তি, নতুন জাত ও বাজার সম্ভাবনা তুলে ধরা।
একটি আধুনিক ফলমেলায় যেসব বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান থাকে তা হলো বৈচিত্র্যময় ফল প্রদর্শনী, দেশি ও বিদেশি নতুন জাতের ফল, জিআই (এও) স্বীকৃত ফল (যেমন হিমসাগর আম) বিষয়ে জানার সুযোগ রাখা, প্রযুক্তিনির্ভর প্রদর্শনী যেমন স্মার্ট কৃষিপ্রযুক্তি (ড্রোন, সেন্সর ব্যবহার প্রদর্শনী), ফল সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণপ্রযুক্তি প্রদর্শন, অ্যাপ ও ডিজিটাল কৃষিব্যবস্থাপনা সম্পর্কে ভিডিও প্রদর্শন, চাষি-ভোক্তা সংযোগ বৃদ্ধিকল্পে বিভিন্ন নাটিকা উপস্থাপন, চাষিদের সরাসরি বিক্রির সুযোগ বিশেষ করে অনলাইন মার্কেটিং বিষয়ে নীতিমালাসমূহ প্রদর্শন করা, ভোক্তাদের জন্য টেস্টিং বুথ রাখা, ভিডিওর মাধ্যমে ‘ফার্ম-টু-টেবিল’ ধারণা প্রচার করা, জ্ঞান ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র রাখা, পাশাপাশি কৃষিবিজ্ঞানীদের সেমিনার আয়োজনের ব্যবস্থা রাখা এবং সেখানে সফল কৃষকদের অভিজ্ঞতা বিনিময়ের সুযোগ রাখা। যেখানে ফলভিত্তিক খাবার উৎসব থাকবে, শিশুদের জন্য শিক্ষামূলক গেম/কুইজ রাখা যেতে পারে। কৃষি-সংস্কৃতিসম্পর্কিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিচালনা করা; সর্বোপরি, ই-গভর্ন্যান্স ও সরকারি সহায়তা বুথ রাখা, প্রযুক্তি বিষয়ে পর্যাপ্তসংখ্যক লিপলেট/বুকলেট/প্রযুক্তিবার্তা বিতরণ করা; কৃষিঋণ, বিমা, প্রশিক্ষণ ও প্রণোদনার তথ্য প্রচার করা এবং বিজ্ঞানী ও কৃষি অফিসারদের উপস্থিতি, পরামর্শ প্রদান নিয়মিত রাখাসহ মেলার ব্যাপক প্রচারণা বাড়ানো গেলে একটি ফলমেলা আরও অধিক কার্যকর ও প্রাণবন্ত হয়ে উঠবে এবং এর সামাজিক প্রভাব পড়বে বিস্তৃতভাবে। তার জন্য পর্যাপ্ত বরাদ্দ ও সরকারের পৃষ্ঠপোষকতার প্রয়োজন রয়েছে।
লেখক : কৃষি অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও কলামিস্ট