দেশের উত্তর-পশ্চিমের সীমান্তবর্তী জেলা চাঁপাইনবাবগঞ্জ এর ওপর দিয়ে বয়ে গেছে চারটি নদী। নদীগুলো হলো- পদ্মা, মহানন্দা, পাগলা ও পুনর্ভবা নদী। এই চারটি নদীর মধ্যে পাগলা নদীর পানির উপর নির্ভরশীল ছিল জেলার সর্ববৃহৎ শিবগঞ্জ উপজেলার ঘোড়াপাখিয়া, ছত্রাজিতপুর, নয়ালাভাঙ্গা, উজিরপুর, পাঁকা, শিবগঞ্জ পৌরসভা, দুর্লভপুর, কানসাট, শ্যামপুর ও শাহবাজপুর ইউনিয়নের জনসাধারণ।
এ ছাড়াও সদর উপজেলার রানীহাটি ও সুন্দপুর ইউনিয়নসহ আশপাশের ইউনিয়নের বাসিন্দারাও এই নদীর পানির ওপর ছিলেন নির্ভরশীল। কিন্তু বর্তমানে আষাঢ় মাসেও এই নদীতে পানি নেই।
জানা যায়, পাগলা নদীটি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মালদহ জেলার মহদিপুর হয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার শাহবাজপুর ইউনিয়নের সোনামসজিদ এলাকা দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে সদর উপজেলার সুন্দরপুর ইউনিয়নের কালিনগর এলাকায় মহানন্দা নদীর সাথে মিলিত হয়েছে। এই নদীর দৈর্ঘ্য প্রায় ৪০ কিলোমিটার। একসময় নদীটি ছিল খরস্রাতা। সারাবছর পানি থাকত, নদী তীরবর্তী বাসিন্দারা গোসলসহ গৃহস্থালির কাজে ব্যবহার করত পাগলার পানি। শিবগঞ্জ ও সদর উপজেলার পুঁটিমারি বিলের পানির যোগান ছিল এই পাগলা নদী। নদীতে ছিল প্রচুর দেশী প্রজাতির মাছ। নদীটিকে ঘিরেই গড়ে উঠেছিল রামচন্দ্রপুর হাটে বৃটিশদের নীলকুঠি, কানসাটে স্থাপন করা হয়েছিল ময়মনসিংহের মুক্তাগাছার জমিদারের রাজভবন, জাহ্নমুণির আশ্রম। এই নদীটি ছিল একসময়ের ব্যবসা-বাণিজ্যেরও প্রাণ। গড়ে উঠেছিল রামচন্দ্রপুর বাজার, কালিনগর বাজার, রাণীহাটি বাজার, শিবগঞ্জ বাজার ও কানসাট বাজার। নদীটির পানি বিলে ব্যবহারের জন্য কানসাট, জোহুরপুর দাঁড়া, ত্রিমোহনী ও মহানন্দা নদীর বারঘরিয়া এলাকায় মরিচা দাঁড়া নামকস্থানে নির্মাণ করা হয় স্লুইসগেট। এই ৩টি স্লুইস গেট দিয়েই বিলভাতিয়া, তেতুলিয়া, বাঁশবাড়িয়া, পুঁটিমারিসহ গোটা বিলে নদীর পানি ঢুকে একদিকে যেমন মৎস্য চাষ হতো অন্যদিকে তেমনি হতো ধান চাষ। এক সময় এই পাগলা নদী দিয়েও চলত লঞ্চ। ঢাকুয়ালদের দাঁড়, পাল ও গুন টানা নৌকায় আম চালান যেত ঢাকার বাজারে। এই নদী পথেই চলত জমজমাট ব্যবসা-বাণিজ্য। বন্যা মৌসুমে এত বেশি স্রোত থাকতো যে, কেউ নৌকা নিয়ে পারে যাবার চেষ্টা করত না। সেই বহতা নদী এখন মরা একটি খালে পরিণত হয়েছে।
জানা যায়, বর্ষাকালে বৃষ্টির পাশাপাশি এই নদীর একটা অংশের পানির উৎস ছিল পদ্মা নদী। কিন্তু প্রয়োজনের তাগিদেই সম্প্রতি পদ্মা নদীর ভাঙ্গন রোধে শিবগঞ্জ উপজেলার উজিরপুর ইউনিয়নের দশরশিয়া দাঁড়ায় ও ১৮ কলম নামকস্থানে বেড়ি বাঁধ নির্মাণ করায় পাগলা নদীর সাথে পদ্মা নদীর সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ফলে পাগলা নদী আরও পানিশূন্য হয়ে পড়ে। এই আষাঢ়ে বৃষ্টিও নেই, পদ্মার পানিও আর আসে না। ফলে শিবগঞ্জ ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদরের নদীতীরবর্তী বিশাল এলাকার জনসাধাণ পানি সংকটে পড়েছে। বন্ধ হয়ে গেছে নৌপথে ব্যবসাবাণিজ্য। এখন আর পাওয়া যায় না দেশী প্রজাতির মাছ। কোন নৌকা ছাড়ায় মানুষ অনায়াসে পায়ে হেটে নদীপারাপার হচ্ছে। নদীটি হারিয়ে ফেলেছে তার ঐতিহ্য।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী সৈয়দ শাহিদুল আলম বলেন-একসময়ের খরস্রোতা পাগলা নদীটির দৈর্ঘ্য প্রায় ৪০ কি.মি। নদীটি খনন করা গেলে নদীতীরবর্তী কয়েক লাখ লোক উপকৃত হবে। নদীর পানি সেচসহ অন্যান্য কাজে ব্যবহার করা যাবে। দেশী প্রজাতির মাছ চাষ করে সরকার কয়েক কোটি টাকার রাজস্ব পাবে। ফিরে আসবে জীববৈচিত্র। এ জন্য সংশ্লিষ্ট সংসদ সদস্যদের ডিও লেটার লাগবে। তাঁরা ডিও লেটার দিলে এ ব্যাপারে পানি উন্নয়ন বোর্ডে নদীটি খননের জন্য প্রস্তাবনা দেওয়া যেতে পারে বলেও মনে করেন তিনি।