বগুড়ার সারিয়াকান্দির যমুনা নদীর চরে জেগে ওঠা বালুচরে কৃষিবিপ্লব ঘটিয়েছেন নদী ভাঙা মানুষ। নদীর চরে বিভিন্ন ফসল ফলিয়ে এখন আয়ের পথ দেখছেন। বিস্তীর্ণ বালুচরে শোভা পাচ্ছে নানা রকম ফসলের সমারোহ। আর এই ফসল স্থানীয় বাজারে বিক্রি করে চরের হত দরিদ্ররা এখন সুদিনের গল্প বুনতে শুরু করেছে। বন্যার পর চরের মাটিতে কাঁচা মরিচসহ বিভিন্ন সবজি চাষ করে আয় করতে শুরু করেছেন নদী ভাঙ্গনের শিকার কৃষকরা।
বগুড়ার সারিয়াকান্দির যমুনার চরাঞ্চল একসময় ধুধু বালুচরে ঢাকা থাকতো। এখন চোখ ধাঁধাঁনো বালু চরের পাশাপাশি দোঁআশ মাটির কারণে বর্ণিল সবুজ ফসলের বনভূমি দেখা যায়। যমুনার বালুচরে পলিমাটি জমে এখন উর্বর আবাদি জমিতে পরিণত হয়েছে। বালুচরে শোভা পাচ্ছে নানা রকম ফসল।
নদীর তলদেশ শুকিয়ে জেগে ওঠা বালুচর এখন শস্য ভান্ডার নামে পরিচিতি পাচ্ছে। এবারের বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পরপরই চরের চাষিরা নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে জমিতে ফসল চাষে সময় দিচ্ছেন। যমুনা নদীতে পানি কমে যাওয়ার সাথে সাথেই চাষিরা নতুন করে উর্বর চরের জমিতে চাষাবাদ শুরু করেন।
নদী তীরবর্তী সারিয়াকান্দি, সোনাতলা ও ধুনটের মধ্যে সারিয়াকান্দির চরাঞ্চল বেশি হওয়ায় ফসলও বেশি চাষাবাদ হয়। মরিচ, ভুট্টা ও পাটের পাশাপাশি ধান, গম, সরিষা, চিনা বাদাম, মিষ্টি কুমড়া, আলু, মিষ্টি আলু, রসুন, পিঁয়াজ, কাউন, মশুর ডাল ও খেসারি ডাল-সহ প্রায় সবধরনের শাক-সবজি চাষাবাদ করে কৃষকরা।
তবে মরিচের চাষ বেশি হয়, এবার চরাঞ্চলে সাড়ে ৩ হাজার হেক্টর জমিতে দেশি ও হাইব্রিড জাতের মরিচ চাষ হয়েছে। প্রতি বিঘায় ৫০ থেকে ৭০ মন মরিচ উৎপাদন হয়, জেলার চাহিদা মিটিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে যাচ্ছে বগুড়ার চরাঞ্চলের লাল মরিচ।
শুকনো আকারে মরিচের উৎপাদন হবে প্রায় ৭ হাজার মে. টন। আর কাঁচা আকারে ১৩ হাজার মে. টন। চাষীরা ইতিমধ্যেই মরিচ বাজারে বিক্রি শুরু করেছেন।
চরাঞ্চলের ২৫’শ হেক্টর জমিতে ভুট্টা ও ২১’শ হেক্টর জমিতে পাট চাষ হয়ে থাকে। চরাঞ্চলের ১৬ হাজার ৭৩৩ হেক্টর জমিতে ফসল ফলান কৃষকরা। একটি ফসল ঘরে তুলে আবারও নতুন ফসল ফলাতে জমি পরিচর্যার কাজ শুরু করেন কৃষকরা। নদী ভাঙা অভাবী শত শত পরিবার নদীর বুকে জেগে ওঠা বালুচরকে কাজে লাগিয়ে অভাব দূর করছেন। এসব পরিবারের নারীরা তাদের স্বামী-সন্তান নিয়ে পরিশ্রম করে ফসল ফলাচ্ছেন। সেই ফসল বিক্রি করে লাভবানও হচ্ছেন। নদীর চরে বিভিন্ন ফসল ফলিয়ে তারা অভাব-অনটন দূর করছেন। নদীর বুকে বালুচরে ভাগ্য বদলের স্বপ্নে ফসল বুনে ঘরে তুলে লাভবান হচ্ছেন খেটেখাওয়া মানুষ।
বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলার চালুয়াবাড়ী, হাটবাড়ী, ফাজিলপুর, তেলীগাড়ী, গওলাডাঙ্গা, মানিকদাইড়, আউচারপাড়া, কাকালিহাটা, সবুজের পাড়া, চকরথিনাথ, দিঘাপাড়া, করনজাপাড়া, বনরপাড়া, কাজলা, জামথল, পাকুরিয়া ২০টি চরে এবং সোনাতলা উপজেলার পাকুল্লা, পূর্ব সুজাইতপুর, খাটিয়ামারী, রাধাকান্তপুর, তেকানী চুকাইনগর ইউনিয়নের চরমোহনপুর, কমপক্ষে ১৬টি চরে চাষাবাদ হয়।
সোনাতলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, ২০২০-২১ অর্থবছরে ১০০ হেক্টর জমিতে ভুট্টা,১০৫০ হেক্টর জমিতে বোরো ধান, ৩৬০ হেক্টর জমিতে গম, ৩০৫ হেক্টর জমিতে সরিষা, ৮৫০ হেক্টর জমিতে মরিচ, ২৭০ হেক্টর জমিতে আলু, ১৫ হেক্টর জমিতে মিষ্টি আলু, ২৫ হেক্টর জমিতে চিনা বাদাম, ৬০ হেক্টর জমিতে মশুর ডাল, ১৭০ হেক্টর জমিতে সবজি চাষ হচ্ছে।
বগুড়ার সোনাতলা উপজেলা কৃষি অফিসার মাসুদ আহম্মেদ জানিয়েছেন, ‘সরকারের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর কৃষিতে উন্নত প্রযুক্তির প্রয়োগ শুরু করেছে। চরাঞ্চলগুলোতেও প্রযুক্তিনির্ভর উন্নত জাতের বীজের মাধ্যমে চাষাবাদ শুরু হয়েছে। যার ফলে প্রতিবছর চরাঞ্চলগুলোতে কৃষি সম্প্রসারিত হচ্ছে, বাড়ছে উৎপাদন।
এছাড়া সারিয়াকান্দির ৩ হাজার ৭০৫ হেক্টর জমিতে মরিচ, ৭০৫ হেক্টর জমিতে শাকসবজি, ৯৫০ হেক্টর জমিতে আলু, সরিষা ২৭৮০ হেক্টর জমিতে, ১৩২০ হেক্টর জমিতে গম, ৩১৫০ হেক্টর জমিতে ভুট্টা, ১০ হেক্টর জমিতে আখ, ৪৫ হেক্টর জমিতে রসুন, ৩৭০৫ হেক্টর জমিতে মরিচ, ৮৪০ হেক্টর জমিতে মসুর, ৮৫০ হেক্টর জমিতে খেসারি সহ মিষ্টি আলু, চিনা বাদাম, খেরাছী, কেসুর আলু, পিঁয়াজ, কলা, পেপে চাষ হয়েছে।
বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আব্দুল হালিম জানান, চলতি বছরে জমিতে দীর্ঘ সময় বন্যার পানি থাকায় মরিচের গাছে রোগ জীবানু কম। ফলে কৃষকের খরচ কম হয়েছে, উৎপাদন বেশি হয়েছে। কৃষি কর্মকর্তারা নিয়মিত পরামর্শ প্রদান করছেন চাষীদের। এ এলাকার চাষীরা চরাঞ্চলে সবজিসহ বিভিন্ন ফসল উৎপাদন করছেন। গোটা চরাঞ্চল যেন সবুজের সমারোহ।
বিডি প্রতিদিন/কালাম