ঈদের খুব বেশি দেরি না থাকায় ব্যস্ততা বেড়েছে বগুড়ার শেরপুর উপজেলায় গড়ে ওঠা বেনারসি শাড়ি পল্লীতে। রাত দিন পালা করে বেনারসি পল্লীর কারিগররা কাজ করে যাচ্ছেন। বেনারসি পল্লীর খেটে খাওয়া মানুষগুলো ঈদকে সামনে রেখে একটানা শাড়ি বুননের কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। বেনারসি শাড়ির বাজারে নতুন করে চাহিদা সৃষ্টি হওয়ায় পল্লীর কারিগররা আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন। ঈদের সময় এসে এই ব্যস্ততা বাড়লেও বছরের বাকি সময় প্রায় কর্মহীন হয়ে থাকতে হয়। ৫০টির মতো তাঁত মেশিন থাকলেও এখন রয়েছে প্রায় ১৫টির মতো তাঁত মেশিন। অনেকেই লোকসানে পেশা বদল করে দিয়েছেন। বেনারসি পল্লীতে এখন আর আগের সেই জৌলুস নেই।
জানা যায়, বাঙালি ললনাকে মানায় শাড়িতে। তা যদি হয় উন্নতমানের তবে তো কোনো কথাই নেই। আর এ উন্নতমানের বেনারসি শাড়ি তৈরি হচ্ছে বগুড়ার শেরপুর উপজেলার সুযোগ-সুবিধা বঞ্চিত ও অবহেলিত গেঁয়োপাড়া ঘোলাগাড়ি কলোনিতে। বগুড়া জেলা শহর থেকে প্রায় ২২ কিলোমিটার দক্ষিণে শেরপুর উপজেলা শহর। সেখান থেকে ৪-৫ কিলোমিটার পশ্চিমে ঘোলাগাড়ি কলোনি। বাইরের মানুষের কাছে ঘোলাগাড়ি কলোনি বেনারসি পল্লী নামেই সর্বাধিক পরিচিত। বর্তমানে প্রায় ২৫ থেকে ৩০ হাজার মানুষের বসবাস গ্রামটিতে।
১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর ভারতের বিহার রাজ্য থেকে এদের অধিকাংশ এ গ্রামে এসে স্থায়ী বসবাস গড়ে তোলেন। এ গ্রামের মানুষ প্রধান পেশা হিসেবে বেনারসি শিল্পকে বেছে নিয়েই বেঁচে থাকার জীবন সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন। আর এ শিল্পই তাদের জীবনে বয়ে এনেছে সুখকর দিন। করেছে সবাইকে স্বাবলম্বী। তবে এক সময় এই শিল্পের ব্যাপক প্রসার ঘটলেও কালের আবর্তনে কদরে বেশ ভাটা পড়ে যায়। বিদেশি শাড়ির প্রভাবে দেশীয় তৈরি বেনারসি শাড়ির বিপণন কমে যায়। কিন্তু করোনা ভাইরাসের প্রভাব কমে যাওয়ায় দেশীয় তৈরি বেনারসি শাড়ির কদর বাড়তে থাকে। সে কারণে বগুড়ার কারিগরদেরও কিছুটা ব্যস্ততা বেড়ে যায়। সাংসারিক কাজের ফাঁকে-ফাঁকে নারীরাও এ পেশায় নিজেদের যুক্ত করেন। একটা সময় এ গ্রামের বেশির ভাগ নারী এ পেশার সঙ্গে নিজেদের জড়িয়ে ফেলেছিলেন। এ থেকে বাড়তি আয় হয়। সে আয় তাদের অভারের সংসারের অভাব অনেকটা দূর করে।
বগুড়ার শেরপুর উপজেলার বেনারসি শাড়ির কারিগররা জানান, সরকার কৃষি ব্যাংকের মাধ্যমে আগে তাঁতীদের বা কারখানা মালিকদের মেশিন প্রতি ১৮ হাজার টাকা করে ঋণ দিতেন। বর্তমানে তা বাড়িয়ে প্রায় লাখ টাকা করেছেন। কিন্তু ঢাকার ব্যবসায়ীরা সঠিক সময় তাদের পণ্যের মূল্য পরিশোধ না করায় ঋণের টাকা পরিশোধে হিমশিম খেতে হয় তাদের। কেননা অনেকটা বাধ্য হয়েই তাদের তৈরি পোশাকের সিংহভাগ বিক্রি করতে হয় ঢাকায়।
বেনারসি পল্লীর মালিকরা জানান, বেনারসি শাড়ি তৈরির কাঁচামালের মূল্য বেশি হওয়ার কারণে বেনারসি শাড়ি তৈরি করে শ্রমিকদের বেতন দিয়ে তেমন লাভের মুখ দেখতে পান না কারখানা মালিকরা। তাই সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অনেকেই এ পেশা ছেড়ে দিয়েছেন। এ শিল্প বাঁচিয়ে রাখতে মালিক ও কারিগরদের প্রতি সরকারের সুদৃষ্টি প্রয়োজন। সম্পূর্ণ মেশিনে তৈরি ভারতীয় শাড়ি আমদানির জন্য ব্যবসায় মন্দা যাচ্ছে তাদের। তবে হাতে তৈরি এসব পোশাকের কদর অন্যরকম। সরকারি অনুদান পেলে আবারও ঘুরে দাঁড়াতে পারবে বলে তারা মনে করেন।
তারা বলেন, পোশাক তৈরিতে মাটি কেটে নির্দিষ্ট স্থানে চার কোণাকৃতির গর্ত তৈরি করা হয় প্রত্যেক কারখানার জন্য। গর্তে আসন গাড়েন কারিগররা। সেখানে বসেই মেশিন চালান তারা। বাহারি ডিজাইনের ক্যাটালগ লাগানো হয় প্রত্যেক তাঁত মেশিনে। সামনে জালের মতো বিছানো রং-বেরংয়ের সুতা। কারিগরের হাত-পায়ের তালে তালে চলে তাঁত। সচল মেশিনে সুতাভর্তি একটি বিশেষ কাঠ হাতে নিয়ে এপাশ ওপাশ করেন। এই কৌশলের মধ্যে দিয়েই বেনারসি শাড়ি বুনন হয়ে থাকে।
কারখানার মালিক ও কারিগর আব্দুল কাদির ও আজাদ মঞ্জুর জানান, ছোট থেকেই তারা এ পেশার সঙ্গে জড়িত। ১৯৯০ সালের পর থেকে এ শিল্পের ব্যাপক প্রসার ঘটতে থাকে। শেরপুর উপজেলার ঘোলাগাড়ী কলোনিতে তারাসহ হাতে গোনা কয়েকজন প্রথম শাড়ি বুননের কাজ শুরু করেন। প্রথমদিকে একটি শাড়ি তৈরিতে প্রায় এক সপ্তাহ সময় লেগে যেতো। তখন বিদ্যুৎ ছিল না। গ্রামীণ অবকাঠামো ভালো ছিল না। এখন কলোনির বিদ্যুৎ রয়েছে। রাস্তা-ঘাট আগের তুলনায় বেশ ভালো। বর্তমানে দুই-তিন দিনেই তৈরি করা যাচ্ছে উন্নতমানের একেকটি বেনারসি শাড়ি। এখন বাজারে বেনারসি পাইকারি বাজারে ৩ হাজার টাক থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ৩৫ হাজার টাকা, জামদানি ৪ হাজার ৫০০ থেকে ৮ হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। পাকিস্তান, তাইওয়ান, চায়না, ভারত ও দেশীয় সুতার ব্যবহার হয়ে থাকে এ শাড়িগুলোতে। এ এলাকার বেনারসি শাড়িগুলো ঢাকার ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন জেলায় চলে যায়।
জাবির হোসেন, রশিদ মিয়া জানান, তাদের তৈরি শাড়িগুলো ঢাকার মিরপুর-১০, ১১, ১২ এর ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করেন। মিরপুরের ব্যবসায়ীরা ঘোলাগাড়ি কলোনিতে তৈরি করা বেনারসি শাড়ির প্রধান ক্রেতা। এছাড়া উত্তরবঙ্গের বগুড়া, রাজশাহী, সিরাজগঞ্জ, রংপুর, গাইবান্ধা, নাটোরসহ বিভিন্ন জেলায় এসব শাড়ি বিক্রি করা হয়ে থাকে। শাড়ি তৈরির কাঁচামালের দাম বেড়ে যাওয়ায় বর্তমানে শাড়ি বিক্রি করে বেশি লাভবান হওয়া যাচ্ছে না।
শেরপুর উপজেলার ঘোলাগাড়ী তাঁতী সমিতির আহ্বায়ক মো. ওয়াহেদ রানা জানান, তিনি একজন কারখানা মালিক ও কারিগর। বেনারসি পল্লী খ্যাত এ এলাকায় শাড়ি তৈরির কাজ আগের তুলনায় অনেকটাই কমে এসেছে। যুগের সঙ্গে সঙ্গে হারিয়ে যেতে বসেছে এই শিল্প। এক যুগ আগেও এ উপজেলার ঘোলাগাড়ি কলোনি, বড়পুকুর ও পাঁচআড়ঙ্গ এলাকায় একসময় ব্যাপক পরিসরে বেনারসি তৈরি করতো কারিগররা। শুধুমাত্র ঘোলাগাড়ি কলোনি এলাকায় ৫০টির মতো তাঁত মেশিন স্থাপন হয়েছিল। কিন্তু বর্তমানে সে সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে ১৫ থেকে ২০টিতে।
বিডি প্রতিদিন/এমআই