রবিবার, ৩১ মে, ২০২০ ০০:০০ টা

লকডাউন পদ্ধতি কতটুকু কার্যকর

গোলাম মোহাম্মদ কাদের এমপি

লকডাউন পদ্ধতি কতটুকু কার্যকর

রোগ যদি সংক্রামক হয়, প্রাণঘাতী হয় ও প্রতিষেধক আবিষ্কার না হয় তবে মহামারীরূপে আবির্ভূত হয়। বর্তমানে করোনাভাইরাস বা কভিট-১৯ এ ধরনের একটি রোগ। কোয়ারেন্টাইন করে এ ধরনের রোগ বিস্তার ঠেকানো হলো আদিকাল থেকে প্রচলিত বিজ্ঞানসম্মত বিশ্বস্বীকৃত পদ্ধতি। রোগী বা সম্ভাব্য রোগীকে আলাদা রেখে রোগকে একটি নির্ধারিত সময় পর্যন্ত জায়গায় স্থির রাখা; চিকিৎসায় রোগকে ধ্বংস করা অথবা রোগের কারণে রোগীর মৃত্যু হলে তাতেও রোগের বিনাশ হয়, সংক্রমণ থেমে যায়-এটাই হলো কোয়ারেন্টাইন পদ্ধতিতে সংক্রমণ বিস্তার রোধের কৌশল।

রোগীর সঙ্গে রোগকে একস্থানে আটকে রেখে বিনাশ করার জন্য, রোগীর সঙ্গে সম্ভাব্য রোগী হিসেবে একত্রে বসবাসরত রোগীর পরিবারবর্গ ও ঘনবসতিপূর্ণ এলাকার জন্য রোগী যে মহল্লায় বসবাস করে সেখানকার বাসিন্দাদেরও একসঙ্গে বিবেচনা করা হয়। তাদের সঙ্গে অন্যান্য এলাকার ব্যক্তিগত পর্যায়ে সামাজিক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে রাখা আবশ্যক হয়। সে উদ্দেশ্যে লকডাউন করা হয়। এর অর্থ হলো ওই চিহ্নিত এলাকার কোনো ব্যক্তি বাইরের অন্য কোনো এলাকায় যেতে পারবে না। বাইরের কেউ চিহ্নিত এলাকায় প্রবেশ করতে পারবে না।

আমাদের দেশে এ পদ্ধতি বা কৌশল সফল হওয়া প্রায় অসম্ভব। সফল না হওয়ার কিছু আর্থ-সামাজিক বাস্তবতা আছে। আর্থ-সামাজিক কারণসমূহ ছাড়া আমাদের বর্তমান পরিস্থিতিতে আর একটি বিষয় উল্লেখ করা বাঞ্ছনীয়, যা লকডাউন ব্যর্থতায় কাজ করছে। বিষয়টি হলো যথেষ্ট পরিমাণ ‘রোগ নির্ণয় পরীক্ষা’ না হওয়া।

পরীক্ষা করে রোগী শনাক্ত করা এবং তারপর তাকে ও তার মাধ্যমে পারিপার্শ্বিক সম্ভাব্য রোগ বিস্তার এলাকা নির্ণয় করে লকডাউন করা জরুরি। যত বেশি রোগী শনাক্ত করা যায় ও সে হিসেবে তাদের ঘিরে লকডাউন দেওয়া যায়; তত বেশি রোগ বিস্তার রোধে সহায়ক হয়। রোগ বিস্তারের গতি শ্লথ হয়। উল্লেখযোগ্য সংখ্যক রোগী যদি শনাক্তকরণের বাইরে থাকে রোগ বিস্তার চলতে থাকবে ও সে ক্ষেত্রে লকডাউন কার্যকর হবে না।

বাংলাদেশের রোগ শনাক্তকরণ পরীক্ষার সংখ্যা বাড়াতে হবে। দ্রুততম সময়ে পরীক্ষা ও ফলাফল পাওয়ার জন্য ‘কুইক টেস্টিং কিট’-এর অধিকতর ব্যবহার জরুরি। এতে শতকরা ১০০% নিশ্চিত ফলাফল হয়তো নাও আসতে পারে। তবে, আমাদের বুঝতে হবে নমুনা সংগ্রহ ও ল্যাব টেকনিশিয়ানদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ ও দক্ষতার অভাবে বা মনুষ্যজনিত স্বাভাবিক ভুলের কারণে শতভাগ সঠিক ফলাফল দেয় না। ফলে, অন্তত বিকল্প পদ্ধতি হিসেবে ক্রস চেকের জন্য হলেও কুইক টেস্টিং কিটের ব্যবহার অত্যাবশ্যক।

তাছাড়া, দ্রুততার সঙ্গে করোনা আক্রান্ত ব্যক্তি শনাক্তকরণ বিভিন্ন কারণে জরুরি, যেমন- রোগীকে পরিবারের সদস্যদের থেকে আলাদা করে আইসোলেশন/কোয়ারেন্টাইন (এমনকি দরকার হলে এলাকাটি লকডাউন)-এ রাখা, হাসপাতালে ভর্তি প্রয়োজনে করোনা হাসপাতাল/ইউনিটে ভর্তি ইত্যাদি। সে জন্য কুইক টেস্টিং কিট এর ব্যবহার সুবিধাজনক। তাছাড়া বিমান ভ্রমণ, গণপরিবহন ও বিশেষ কোনো সমাবেশস্থলে যোগদানের জন্য এই টেস্ট কিটের ব্যবহার অনেক সমস্যাকে সহজতর করতে সাহায্য করবে।  আমাদের দেশে লকডাউন সফল না হওয়ার আর্থ-সামাজিক বাস্তবতাগুলো নিম্নরূপ : (ক) বিশাল জনসংখ্যা/ঘনবসতির দেশ;

একই ঘরে অনেকের বসবাস, একই টয়লেট ও রান্নাঘর বহু মানুষের জন্য ব্যবহার হওয়া। পরিবারসমূহের খুব কাছাকাছি অবস্থান। জনসংখ্যার তুলনায় সুবিধাদি অপ্রতুল হওয়াও অনেকাংশে দায়ী। সে কারণে রাস্তাঘাট, ফেরি, যানবাহন, দোকানপাট সব সময় উপচে পড়া ভিড় থাকে।

লকডাউনের মধ্যেও সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা বা ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ এড়িয়ে চলার উপায় থাকে না।

(খ) বিশাল জনগোষ্ঠীর দারিদ্র্য ও অর্থনৈতিকভাবে অনিশ্চিত অবস্থান : অপ্রাতিষ্ঠানিক সেক্টরে চাকরির ওপর ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ের সঙ্গে বিশাল সংখ্যার মানুষের জীবিকা নির্ভরশীল। তাদের আয় যথেষ্ট নয় ও চাকরির বা জীবিকার নিশ্চয়তা থাকে না। জীবিকা হারালে, অর্ধাহারে অনাহারে দিন কাটাতে হয়। এমন মানুষের সংখ্যা প্রায় ৫ কোটির মতো। লকডাউনের ফলে এদের প্রায় সবাই জীবিকা বঞ্চিত হয় ও যে কোনোভাবে বেঁচে থাকার সংগ্রামে লিপ্ত হতে বাধ্য হয়। সে কারণে লকডাউন করে তাদের ঘরে ধরে রাখা প্রায় অসম্ভব হয়ে ওঠে।

ফলে, বাংলাদেশে লকডাউন কঠোর থেকে কঠোরতর করেও মানুষকে ঘরে ধরে রাখা ও মানুষে মানুষে সামাজিক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করা সম্ভব হয় না, এটাই বাস্তবতা। লকডাউনের কারণে, জীবিকা হারিয়ে বিশাল সংখ্যার সাধারণ মানুষের দুঃখ-দুর্দশা বৃদ্ধি হয় নিশ্চিতভাবে। দেশের অর্থনীতিতে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে, সেটা বলাই বাহুল্য। তবে রোগ সংক্রমণের গতিরোধে এ কৌশল তেমন কোনো ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়েছে নিশ্চিত করে বলা যায় না। সে কারণে, আমাদের উচিত অসম্ভবের পিছনে না ছুটে, বাস্তবভিত্তিক কর্মসূচি গ্রহণ করা। লকডাইন করে সংক্রমণের গতিরোধ করার প্রচেষ্টার চেয়ে রোগ আক্রান্তদের চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নয়ন এর দিকে অগ্রাধিকার দেওয়া জরুরি। ধারণা হয় এ উদ্যোগ তুলনামূলকভাবে জীবন রক্ষায় অধিক ফলপ্রসূ হবে। সে লক্ষ্যে, সরকারকে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করে, প্রতিটি সরকারি হাসপাতালে, যতটা সম্ভব সম্পূর্ণ সুবিধাসহ আলাদা করোনা বিভাগ স্থাপন করতে হবে। প্রতিটি বেসরকারি হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে আলাদা করোনা বিভাগ চালু করতে নির্দেশ দিতে হবে। না করতে পারলে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থার বিধান রেখে প্রয়োজনে অধ্যাদেশ/আইন তৈরি করতে হবে।

 

বেশির ভাগ বিশেষজ্ঞের নিশ্চিত বিশ্বাস, লকডাউন শিথিল করলে করোনা সংক্রমণ হুলস্থুলভাবে বাড়তে থাকবে। হয়তো কথাটা সত্যিও হতে পারে। কেননা বিশ্বের অনেক দেশে এটা ঘটেছে। তবে, লকডাউনের ভিতর যে সংক্রমণ তীব্রগতিতে বাড়ছে না সেটা কি আমরা নিশ্চিত? স্বাস্থ্য অধিদফতরের ঘোষণায় আক্রান্তের যে হিসাব দেওয়া হচ্ছে প্রতিদিন সেটা মোট জনসংখ্যার খুব সামান্য একটি ভগ্নাংশের পরীক্ষার হিসাব। ১৬/১৭ কোটি জনসংখ্যার দেশে আমরা মোট শনাক্তকরণ পরীক্ষা করেছি শনিবার পর্যন্ত ২ লাখ ৯৭ হাজার ৫৪ জন।

কভিড-১৯ উপসর্গসহ মৃত্যুর খবর প্রতিদিন সংবাদ মাধ্যমে আসছে। ফলে, শনাক্ত হয়নি কিন্তু উপসর্গ নিয়ে ভুগছেন নিশ্চিতভাবে অনেকজন। তাদের হিসেবে বিশেষ করে এ ধরনের রোগীর প্রতিদিনের বৃদ্ধির হিসাব কি আমরা জানতে পারছি? লকডাউনের মধ্যে যেদিন পরীক্ষার সংখ্যা বাড়ছে সেদিন আক্রান্তের সংখ্যাও বেশি দেখা যাচ্ছে।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, লকডাউনে থাকা অবস্থায় আক্রান্তের সংখ্যা প্রতিদিন বাড়ছে। বাস্তবে কতটা বাড়ছে তা নিশ্চিত নয়। কেননা যথেষ্ট পরিমাণ শনাক্তকরণ পরীক্ষা করা যাচ্ছে না। লকডাউন তুলে নিলেও পরিস্থিতি একই ধরনের হতে পারে। অর্থাৎ রোগের বিস্তার একই পর্যায়ে থাকতে পারে। কেননা লকডাউন বাংলাদেশে সঠিকভাবে পালন করা সম্ভব হচ্ছে না এটা সুস্পষ্ট। ফলে লকডাউন কার্যকর ভূমিকা রাখছে না বলা যায়।

তাছাড়া আর একটি ঘটনার দিকেও আমি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই, তা হলো, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আল্লামা জুবায়ের আহমদ আনসারীর জানাজায় বিশাল সংখ্যক মানুষের ঢল। অনেকেই আশঙ্কা করেছিলেন, সামাজিক দূরত্ব ও অন্যান্য স্বাস্থ্যবিধি তোয়াক্কা না করে, এ সমাবেশে যোগদানের ফলে, দেশে নতুন করে হাজার হাজার মানুষ আক্রান্ত হবে। বাস্তবে ওই ঘটনার পরে উক্ত এলাকায় একটিও নতুন আক্রান্তের খবর পাওয়া যায়নি, আমার জানামতে।

এতে করে একটি ইতিবাচক বিষয়ের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। সেটা হলো, বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ জন্ম থেকে বিভিন্ন রোগ জীবাণু ও চিকিৎসাগত প্রতিকূলতার সঙ্গে সংগ্রাম করতে অভ্যস্ত। জীবাণুযুক্ত পানীয়, খাদ্যসামগ্রী গ্রহণ; অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ ও রোগে সুচিকিৎসার সীমাবদ্ধতার মাঝেও তারা টিকে থাকেন। সে মানুষগুলো একটি শক্তিশালী রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা নিজেদের ভিতর তৈরি করে ফেলেন বলা যায়, না হলে তারা বেঁচে থাকতে পারতেন না। করোনাভাইরাস মোকাবিলায় এ ক্ষমতা তাদের রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করবে, এটা হলো আশার কথা। তবে এ বিষয়টি এখনো সুনিশ্চিত নয়। করোনা হলেই সবার মৃত্যু হবে এমনটাও নয়। এ পর্যন্ত বিভিন্ন দেশের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায়, শতকরা ৮০/৮৫ ভাগ রোগী নিজের বাসায় চিকিৎসা নিতে পারেন ও সেখান থেকেই সুস্থ হতে পারেন। শতকরা ১৫/২০ ভাগ রোগীর ক্ষেত্রে হাসপাতাল সুবিধার প্রয়োজন হয়। শতকরা ৫ ভাগ জটিলতায় ভোগেন। মৃত্যুর হার ২ থেকে ৫ শতাংশ।

করোনা মোকাবিলার একটি বড় বাধা অতি সচেতনতা। যার ফলশ্রুতিতে করোনা উপসর্গ না নিয়েও অসুস্থ মানুষ ডাক্তারদের কাছে বা ক্লিনিক, হাসপাতালে চিকিৎসা পাচ্ছে না অনেক সময়। করোনার চিকিৎসায় জড়িতদের সামাজিক নিগ্রহের শিকার হওয়ার খবর পাওয়া যাচ্ছে। করোনা আক্রান্তদের অস্পৃশ্য মনে করা হচ্ছে এবং তাদের প্রতি অতি অমানবিক আচরণ করা হচ্ছে বিভিন্নভাবে।

ছোঁয়াচে হলেও, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখলে ও কিছু স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললে একজন করোনা রোগীর পাশে থেকেও নিরাপদ থাকা যায়। সচেতনতা অবশ্যই দরকার। মনে রাখতে হবে, আমরা যে কেউই করোনা আক্রান্ত হতে পারি। সবার সাহায্য-সহযোগিতা ও মানসিক সমর্থনই আক্রান্তদের সুস্থতা নিশ্চিত করতে পারে। সে মানসিকতা নিয়ে আমরা সবাই করোনা জয় করব।         

লেখক : রাজনীতিক।

সর্বশেষ খবর