শুক্রবার, ৩০ ডিসেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা

সালাম দিয়ে ডাকাতও পরাভূত করা যায়

আল্লামা মাহ্মূদুল হাসান

ওষুধ খারাপ হলে যেমন শরীর খারাপ হয় তেমনি আমল খারাপ হলে তার ক্রিয়াও ভালো হয় না।

ইসলামে সালাম একটি গুরুত্বপূর্ণ বিধান। সালাম ব্যাপকভাবে প্রচলন করার জন্য শরিয়তে নির্দেশ এসেছে। সালাম সহিহ শুদ্ধ ও সুন্দরভাবে দেওয়ার জন্য ট্রেনিং নেওয়া উচিত। আমি একবার গুলশানের এক জায়গায় বয়ান করছিলাম। সেখানে অনেক র‌্যাব ও পুলিশ উপস্থিত হলো। আমি তাদের বললাম, এখানে তো মারামারি, দাঙ্গা-হাঙ্গামার কোনো কারণ ঘটেনি, তাহলে আপনারা কেন এসেছেন? তারা জবাব দিল যে, আমাদের স্যার আমাদেরকে পাঠিয়েছেন আপনার বয়ান শোনার জন্য। আমি এ সুযোগে তাদের বললাম, তাহলে তো ভালোই হয়েছে। আজ অন্তত সহিশুদ্ধ করে সালামটা শিখে যান। আমি আবার তাদের প্রশ্ন করলাম, একটি জিনিস আমাকে বুঝিয়ে বলুন তো, আপনারা যখন কোনো সন্ত্রাসী ধরতে যান তখন ওরা কেন উল্টো আপনাদের আক্রমণ করে? ওরা কেন আপনাদের মারতে চায়? আপনারা কি তাদের কোনো ক্ষতি করেছেন? নাকি তাদের সঙ্গে পূর্ব শত্রুতা আছে? তারা আমার এ প্রশ্নের মনোপুত উত্তর দিতে পারল না। শুধু বলল, তারা তো সন্ত্রাসী, এ কারণেই আমাদের মারতে চায়।

আমি তাদের বললাম, আজ এমন একটি অস্ত্রের কথা জেনে যান যা সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারলে সন্ত্রাসীও আপনাকে মারতে চাইবে না। এ ব্যাপারে আমার জীবনের ঘটে যাওয়া বাস্তব একটি ঘটনা শুনুন। আমি কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর থেকে একবার রাত ৩টার দিকে ঢাকার উদ্দেশে রওনা দিলাম। স্থানীয় লোকেরা এত রাতে রওনা দিতে নিষেধ করেছিল। কারণ ওইদিকের রাস্তাঘাট রাতে চলাচল করার ক্ষেত্রে সুবিধাজনক নয়। আমি তাদের বললাম, আল্লাহ ভরসা। অর্থাৎ তাদের কথা তেমন একটা বিশ্বাস হলো না। গাড়ি চলছে। কিছুদূর আসার পর হঠাৎ টর্চলাইটের আলো গাড়িতে এসে পড়ল। আমার ড্রাইভার বলে উঠল, হুজুর! সামনে বিপদ সংকেত। লাইট মারার অর্থ হলো গাড়ি থামিয়ে সবকিছু রেখে চলে যাও। আমি ড্রাইভারকে বললাম, তাহলে গাড়ি ব্যাক কর। ড্রাইভার বলল, ‘ব্যাক করলে ওরা গুলি চালাবে।’ এখন কী করি? সামনে গেলেও বিপদ, পেছনে গেলেও বিপদ। বুঝতেই পারছেন এখন আমার মনের অবস্থা কোন পর্যায়ে! যারা ধরাধরি-মারামারি করে তাদের তো কোনো ভয় নেই, কিন্তু আমি তো ভয়ে চুপসে গেলাম। একবার হজ থেকে আসার পথে এভাবে আমাকে কয়েকজন ছিনতাইকারী ধরেছিল। আমি সেদিন (রসিকতা করে) তাদের বলেছিলাম, আমার কাছে মিলাদের কিছু টাকা আছে। তারা বলল, মিলাদের টাকা হলে তো আরও ভালো। কারণ তা এক শ ভাগ হালাল। যখন তারা নাছোড় বান্দা তখন আমি বললাম, আমি হজ করে এসেছি সঙ্গে কিছু পানি ও খেজুর ছাড়া আর কিছুই নেই। তারা বলল, ‘তাহলে কিছু খেজুর ও পানি অন্তত দিয়ে যান যাতে আমাদের অভ্যাসটা নষ্ট না হয়।’ শেষ পর্যন্ত তা-ও দিয়ে আসতে হলো।

মানুষ যখন নিরুপায় হয় তখন সে আল্লাহর দিকে ফেরে। কারণ নিরুপায়ের একমাত্র আশ্রয় তো হলেন আল্লাহ। নিরুপায় ব্যক্তি কোনোদিনও নিশ্চিহ্ন হয় না। অসহায় গরিব কোনোদিনও ধ্বংস হয় না। তার কারণ হলো নিরুপায় যদি একমাত্র আল্লাহকে উপায় মনে করে তাহলে আল্লাহ তার পাশে দাঁড়ান। যদিও সে কাফের, মুশরিক বা হায়ান জানোয়ার হোক। সব সৃষ্টিরই স্রষ্টা একমাত্র আল্লাহ, তিনি ছাড়া নিরুপায়ের পাশে আর কে দাঁড়াবে! পবিত্র কোরআনে এসেছে- কোনো ব্যক্তি যখন নিরুপায় হয়ে আল্লাহর আশ্রয় গ্রহণ করে তখন আল্লাহতায়ালা তাকে তার আশ্রয়ে নিয়ে নেন। যারা দুর্বল হয় তাদের গুলি করা হয় না। তাদের ঘরে চোর-ডাকাত প্রবেশ করে না। কারণ তারা তো সম্পদহীন। ওদের দেখলেই তো মনের মাঝে মায়া-মমতা উদয় হয়, ভালোবাসতে মনে চায়। আর এটা মানুষের অন্তরে আল্লাহপাক স্বভাবগতভাবে রেখে দিয়েছেন। যাই হোক, এ করুণ মুহূর্তে আমার রসুলে কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদিস মনে হয়ে গেল যে, সঠিক-সুন্দর ও শুদ্ধভাবে সালাম দিলে বিপদাপদ দূর হয়ে যায়। যার কর্ণকুহরে সঠিক সালাম পৌঁছবে তার অন্তর নরম হয়ে যায়; শত্রু হলে মিত্রতে পরিণত হয়। যার সঙ্গে যার শত্রুতা সে যদি সব সময় তাকে সহিহভাবে সালাম দিতে পারে তাহলে একদিন ওই শত্রু বন্ধুতে পরিণত হবে, অপরের কাছে নিন্দা-সমালোচনার পরিবর্তে সুনাম করতে শুরু করবে। ইমাম সাহেব যদি আগে আগে মুসল্লিদের সালাম দিতে শুরু করে তাহলে দেখবেন মুসল্লিরা ইমাম সাহেবের খুব প্রিয় হয়ে যাবে। তারা বলবে, আমাদের ইমাম সাহেব খুব ভালো মানুষ। তিনি আগে আগে সালাম দেন। তার মাঝে কোনো প্রকার অহংকার নেই।

যাই হোক সেদিন আমার সঙ্গে আরও কয়েকজন ছিল। আমি ছিলাম সামনের সিটে, তারা ছিল পেছনের সিটে। ড্রাইভারকে বললাম, সামনে চল, যা হওয়ার হবে, চিন্তা করে লাভ নেই। এদিকে সবাইকে শিক্ষা দিলাম যে, যেইমাত্র আমাদের গাড়ি দাঁড় করাবে আমি তখন সর্বপ্রথম উচ্চ আওয়াজে সালাম দেব এরপর তোমরাও আমার সঙ্গে সঙ্গে সালাম দেবে। ডাকাত দল গাড়ি দাঁড় করালে পরিকল্পনামাফিক কাজ করলাম। ওরা আমাদের জিজ্ঞেস করল, হুজুর! কোন জায়গা থেকে এসেছেন? আমি বললাম, বাজিতপুর থেকে এসেছি। তখন বিনয়ী কণ্ঠে ওরা বলল, হুজুর! ক্ষমা করবেন এবং দোয়া করবেন। আমি মনে মনে বললাম, শতবার দোয়া করব। ক্ষমা কীসের? তোমরা তো কোনো অপরাধই করনি।

লেখক : আমির, আল হাইআতুল উলয়া ও বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ।

সর্বশেষ খবর