আমাদের দেশে একটি প্রচলন আছে, কারও দ্বারা কোনো অপরাধ হয়ে গেলে বলা হয়, তুমি ক্ষমা চাও। তখন অপরাধী বলে, ‘মাফ চাইলাম, মাফ করে দিন।’ প্রকৃতপক্ষে এভাবে মাফ চাওয়া হয় না। এটা শুধু মুখে বলা হলো, কাজে পরিণত হলো না। যে কাজের জন্য অসন্তুষ্টি প্রকাশ করা হলো তার জন্য মুখে বলতে হবে ‘ক্ষমা চাই’ এবং কাজেও দেখাতে হবে, অর্থাৎ অপরাধের কাজ ছেড়ে দিতে হবে, তাহলেই প্রকৃত ক্ষমা চাওয়া হবে। তদ্রƒপ শুধু চিঠিপত্রে ক্ষমা চেয়ে অপরাধ আগের মতো করে যাওয়াতেও মাফ চাওয়া হবে না। হজরত ওমর ফারুক (রা.) মুখে ক্ষমা চেয়েছেন, আর কোনো দিন প্রশ্ন করব না। কাজেও তা প্রকাশ করেছেন। ফলে হজরত ওমরের প্রতি রসুল (সা.) খুশি হয়েছেন।
ক্ষমা চাওয়া ও তওবা করার তরিকা আছে। তওবা করার অর্থ হলো, আল্লাহর অভিমুখী হওয়া এবং গাইরুল্লাহ থেকে বিমুখ হওয়া। কোরআনে কারিমে ইরশাদ হয়েছে, যে ব্যক্তি আল্লাহর দিকে তওবা করে আল্লাহও তার দিকে ধাবিত হন। এর অর্থ হলো, যে ব্যক্তি আল্লাহর দিকে ফিরে আসে আল্লাহও তার দিকে ফিরে তাকায়। অর্থাৎ কথা ও কাজে তওবা হতে হবে। যদি বলি, হে আল্লাহ! আমি গিবত করেছি, তাই গিবত থেকে তওবা করছি, আমি নামাজ তরক করে অপরাধ করেছি সেজন্য আমি তওবা করছি। কিন্তু সম্পূর্ণ গিবত পরিত্যাগ করলাম না, যার গিবত করেছি তার কাছে ক্ষমা চাইলাম না, তদ্রƒপ কাজা নামাজসমূহ আদায় করা শুরু করলাম না এবং ওয়াক্তিয়া নামাজ পাবন্দির সঙ্গে পড়লাম না, তাহলে এটা তওবা হলো না। তওবা বলা হয়, অন্যায়ভাবে কারও ১০০ টাকা নেওয়ার পর তার টাকা তাকে ফেরত দিয়ে বলা যে, ভাই, আমি অন্যায়ভাবে আপনার ১০০ টাকা নিয়েছিলাম এই নেন, আপনার টাকা ফেরত দিলাম, এ হলো কামেল ও পরিপূর্ণ তওবা। শুধু মুখে মুখে তওবা করে লাভ নেই। কথা ও কাজে সমান তওবা করতে হবে। কথা ও কাজে তওবার মিল হলে এটাকে তওবায়ে নাছুহা তথা খালেছ তওবা বলা হয়। এ তওবা কেউ করলে সে সদ্য ভূমিষ্ঠ সন্তানের মতো নিষ্পাপ হয়ে যায়। আমি চিন্তা করে দেখেছি, পৃথিবীতে সবচেয়ে কঠিন কাজ যা আছে তন্মধ্যে অন্যতম হলো তওবা। তওবার অর্থ হলো, যার হক তার কাছে পৌঁছে দেওয়া। শুধু মুখে মুখে তওবা করলে তওবা হবে না। অপরাধ করার পর মুখে মুখে তওবা করলে যদি তওবা হয়ে যেত তাহলে চোর চুরি করবে আর মুখে তওবা করে নেবে। এতে তো গুনাহের প্রতি আরও উদ্বুদ্ধ করা হবে। ইমাম গাজ্জালি (রহ.) বলেছেন, তওবার হাকিকত হলো, ‘লজ্জিত হওয়া’ পিতা যদি দেখেন, সন্তান জিনা করছে তখন সে যেমন লজ্জিত হয়, তেমন লজ্জিত হওয়া। তদ্রƒপ ভবিষ্যতে এ ধরনের অপরাধ না করার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হওয়া, বান্দার হক থাকলে আদায় করে দেওয়া। তওবা করার পর খেয়াল রাখতে হবে যে, আর কোনো দিন এ অপরাধের যেন পুনঃপ্রকাশ না ঘটে।
যা হোক শুরুতে আলোচনা চলছিল, নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উম্মতের জন্য তথা ভয় প্রদর্শনকারী। তিনি কল্যাণকামী ভয় প্রদর্শনকারী। সাপ ও শত্রুর মতো নয়। কোরআনে কারিমের এক আয়াতে আল্লাহপাক তাঁর নবীকে লক্ষ্য করে নির্দেশ দিয়েছেন, হে নবী! তুমি তোমার উম্মতকে তাদের কল্যাণের জন্য ভয় প্রদর্শন কর নিকটতম দিনের, যে দিনটি তাদের সামনে অবশ্যই আসবে। উদ্দেশ্য হলো কেয়ামতের দিন এবং হাশরের বিচারের দিন। অর্থাৎ হাশরের বিচারের দিনের ভালোমন্দ ও ভয়াবহতার ব্যাপারে উম্মতকে ভয় প্রদর্শন কর, যাতে তারা সেদিন আশঙ্কামুক্ত থাকার জন্য দুনিয়ায় থাকা অবস্থায়ই ট্রেনিং গ্রহণ করে।
ভয়াবহ অবস্থার প্রতি ইঙ্গিত করে আল্লাহপাক বলেন, ‘সেদিন ভয়-ও কষ্টের চোটে মানুষের আত্মা গলার কাছে এসে যাবে।’ যেমন প্রচণ্ড গরমের সময় কুকুরের জিহ্বা বের হয়ে আসে। উল্লিখিত আয়াতে (আলকুলুব) শব্দের দ্বারা কাফের-ফাসেকদের কুলুব উদ্দেশ্য। আল্লাহর ওলিদের কষ্ট হবে তবে এমন কষ্ট নয়। যারাই হাশরের মাঠে থাকবে তারা ভয় পাবে, আতঙ্কিত হবে। নবীগণও ভয় পাবেন, তারপরও তাঁরা উম্মতদের জন্য সুপারিশ ও শাফায়াত করবেন। তাদের ভয়ের দৃষ্টান্ত হলো, চোখের সামনে চোরকে পেটালে যেমন ভয় লাগে। আর আয়াতে ব্যবহৃত এটা এর বহুবচন। এর অর্থ গলা। আমাদের দেশের লোকমুখে শোনা যায়, দম নাকের ডগায় এসে গেছে। এর দ্বারা বোঝায় মৃত্যুর কাছাকাছি অবস্থায়। তেমনি হাশরের দিন কাফের, ফাসেকদের প্রাণ কষ্ট ও যন্ত্রণায় মুখ দিয়ে বের হওয়ার উপক্রম হবে। পৃথিবীতে সবচেয়ে কষ্টকর ও অসহনীয় যাতনা হলো মহিলাদের সন্তান প্রসবের মুহূর্ত। সে সময় নেহায়েত লাজুক মহিলাও সব ভুলে যান। সন্তান প্রসবের সময় ধাত্রীরা তাকে উলঙ্গ করে বাচ্চা টেনে বের করছে, তার লজ্জাস্থানে হাত দিচ্ছে তবু তার কোনো খবর নেই। কোরআনে কারিমে ইরশাদ হয়েছে, আয়াতে বলা হয়েছে, হাশরের ভয়াবহতা এমন হবে, যদি মহিলা সন্তান প্রসব করতে থাকে তাহলে সে হাশরের ভয়াবহতার কারণে প্রসবের ব্যথা টের পাবে না। তার মানে প্রসবের বেদনার ভয় হাশরের ভয়াবহতার কাছে কিছুই না। ছোট ভয়ের সামনে বড় ভয় এলে ছোট ভয়ের কথা মনে থাকে না।
লেখক : আমির, আল হাইআতুল উলয়া ও বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ