ইরান ইসরায়েলে হামলা চালাবে এমনই ঘোষণা দিয়েছেন সে দেশের সর্বোচ্চ নেতা। ইরানে হামাস নেতা ইসমাইল হানিয়ার হত্যাকান্ডে ইসরায়েল জড়িত এ অভিযোগে তারা প্রস্তুতি নিচ্ছে। প্রশ্ন উঠেছে ইরানের সক্ষমতা নিয়ে। ১৯৭৯ সালে ইমাম খোমেনির নেতৃত্বে ইসলামী বিপ্লবের মাধ্যমে ইরানের বর্তমান একনায়কতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে ইরানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বৈরী সম্পর্কের সূচনা হয়। শাহের পতনের পর বিপ্লবী ছাত্র-জনতার প্রবল যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী মনোভাব, জিম্মি সংকট ও ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে ওই সম্পর্ক তলানিতে চলে যায়। ১৯৮০ সালে ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন হয়। যুক্তরাষ্ট্র ইরানকে বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করতে একের পর এক অবরোধ আরোপ করে। যুক্তরাষ্ট্রের অবরোধ আরোপের ফলে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদেশগুলো থেকে ইরান বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, যা তার অর্থনীতিতে বিরাট প্রভাব ফেলে।
তেলের মজুতের হিসাবে ইরানের অবস্থান বিশ্বে তৃতীয়। বিশ্বের মোট পেট্রোলিয়াম মজুতের প্রায় ১০ ভাগ ইরানে রয়েছে। ইরানে আগামীতে নতুন কোনো তেলের খনি আবিষ্কৃত না হলেও এর মজুত ১৪৫ বছর স্থায়ী হবে। অপরিশোধিত তেলের মজুতের হিসাবে ইরানের অবস্থান কানাডার পর। অবশ্যই কানাডার অপ্রচলিত তেলের মজুত বাদ দিলে ইরানের অবস্থান কানাডার ওপরে সৌদি আরবের পর। মজুত তেলের হিসাবে ইরানের অবস্থান তৃতীয়-চতুর্থ যাই হোক না কেন তেল বিক্রি করে সৌদি আরব যেখানে বিশ্বের অন্যতম ধনী দেশের তালিকায় নাম লিখিয়েছে, সৌদি আরবের জনগণ যখন উন্নত জীবনযাপন করছে সেখানে সৌদি আরবের কাছাকাছি তেলের মজুত থাকা সত্ত্বেও ইরানের জনগণ দারিদ্র্যপীড়িত জীবনযাপন করে। কারণ ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোসহ তেল ক্রয়কারী অধিকাংশ দেশ যুক্তরাষ্ট্রের মিত্ররাষ্ট্র। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের অবরোধের ফলে বৈধ পথে ইরানের পক্ষে তেল ক্রয়কারী দেশের কাছে তেল বিক্রি করা সম্ভব হয় না। তাই ইরানের তেল সম্পদ তার অর্থনৈতিক উন্নয়নে কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারছে না। বিশ্বের অন্যতম তেলসমৃদ্ধ দেশ হওয়া সত্ত্বেও শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবরোধের কারণে ইরানের অর্থনীতি স্বমহিমায় বিকশিত হতে পারেনি। যুক্তরাষ্ট্রের ওই অবরোধ শুধু অর্থনীতির ওপর প্রভাব ফেলেছে তা নয়, ইরানের সব ক্ষেত্রে প্রভাব পড়ছে। ইরান প্রযুক্তিগত উন্নয়নের দাবি করলেও বাস্তবিক পক্ষে তা অনেক ক্ষেত্রে যে ‘ফাঁকা বুলি’ তা সাম্প্রতিক কয়েকটি ঘটনায় প্রমাণিত হয়েছে। ইসরায়েলে তারা কয়েক শ ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন নিক্ষেপ করলেও তা ইসরায়েলের ক্ষতি করা তো দূরের কথা ওইসব ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন ইসরায়েলের আকাশসীমায় পৌঁছাতে পারেনি। যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র ইসরায়েল ইরানের চেয়ে সামরিক অস্ত্রশস্ত্র ও প্রযুক্তিতে যে এগিয়ে আছে তা আবারও প্রমাণিত হয়েছে। এ কথা ঠিক যে, ইরানের নির্মিত ড্রোন সামরিক অস্ত্র হিসেবে বেশ খ্যাতি লাভ করেছে। রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়া ইউক্রেনের বিরুদ্ধে ওই ড্রোন ব্যবহার করে অনেক ক্ষেত্রে সফলতা পেয়েছে। সাম্প্রতিক হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায়ও কার্যকরী ভূমিকা রাখে ইরানি ড্রোন। তুরস্কের উন্নত প্রযুক্তিতে তৈরি ড্রোন দুর্ঘটনায় নিহত রাষ্ট্রপতি রাইসির বিধ্বস্ত হেলিকপ্টার খুঁজে পেতে ব্যর্থ হলেও ইরানের নিজস্ব প্রযুক্তিতে তৈরি ড্রোন রাষ্ট্রপতি রাইসিকে বহনকারী বিধ্বস্ত হেলিকপ্টর খুঁজে পায়। কিন্তু এটি মুদ্রার একপিঠ। অন্যপিঠের চিত্র সুখকর নয়। ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের ড্রোন প্রযুক্তির সঙ্গে তুলনা করলেও ইরানি ওই ড্রোন খুব কার্যকর কোনো অস্ত্র নয়, যা ইসরায়েলের অস্তিত্বকে হুমকিতে ফেলতে পারে। সাম্প্রতিক ইরানের ইসরায়েল হামলায় ওই ড্রোন ব্যবহৃত হলেও তার অধিকাংশ ইসরায়েলের মাটিতে পৌঁছাতে না পারার ঘটনা থেকে তা প্রমাণিতও হয়েছে। ইরানের ড্রোন প্রযুক্তি দেখে মনে হতে পারে যে ইরান এভিয়েশন সেক্টরের বেশ উন্নত দেশ। কিন্তু বাস্তবিক পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের অবরোধের ফলে ইরানের পক্ষে এভিয়েশন সেক্টরে আধুনিক প্রযুক্তি যুক্ত করা সম্ভব হয়নি। ইরান ইসলামী বিপ্লবের পূর্বের শাহের আমলের এভিয়েশন অবকাঠামো ও প্রযুক্তি বিমান উড্ডয়ন ও অবতরণের ক্ষেত্রে ব্যবহার করছে। ফলে প্রতি বছর ইরানে বিমান দুর্ঘটনা ঘটছে। ২০০০ সালে থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ২০০ বিমান দুর্ঘটনা ঘটেছে এবং ওই দুর্ঘটনায় প্রায় ১ হাজার ২০০ মানুষ নিহত হয়েছে। গত বছর (২০২৩) বিমান দুর্ঘটনায় ইরানের ক্রীড়ামন্ত্রী নিহত হন। সামরিক কর্মকর্তাদের বিমান দুর্ঘটনায় নিহত হওয়ার ঘটনা প্রায়ই ঘটে। যুক্তরাষ্ট্রের অবরোধের ফলে ইরানের পক্ষে আধুনিক এভিয়েশন যন্ত্রপাতি এবং রাষ্ট্রপতির চলাচলের জন্য উন্নত নিরাপদ আকাশ বাহন সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি। ফলে ইরানের দুর্ঘটনায় নিহত রাষ্ট্রপতি রাইসিকে যাতায়াতের জন্য একটি ৪৫ বছরের পুরনো মার্কিন হেলিকপ্টার ব্যবহার করতে হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র নির্মিত ওই হেলিকপ্টারটি ইসলামী বিপ্লবের আগে যুক্তরাষ্ট্র ইরানের শাহকে উপহার হিসেবে দেয়। ইসলামী বিপ্লবের সময় বিপ্লবীরা তা দখল করে এবং পরবর্তীকালে তা ইরানের সেনাবাহিনীতে যুক্ত হয়। সেনাবাহিনী ওই হেলিকপ্টারটি রাষ্ট্রপতির বহরে যুক্ত করে। ইরানের কাছে থাকা হেলিকপ্টারগুলোর মধ্যে এটিই সব থেকে নিরাপদ বাহন ছিল। ইরান প্রযুক্তিগত উন্নয়নের দাবি করলেও নিজের দেশের রাষ্ট্রপতির নিরাপত্তার জন্য একটি আধুনিক নিরাপদ নিজস্ব হেলিকপ্টার তৈরি করতে পারেনি। যুক্তরাষ্ট্রের অবরোধের কারণে ইরানের পক্ষে বাইরে থেকে আধুনিক ও নিরাপদ হেলিকপ্টার ক্রয় করাও সম্ভব হয়নি। ফলে যুক্তরাষ্ট্র নির্মিত একটি পুুরাতন হেলিকপ্টারেই ইরানের রাষ্ট্রপতি রাইসিকে ভ্রমণ করতে হয়েছে। এ ঘটনা থেকেও ইরানের এভিয়েশন খাতে যুক্তরাষ্ট্রের অবরোধের নেতিবাচক প্রভাব স্পষ্ট হয়।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়