নায়করাজ রাজ্জাকের জন্ম ১৯৪২ সালের ২৩ জানুয়ারি কলকাতার টালিগঞ্জের নাকতলায়। স্কুল জীবন থেকেই নাটকে অভিনয়ের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তিনি। ফুটবল খেলতেও ভীষণ ভালোবাসতেন। স্বপ্ন ছিল খ্যাতিমান ফুটবলার হওয়ার। কিন্তু হয়ে গেলেন চলচ্চিত্রের নায়ক। আজ বাংলাদেশের এই কিংবদন্তি চলচ্চিত্রকার নায়করাজ রাজ্জাকের প্রয়াণ দিবস। ২০১৭ সালের এই দিনে তাঁর মহা প্রস্থান ঘটে। চলচ্চিত্রের পাশাপাশি নায়করাজের ছিল একটি সফল সংসার জীবন। আর এ জন্যই বোধ হয় তিনি পরম সুখে গেয়ে উঠেছিলেন, ‘আমার মত এত সুখী নয়তো কারো জীবন’। স্ত্রী লক্ষ্মী, পুত্র বাপ্পারাজ, বাপ্পী, সম্রাট, কন্যা শম্পা ও ময়নাকে নিয়ে ছিল তার সাজানো বাগানের মতো সুন্দর সংসার। শম্পা অবশ্য অকালে মারা যান। আর এটিই ছিল রাজ্জাকের জীবনের একমাত্র দুঃখ। রাজ্জাক ১৯৬২ সালে বিয়ে করেন খায়রুন নেসা লক্ষ্মীকে। টালিগঞ্জে রাজ্জাকের এক আত্মীয়ের বাড়ির পাশেই ছিল লক্ষ্মীদের বাড়ি। সেই আত্মীয়দের একজন লক্ষ্মীকে বাড়ির সামনে দেখে পছন্দ করে এবং বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যায়। ১৯৬০ সালে রাজ্জাক আর লক্ষ্মীর আংটিবদল হয়। এর দুই বছর পর তাঁদের বিয়ে হয়। তখন লক্ষ্মীর বয়স ছিল মাত্র ১৪ বছর আর রাজ্জাকের ২০। স্বামী নায়ক রাজ্জাক ও নিজের প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে খায়রুন্নেসা লক্ষ্মী জানান, আমার নাম লক্ষ্মী হওয়াতে অনেকেই আমাকে হিন্দু মনে করত। আমার পুরো নাম খায়রুন্নেসা। আমার আব্বা আমাকে আদর করে ডাকতেন ‘লক্ষ্মী’ বলে।
১৯৬৪ সালের ২৫ এপ্রিল কলকাতায় হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা শুরু হলে ওই রাতে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে এক হিন্দু পরিবারের বাড়িতে পরিবারসহ আশ্রয় নেন রাজ্জাক। পরের দিন ২৬ এপ্রিল ঢাকায় চলে আসেন। তাঁর সঙ্গে ছিল স্ত্রী লক্ষ্মী ও আট মাসের পুত্র বাপ্পারাজ। এরপর শুরু হয় রাজ্জাকের জীবন ও জীবিকার তাগিদে ভয়ংকর যুদ্ধ। আর এ যুদ্ধে তাঁকে অনবরত সাহস জুগিয়ে চলেন স্ত্রী লক্ষ্মী। তাই নায়করাজ সবসময়ই বলতেন, ‘লক্ষ্মী সত্যিই একজন লক্ষ্মী। তাঁর উৎসাহ আর সহযোগিতায় আমি নায়করাজ হতে পেরেছি’। রাজ্জাক বছরজুড়ে থাকতেন অভিনয়ে ব্যস্ত। আর তাঁর সংসার ও সন্তানদের পরিপাটি ও সফলভাবে গড়ে তুলেছিলেন লক্ষ্মী। প্রবাদ আছে সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে। রাজ্জাক বলতেন, এই প্রবাদটি তাঁর বেলায় শতভাগ সত্যি হয়েছিল। স্বামী রাজ্জাকের এমন প্রশংসার বিপরীতে স্ত্রী লক্ষ্মীর অনুতূতি কেমন?
এমন প্রশ্নে তাঁর সহজসরল জবাব, ছবিতে অভিনয় করার আগে ও আমাকে প্রায়ই বলত, চলচ্চিত্রে কাজ করতে গেলে অনেক মেয়ের সঙ্গে মিশতে হবে, অভিনয় করতে হবে, তখন তুমি কিছু মনে করবে না তো? আমি বলেছিলাম, না, কিছুই মনে করব না। তুমি কাজ শুরু কর।’ সে বলল, সংসারের এত ঝামেলা, আমি ব্যস্ত হয়ে গেলে তুমি এসব কীভাবে সামলাবে? আমি বললাম, এসব নিয়ে তুমি কিছু ভেব না।’ যখন ফার্মগেটে হলিক্রসের সামনে আমরা থাকতাম। তখন অনেক মেয়ে বাড়িতে আসত ওর সঙ্গে দেখা করত অটোগ্রাফ নিতে। দেখতাম, ভক্তরা ওর কাপড় ছুঁয়ে দেখছে, জুতা ছুঁয়ে দেখছে। তাঁকে জড়িয়ে ধরছে। কিছুই বলতাম না। আমি কখনোই তাঁর কোনো কিছুতেই বাধা দিতাম না; বরং তাঁকে সাহস দিতাম। স্বাধীনতার আগে তিনি গুলশানের এই জায়গা কিনলেন। নিজেদের বাড়ি লক্ষ্মীকুঞ্জে উঠলাম। খায়রুন্নেসা লক্ষ্মী বলেন, ও যখন সারা দিন খাটাখাটনি করে ঘরে ঢুকেই ‘লক্ষ্মী’ বলে ডাকত, তখন খুব ভালো লাগত। জিজ্ঞাসা করতাম নাশতা খাবে কি না? কখনো রেগে কথা বললেও সে খুবই শান্তভাবে কথা বলত। এসব খুব ভালো লাগত। আমাদের মধ্যে তেমন মান-অভিমান হতো না বলতে পারেন। ছেলের বউ, নাতি-নাতনিদের নিয়ে আল্লাহর রহমতে সুখে-শান্তিতে ছিলাম আমরা। ও এই পৃথিবীতে এখন আর নেই। কিন্তু ওর আদর্শের পথে আমাদের সন্তানরা এখনো এগিয়ে যাচ্ছে। কারণ রাজ্জাক ছিলেন একজন আদর্শ পিতা ও স্বামী। তাঁর কাছে কাজের পাশাপাশি সংসারই ছিল সব। মাঝে মধ্যে ওর সঙ্গে মার্কেটে যেতাম, তখন ওর জনপ্রিয়তা তুঙ্গে। মার্কেটে গেলে দেখতাম ওর অসংখ্য ভক্ত ওকে ঘিরে ধরেছে। আমি ছেলেমেয়ে নিয়ে তখন দীর্ঘ সময় দূরে দাঁড়িয়ে থাকতাম। ছেলেমেয়েরা প্রায়ই বলত, আব্বুর সঙ্গে আর মার্কেটে যাব না। ও আমার হাতের গুঁড়ো মাছ, করলা, গরুর ভুনা মাংস খেতে খুব পছন্দ করত। আজ এসব শুধুই স্মৃতি। সন্তান ও নাতি-নাতনিরা আমাকে কোনো দুঃখ কষ্ট বুঝতে দেয় না। ওদের নিয়ে আমি ভালো আছি। স্বামী রাজ্জাক চলে গেছে, রেখে গেছে সুন্দর গোছানো একটি সংসার। সবাই ওর আত্মার শান্তির জন্য দোয়া করবেন।