শক্তিমান অভিনেতা তারিক আনাম খান, বাংলাদেশের অভিনয়ের এক চিরসবুজ গাছ, যিনি প্রতিটি চরিত্রে নিজস্ব গন্ধ মিশিয়ে দর্শকের মন জয় করেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধে রণাঙ্গনের সৈনিক; ভারতের এন এস ডির ছাত্রও ছিলেন। আর বারো রকম মানুষ নাটকের সংলাপ ‘থামলে ভালো লাগে?’-এক কথায়, এ যেন তারিক আনামের হাতে চা-কফি না, বরং সমাজের ‘বারো রকম’ মানুষের এক পেয়ালা অভিজ্ঞতা!
১৯৮০-এর দশকে বিটিভিতে প্রচারিত একটি জনপ্রিয় ধারাবাহিক নাটকের নাম ‘বারো রকমের মানুষ’ যেটি ইমদাদুল হক মিলন রচিত। এ নাটকে তারিক আনাম খান যে সংলাপটি বলেছেন, তা ইতোমধ্যে মিম, ভিডিও ক্লিপ এবং দর্শকদের জীবনের দর্শনে পরিণত হয়েছে।
‘বারো রকমের মানুষ দেখি আমি... একেকটা মানুষ একেক রকম, সবাইরে চেনা যায়, ধরা যায়, ধরা যায় না’-এই একটাই লাইন যেন বাংলাদেশের নাগরিক জীবনের ‘মানবজীবন ভিজুয়াল গাইড’। তারিক আনামের স্বভাবসিদ্ধ ছন্দে উচ্চারিত সংলাপটি এতটাই জনপ্রিয় হয়েছে যে, অনেকেই এটিকে জীবনের দর্শন হিসেবে কোট করছেন।
তারিক আনাম খান বারবার প্রমাণ করেছেন যে, একজন অভিনেতার আসল শক্তি চরিত্রকে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলা। ‘থামলে ভালো লাগে’- নাটকে তার চরিত্র যেন ঢাকা শহরের কোনো এক পুরোনো চায়ের দোকানের মনু ভাই, যিনি কথা কম বলেন, কিন্তু চোখ দিয়ে সব বুঝে ফেলেন। বারো রকমের মানুষ নিয়ে তারিক আনাম খান বলেন, ‘এ নাটকের প্রতিটি চরিত্র আমাদের চারপাশে দেখা যায়। কেউ অফিসপাড়ার ধূর্ত বস, কেউ রিকশাচালক, কেউ ফেসবুকবাজ কবি। আমি যখন এ সংলাপ দিচ্ছিলাম, মনে হচ্ছিল, আমি নিজেই সব চরিত্রের এক একজন।’ তারিক আনাম তার জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে বলেন, ‘একবার এক দর্শক রাস্তায় এসে বললেন, ‘স্যার, আমি হয়তো ১৩ নম্বর মানুষ। নাটকে আমার টাইপটা মিস হয়ে গেছে!’ আমি হেসে ফেলেছিলাম। মানুষ এখন এ নাটকের মাধ্যমে নিজেকে চিনছে, সেটাই তো বড় পাওয়া।’ এভাবেই নাটকটি সমাজের আয়না হয়ে উঠেছে, যেখানে সবাই নিজের ছায়া খুঁজে পায়, হয়তো একটু মোটা করে আঁকা, হয়তো একটু রং চড়িয়ে। একটা সময়ে তার অভিনীত নাটকের অনেক সংলাপ মানুষের মুখে মুখে ফিরত।
তিনি সেসব নিয়ে বলেন, “ঠিকই বলেছেন। একটা সময়ে নাটকের সংলাপ খুব করে মানুষের মুখে মুখে ফিরত। বারো রকম মানুষ নাটকে আমার মুখ দিয়ে একটি সংলাপ দেওয়া হতো-থামলে ভালো লাগে। ওই সময়ে এবং আরও অনেক বছর এটি মানুষ বলত। ‘তথাপি’ নামের একটি নাটকে লাট ভাই চরিত্রে অভিনয় করেছিলাম। সেই সময় লাট ভাই আসছে এই কথাটি খুব করে বলা হতো। এরপর ‘সংশপ্তক’ নাটকে একটি সংলাপ ছিল- আমি আবার আসব। এটিও বেশ বলত মানুষজন। ওই স্মৃতিগুলো মনে পড়লে ভালোই লাগে।’’ তারিক আনামের ক্যারিয়ারজুড়ে রয়েছে অসংখ্য জীবনঘনিষ্ঠ সংলাপ। এর মধ্যে কিছু এখনো দর্শকদের মনে গেঁথে আছে, ‘এই সমাজে বুদ্ধিমান হওয়া একটা বিপদ।’ বা ‘মানুষ বদলায় না, শুধু মুখোশ বদলায়।’ অথবা ‘অভিনয়টা এখন পেশা নয়, যুদ্ধ।’ এ সংলাপগুলো শুধু নাটকের সংলাপ নয়, বরং সময়ের দলিল। তার কণ্ঠে এ কথাগুলো শুধু বলা হয় না, বরং আমাদের শোনানো হয়, মন দিয়ে, মগজ দিয়ে, হৃদয় দিয়ে।
বারো রকম নাটকের সংলাপ ‘থামলে ভালো লাগে’ হলেও কিন্তু তারিক আনাম থামছেন না। বয়সের ভার নয়, অভিজ্ঞতার ছাপ তাকে আরও প্রাণবন্ত করে তুলেছে। তিনি শুধু চরিত্র করেন না, চরিত্র সৃষ্টি করেন। সেই সৃষ্টি থেকেই উঠে আসে আমাদের চেনা মানুষ, চেনা হাসি, চেনা কান্না।