'ইত্যাদি' কি জনপ্রিয়, নাকি হৃদয়প্রিয়?
মানুষের হৃদয়কে স্পর্শ করে বলেই 'ইত্যাদি' জনপ্রিয়।
আপনাকে 'ইত্যাদি'র প্রাণভোমরা বলা হয়। 'প্রাণভোমরা' বিষয়টি আপনি কীভাবে উপভোগ করেন?
'প্রাণভোমরা' শব্দটি রূপকথার। এটির অবস্থান রূপকথার গল্পে সমুদ্রের তলদেশে কোনো একটি কৌটার ভেতরে। কিন্তু আমাদের অবস্থান তো কৌটার মধ্যে নয়, মানুষের মধ্যে। আর আমরা কাজ করি একটি দায়বোধের জায়গা থেকে। কখনোই খ্যাতি, মূল্যায়ন, স্বীকৃতি বা অর্থের লোভে নয়।
কিন্তু মানুষ যে প্রশংসা করছে, মূল্যায়ন করছে সেটা তো আনন্দের।
অবশ্যই আনন্দের। তবে এ চিন্তায় অনুষ্ঠান করি না। মূল্যায়নের চিন্তা করলে প্রতি বছর 'ইত্যাদি'র পূর্তি অনুষ্ঠান করে, কিছু বিশিষ্ট ব্যক্তি ডেকে অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তাদের সার্টিফিকেট নিতাম, যা প্রায়শই দেখা যায়। স্বীকৃতির লোভে করলে অনেক জায়গা থেকে পুরস্কার নিতে পারতাম। আমি বরং একটি প্রথম শ্রেণির জাতীয় দৈনিকের দর্শক জরিপের পুরস্কার একনাগাড়ে বেশ কবছর পাওয়ার পর বিনয়ের সঙ্গে অনুরোধ জানিয়েছি, যাতে আমাকে আর দেওয়া না হয়। আর অর্থের লোভে করলে এত কম অনুষ্ঠান না করে প্রতিদিনই বিভিন্ন চ্যানেলে ফাগুন অডিও ভিশনের অনুষ্ঠান করতে পারতাম। আসলে আমার প্রশংসাপত্র দেন দর্শকরা। তাদের ভালোবাসার সুবাদেই 'ইত্যাদি' করছি- করতে পারছি। আর এতেই আমার আনন্দ।
'ইত্যাদি' দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়েছে। কিন্তু সেই পথ কতটা মসৃণ ছিল?
কোনো পথই কুসুমাস্তীর্ণ থাকে না। কিন্তু দৃঢ় মনোবল, প্রত্যয়, আন্তরিকতা এবং মেধা থাকলে যে কোনো পথই অতিক্রম করা যায়। 'ইত্যাদি' হয়তো তারই প্রতীক।
কত শত অনুষ্ঠান। কিন্তু 'ইত্যাদি'ই কেন যুগ যুগ ধরে অদ্বিতীয়?
এ প্রশ্নের উত্তর দর্শক এবং আপনারাই ভালো দিতে পারবেন। আমাদের চিন্তা দর্শক হৃদয়ে কীভাবে স্থান পাওয়া যায়। দর্শকদের প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধাবোধ রেখে তাদের মনমানসিকতা বুঝে সময়কে ধরে এগোতে চেষ্টা করি। সংখ্যার চেয়ে মানকে গুরুত্ব দিই। আর দর্শকরা সময় বের করে আমাদের অনুষ্ঠান দেখতে বসেন। আমিও তাদের সেই সময়ের মূল্য দিতে চেষ্টা করি।
আজকাল কারও মধ্যে ভালো অনুষ্ঠান করার চেষ্টা লক্ষ্য করা যায় না। তারপরও বলে, 'ফাটিয়ে দিয়েছি...'।
ফেটে গেলে থাকে কি? অনুষ্ঠান কি ফাটার জিনিস? অবশ্য আজকাল অনেককে দেখি নিজের ঢোল নিজেরাই পেটান। টিভি স্ক্রল থেকে শুরু করে সংবাদে পর্যন্ত। সুতরাং দর্শক কি বলল তাতে তাদের কিছু যায় আসে না।
দেশে আরও অনেক ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান হয়েছে। এখনো হচ্ছে, ভবিষ্যতেও হবে। কিন্তু দ্বিতীয় কোনো অনুষ্ঠানই দাঁড়াতে পারছে না। ব্যর্থতা কোথায়?
দীর্ঘদিন ধরে অনুষ্ঠানে বিষয়-বৈচিত্র্য ধরে রাখা বা নতুনত্বের সন্ধান দেওয়া এবং ম্যাগাজিন শব্দের সঠিক অর্থ অনুধাবনের ওপরই এর সফলতা বা ব্যর্থতা নির্ভর করে। মনে রাখতে হবে ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান বিচিত্রানুষ্ঠান নয়। একটি ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান করা অত্যন্ত জটিল এবং ব্যয়বহুল। যে কারণে হাজারো অনুষ্ঠান হচ্ছে কিন্তু ম্যাগাজিন নেই। দুই-একটি আছে যেগুলোকে ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান বলা হলেও আসলে তা ম্যাগাজিন নয়, বিচিত্রানুষ্ঠান। সত্যিকার অর্থে 'ইত্যাদি'র আগে এ দেশে ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান করেছেন শ্রদ্ধেয় ফজলে লোহানী। যার অনুষ্ঠানে একটি কমিটমেন্ট থাকত।
বর্তমান যুগে তারকা হওয়া সবচেয়ে সহজ। এ কেমন পদ্ধতির প্রচলন?
চ্যানেলের এই ঘনঘটার যুগে, হুজুগে নানারকম সুযোগে, কে অজ্ঞ কে যোগ্য, কি ন্যায্য কি ত্যাজ্য; তা নির্ণয় করা কঠিন। তারকা এবং হাউইবাজির পার্থক্য যারা বোঝে না, তারাই যে কাউকে তারকা বলে থাকেন। কিন্তু সত্য হচ্ছে তারকা অনন্তকাল ধরেই জ্বলে আর হাউইবাজি আকাশে উঠে ঠিকই কিন্তু যখন ঝরে পড়ে তখন তার ছাই ছাড়া কিছুই অবশিষ্ট থাকে না।
সংগীত, নাটক, চলচ্চিত্র- তিন মাধ্যমেই সবাই নিজেদের পেশাদার বলে। কিন্তু সেটা মুখে-মুখেই, কাজে দেখা যায় না। কোন দিকে যাচ্ছি আমরা?
পেশা শব্দটি ব্যবহার করে যখন অর্থ উপার্জনই মুখ্য হয়ে ওঠে, তখন পেশা শব্দটি তার গুরুত্ব হারিয়ে ফেলে। কাজের প্রতি ভালোবাসার অভাবে সে আর সঠিক পথে থাকে না, দিক হারিয়ে ফেলে। আমাদের এখানেও সেটাই হচ্ছে।
আমাদের টিভি চ্যানেল দিন দিন দর্শক হারাচ্ছে। আপনার কি মনে হয়, পচন কোথায় ধরেছে?
অর্থ এবং অনর্থের মধ্যে। সৃজনশীলতার চেয়ে এখন এটা ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। চ্যানেল কর্তৃপক্ষ থেকে শুরু করে বেশির ভাগ শিল্পী, নির্মাতার মধ্যেই 'কি দিলাম এর চাইতে কি পেলাম'র হিসাবটা বেশি। ফলে সংস্কৃতি তার আসল উপাদান হারিয়ে ফেলছে। অর্থের কারণে অনর্থের ছড়াছড়ি। পাশাপাশি কিছু বিত্তবান চ্যানেল কর্তার বিনোদন রুচি এবং দর্শকদের তা গেলানোর চেষ্টা এবং সব কিছুতেই ব্যবসায়িক চিন্তা করাটাই পচনের অন্যতম কারণ। ব্যবসা আর শিল্পরুচি এক জিনিস নয়।
ভারতে আমাদের চ্যানেল নেই। কিন্তু আমাদের এখানে ভারতীয় চ্যানেলের অবাধ প্রদর্শন। এই অসম বিষয়টি কীভাবে দেখেন?
ঘৃণার চোখে দেখি। মজার ব্যাপার হচ্ছে, আমাদের দেশে টেলিভিশন মালিকদের একটি সমিতি হয়েছে। প্রায়ই টেলিভিশনে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে তাদের মিটিং করতে দেখি কিন্তু ভারতে আমাদের চ্যানেল প্রদর্শনের ব্যাপারে কেন যে তারা কার্যকরী পদক্ষেপ নিচ্ছেন না তা বোধগম্য নয়। আমাদের চ্যানেল ওখানে দেখা না গেলেও আমাদের এখানে ভারতীয় চ্যানেলের অবাধ যাত্রার কারণে দেশীয় চ্যানেল বাদ দিয়ে অনেকেই এখন সেসব চ্যানেলের অনুষ্ঠান নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। আর এর ফলে আমাদের সমাজে কি ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়ে তা আমরা গত ঈদের অনুষ্ঠানে দেখিয়েছি। শুধু তাই নয়, আমাদের এখানে কিছু কিছু চ্যানেল ওখানকার সিরিয়ালও চালিয়েছে, কেউ কেউ ওখানকার শিল্পীদের এনে লাইভ অনুষ্ঠান করছেন। ইদানীং ওইসব শিল্পীর অ্যালবাম রিলিজও শুরু হয়েছে। আর কিছু কিছু পত্রিকা সেগুলোর কাভারেজ দিতে পেরে আনন্দিত হয়। ওখানে কবে কোন নায়িকার এনগেজমেন্ট, কে বিয়ের বাজার করছে এসব সংবাদও বেশ গুরুত্বের সঙ্গে ছাপা হয়। ওসব চ্যানেলের দর্শক বৃদ্ধির কারণে আমাদের দেশের অনেক বিজ্ঞাপনও চলে যাচ্ছে সেখানে। অর্থাৎ সবদিক দিয়েই ক্ষতি। তারপরও এ নিয়ে কাউকে সোচ্চার হতে দেখি না। বরং ওখানে গিয়ে কিছু নাম না জানা প্রতিষ্ঠানের পুরস্কার পেয়ে অনেকে নিজেকে ধন্য মনে করেন। নিজেদের চ্যানেলে আবার ফলাও করে এই পুরস্কার প্রাপ্তির খবরও প্রচার করেন। সুতরাং সবকিছু মিলিয়ে ঘৃণা প্রকাশ করা ছাড়া কিছু করার নেই।
আর কলকাতার সঙ্গে আমাদের চলচ্চিত্র লেনদেন?
আমার বিবেচনায় অপ্রয়োজনীয়।
লেনদেন বিষয়টাও তো অসম। আমাদের এখানে কলকাতার টিভি চ্যানেলগুলোর দেব-জিৎ-কোয়েল মলি্লককে সবাই চেনে। কিন্তু কলকাতায় আমাদের শাকিব-শাবনূরদের কেউ চেনে না।
আমাদের দেশের কিছু অর্বাচীনের কারণেই এসব হচ্ছে। এদের সবাই চেনে এবং জানে। তারপরও কেউ যে কেন প্রতিবাদ করছে না...। আর যেসব শিল্পীর নাম বললেন এদের চেনার কারণ, কিছু নির্দিষ্ট চ্যানেল এবং পত্রপত্রিকার অতিমাত্রায় প্রচারণা। যে প্রচারণাটা ওখানে আমাদের শিল্পীদের করা হয় না। বরং পত্রিকায় ছবি ছাপা নিয়ে আমাদের শিল্পীরা ওখানে অনেক অপমানিতও হয়েছেন- সে খবরও এখানকার পত্রিকায় পড়লাম।আমাদের রাজনীতি, সমাজনীতি এবং সংস্কৃতি- রাষ্ট্রের এই তিন স্তম্ভের চর্চা নিয়ে মানুষ উদ্বিগ্ন। উদ্বেগ আমারও। আমাদের এখানে অনেক যোগ্য জায়গায় যোগ্য লোকের অভাব। সেই কারণেই উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা।
আজকাল অনেককেই দেখি সংখ্যাতত্ত্বে চলে গেছেন। কে কত শিল্পী জোগাড় করতে পারলেন।
এর জন্য দায়ী আমি। নিশ্চয়ই মনে আছে একুশে টিভির উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আমরা পাঁচ হাজার কণ্ঠে উদ্বোধনী সংগীতটি পরিবেশন করেছিলাম। এনটিভির উদ্বোধনী অনুষ্ঠানেও অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা ছিল প্রায় পাঁচ হাজার। আবার হাজার শিল্পীর নৃত্য, শতাধিক বিদেশির নৃত্য- এসব ইত্যাদিতে হরহামেশাই হচ্ছে। এ নিয়ে বাগাড়ম্বরে আমরা বিশ্বাসী নই। ইত্যাদিতে প্রতি ঈদেই রমজানের গানটি ৫ থেকে ১০ হাজার অংশগ্রহণকারীর কণ্ঠে গাওয়া হয়। তবে তা শুদ্ধ সুরে থাকে। শত শত লোক জোগাড় করে তাদের দিয়ে গান গাইয়ে তা যদি শুদ্ধ সুরে না হয়- সেটা লজ্জাজনক। কারণ সুরের গান বেসুরো হলে তাতে যত কণ্ঠই থাকুক তা যেমন শ্রুতিমধুর হয় না তেমনি তাতে কোনো কৃতিত্বও নেই।
চারদিকে শুধু হতাশা। সবশেষে একটা আশার কথা শোনান।
আশার কথা এটিই, এ দেশের সাধারণ মানুষ খুব সৎ এবং পরিশ্রমী। সঙ্গে আছে নতুন প্রজন্ম। সুতরাং এগিয়ে আমরা যাবই।