প্রয়াত রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ প্রতিষ্ঠিত জাতীয় পার্টিতে চলছে চরম অস্থিরতা। বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে ২৮ জুন দশম সম্মেলনের ঘোষণা দেয় জাতীয় পার্টি (জাপা)। গতকাল দলের পক্ষ থেকে জানানো হয়, কর্তৃপক্ষ জাতীয় পার্টির হল বরাদ্দ বাতিল করেছে। হল বরাদ্দ সাপেক্ষে কবে সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে, তা গণমাধ্যমসহ দেশবাসীকে পরবর্তী সময়ে জানানো হবে।
এদিকে পার্টির একটি বড় অংশ ২৮ জুন সম্মেলন করার বিষয়ে অনড় রয়েছে। তারা সম্মেলনের জন্য বিকল্প স্থান খুঁজছে। সম্মেলনে বর্তমান চেয়ারম্যান এরশাদের ছোট ভাই গোলাম মোহাম্মদ (জি এম) কাদেরের বিরুদ্ধে চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান ও প্রতিষ্ঠাতাকালীন সদস্য ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ। মহাসচিব পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন সাবেক মহাসচিব এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার। এই দুই নেতার পাশে এককাট্টা দলটির অনেক সিনিয়র নেতা। ফলে সম্মেলন ঘিরে আবারও জাতীয় পার্টিতে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের গড়া দল সপ্তমবারের মতো ভাঙছে। তবে জি এম কাদেরের অনুসারীরা বলছেন, জি এম কাদেরের নেতৃত্বেই থাকবে মূল দল। জানতে চাইলে এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘পার্টির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ লিখিতভাবে আমাকে তাঁর অবর্তমানে পার্টির সার্বিক দায়িত্ব দিয়েছিলেন। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ মারা যাওয়ার পর দলীয় স্বার্থ বিবেচনায় ওই চিঠি কার্যকরের উদ্যোগ নিইনি। পল্লিবন্ধু এরশাদ সবাইকে নিয়ে জাতীয় পার্টিকে শক্তিশালী করতে বলেছিলেন। এখন দিনদিন পার্টি ছোট হয়ে যাচ্ছে। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে শক্তিশালী অবস্থান নেওয়া ও সারা দেশে জাতীয় পার্টির নেতা-কর্মীদের একছাতার নিচে আনার লক্ষ্যে আমরা এই উদ্যোগ নিয়েছি। আশা করি জি এম কাদের সাহেব আমাদের এই উদ্যোগে সাড়া দেবেন।’
যাঁরা নতুন জাতীয় পার্টি করার উদ্যোগ নিয়েছেন, তাঁরা এত দিন জি এম কাদেরকেই ছায়া দিয়ে রেখেছিলেন। তাহলে এখন তাঁকে মাইনাস করা কেন? নতুন উদ্যোক্তারা বলছেন, দলে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার জন্যই তাঁরা এমন উদ্যোগ নিয়েছেন। পার্টিপ্রধানের সাম্প্রতিক বক্তব্য সমালোচনার সৃষ্টি করছে। এই প্রক্রিয়ায় পার্টির সাবেক নেতা কাজী ফিরোজ রশীদ, সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা, সাহিদুর রহমান টেপা, শফিকুল ইসলাম সেন্টুসহ অনেকে যুক্ত হয়েছেন। তাঁরা সম্মেলন ঘিরে ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদের নেতৃত্বে দফায় দফায় বৈঠক করছেন। যোগাযোগ করছেন জেলা-উপজেলা পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে। ২৮ জুন ঢাকায় বড় ধরনের শোডাউন করে সম্মেলনের মাধ্যমে নতুন নেতৃত্বের সূচনা ঘটাতে চান তাঁরা। তাঁরা বলছেন, অতীতে যাঁরা দল ছেড়ে চলে গেছেন তাঁদের ফিরিয়ে আনা, সবার মতামতের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণসহ নানা বিষয়ে বর্তমান নেতৃত্বের প্রতি অনুরোধ করা হলেও তা রাখা হয়নি। উদ্যোক্তারা বলছেন, ইতোমধ্যে দেশের অধিকাংশ জেলার শীর্ষ নেতারা নতুন এই উদ্যোগে সম্মতি দিয়েছেন। জানা যায়, নব্বইয়ের গণ আন্দোলনে এরশাদ সরকারের পতন হলে হুদা-মতিনের নেতৃত্বে জাপা প্রথমবারের মতো ভাগ হয়। ওই দশকেই ১৯৯৭ সালে আনোয়ার হোসেন মঞ্জু ও শেখ শহিদুল ইসলামের নেতৃত্বে দ্বিতীয় দফা, ১৯৯৮ সালে কাজী জাফর ও শাহ্ মোয়াজ্জেমের নেতৃত্বে তৃতীয় দফা ভাঙে দলটি।
এরপর একবিংশ শতকের শুরুতেই ২০০১ সালে নাজিউর রহমানের নেতৃত্বে চতুর্থ দফা এবং ২০১৩ সালের ২০ ডিসেম্বর বিশেষ কাউন্সিলের মাধ্যমে পঞ্চম দফা ভাঙন ঘটে। সর্বশেষ দলের প্রতিষ্ঠাতা এরশাদের মৃত্যুর পর চেয়ারম্যান পদ নিয়ে দ্বন্দ্বে ২০২৪ সালের ৯ মার্চ ষষ্ঠবারের মতো ভাঙে এরশাদের জাতীয় পার্টি। এরশাদের অছিয়ত মতো তাঁর ছোট ভাই জি এম কাদের চেয়ারম্যান হলে বেঁকে বসেন স্ত্রী রওশন এরশাদ। নিজেকে জাপার চেয়ারম্যান ঘোষণা করে দলের কমিটি গঠন করেন, মহাসচিব করা হয় কাজী মামুনুর রশীদকে। ২০১৯ সালের ১৪ জুলাই মারা যান দলের প্রতিষ্ঠাতা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। ১৯৮২ সালে বিএনপির নেতৃত্বাধীন সরকারের রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবদুস সাত্তারের কাছ থেকে ক্ষমতা নেন তৎকালীন সেনাপ্রধান এরশাদ। এরপর ১৯৯০ সাল পর্যন্ত টানা ৯ বছর দেশ শাসন করেন তিনি।