৫ জানুয়ারি ২০২১ সাল। একটি রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকের বোর্ড সভা চলছিল। বোর্ড সভা চলাকালেই ব্যাংকের চেয়ারম্যানের কাছে একটি ফোন আসে। ব্যাংকের চেয়ারম্যান তটস্থ হয়ে যান। ফোনে ছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব আহমদ কায়কাউস। চট্টগ্রামের এক অখ্যাত কোম্পানি এস এল টেকস-কে ৮৩৭ কোটি টাকা ঋণপ্রস্তাব অনুমোদনের জন্য তিনি চেয়ারম্যানকে নির্দেশ দিলেন। ব্যাংকের চেয়ারম্যান বললেন, প্রতিষ্ঠানটি সন্দেহজনক। অতীতের কোনো ব্যবসায়িক রেকর্ড নেই। এরকম একটি প্রতিষ্ঠানকে এত বিপুল পরিমাণ টাকা ঋণ দেওয়া সমীচীন হবে না। ড. কায়কাউস সাফ জানিয়ে দেন, এই বোর্ড সভায় ঋণপ্রস্তাব অনুমোদন না হলে, তিনি পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দেবেন। বোর্ড নিরুপায় হয়ে এস এল টেকস নামের ভৌতিক কোম্পানিকে ৮৩৭ কোটি টাকার ঋণপ্রস্তাব অনুমোদন করে। পরবর্তী সময়ে দেখা যায়, এস এল টেকস কোম্পানির মালিকানা এস আলমের গাড়িচালকের। এ কোম্পানি যে সম্পদ দেখিয়েছে সবই ভুয়া। গাড়িচালকের নামে কোম্পানি করে এস আলম ব্যাংকের টাকা লুট করেছেন। আর এ লুণ্ঠনে এস আলমের প্রধান সহযোগী ড. আহমদ কায়কাউস। এভাবেই দেশের ব্যাংকিং সেক্টরে ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে লুটপাট হয়েছে ড. আহমদ কায়কাউসের নেতৃত্বে।
এস আলম ছিলেন বাংলাদেশে ব্যাংকিং খাতের সবচেয়ে বড় লুণ্ঠনকারী। তার হাত ধরেই বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত ধ্বংস হয়েছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ সরকার এস আলমের হাতে ৯টি ব্যাংক তুলে দিয়েছিল। এসব ব্যাংক দখল করা হয়েছে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা প্রয়োগ করে এবং সরকারের মদতে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বলপ্রয়োগের মাধ্যমে। আর এ বলপ্রয়োগ এবং সরকারের মদত দেওয়ার পেছনে মুখ্য ভূমিকা রেখেছিলেন আহমদ কায়কাউস। আহমদ কায়কাউসের বাড়ি চট্টগ্রামে। এস আলমের বাড়িও চট্টগ্রামে। আহমদ কায়কাউস যখন অতিরিক্ত সচিব, তখনই এস আলমের সঙ্গে পরিচয় ঘটে তার। বিশেষ করে আহমদ কায়কাউস যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডালাসে পিএইচডি করছিলেন, সেই সময় তিনি কানাডায় এস আলমের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন বলে বাংলাদেশ প্রতিদিনের কাছে তথ্যপ্রমাণ রয়েছে। এখানেই এস আলম এবং আহমদ কায়কাউস ভবিষ্যতের লুণ্ঠন পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। এরপর দেশে ফিরে এসে আহমদ কায়কাউস কিছুদিন অতিরিক্ত সচিবের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তারপর তিনি বিদ্যুতের সচিব হন। বিদ্যুতের সচিব হওয়ার পরপরই এস আলম বিদ্যুৎ খাতে বিনিয়োগ শুরু করে এবং বিভিন্ন কুইক রেন্টালের নামে যে লুণ্ঠন চলছিল, সেই লুণ্ঠনের অংশীদার হন। আহমদ কায়কাউস তাকে সহযোগিতা করেন। বিদ্যুৎ সেক্টরে কাজের ন্যূনতম অভিজ্ঞতা না থাকার পরও এস আলমকে একাধিক পাওয়ার প্লান্টের লাইসেন্স দেওয়া হয়। কিন্তু এস আলম বিদ্যুৎ সেক্টরের কাজ নিয়ে সন্তুষ্ট ছিলেন না। তার নজর ছিল ব্যাংক থেকে নগদ অর্থ লুণ্ঠন করে বিদেশে পাচার করা। আর এ কারণেই আহমদ কায়কাউসকে ক্ষমতাবান করা ছিল তার প্রধান উদ্দেশ্য।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে এস আলম আহমদ কায়কাউসকে ঘনিষ্ঠ করিয়ে দেন। এরপর আর এস আলমকে ব্যাংকিং সেক্টর নিয়ে চিন্তা করতে হতো না। ব্যাংকিং সেক্টরে ২০১৮ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত সময়ে ড. আহমদ কায়কাউসকে ডাকা হতো এস আলমের লাঠিয়াল হিসেবে। বাংলাদেশ ব্যাংক সব সময় ব্যাংকিং সেক্টরগুলোর দুর্নীতি, অনিয়ম ইত্যাদি দেখভাল করে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তত্ত্বাবধান এবং নজরদারির কারণে ব্যাংকিং সেক্টরে ঋণখেলাপিসহ বিভিন্ন অনিয়ম জবাবদিহিতায় আসে। কিন্তু আহমদ কায়কাউস পরিকল্পিতভাবে বাংলাদেশ ব্যাংককে ধ্বংস করেছিলেন। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে প্রথমে একজন অর্থনীতিবিদকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর করেছিল। কিন্তু এর মধ্যেই আমলাতন্ত্রের কর্তৃত্ব বাড়ে এবং পরবর্তী সময়ে প্রথমে ফজলে কবিরকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর করা হয়। ফজলে কবির হলেন প্রথম আমলা, যিনি চাকরি শেষ করে রাতারাতি বাংলাদেশ ব্যাংকের মতো একটি বিশেষায়িত রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ পদে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন। এই প্রক্রিয়া শুরু করেছিলেন আহমদ কায়কাউস। পরবর্তী সময়ে আবদুর রউফ তালুকদারকে করা হয় বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর। আবদুর রউফ তালুকদার ছিলেন ড. আহমদ কায়কাউসের একান্ত অনুগত এবং বাধ্যগত। আবদুর রউফ তালুকদারকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর করা হয়েছিল মূলত এস আলমের স্বার্থ রক্ষা করার জন্য। এ সময় একের পর এক ব্যাংক থেকে নামে-বেনামে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ নিতে থাকেন এস আলম এবং আওয়ামী দুর্বৃত্তরা। ব্যাংকগুলো হয়ে যায় দেউলিয়া। বিপর্যয়ে পড়ে আর্থিক খাত। দেশের অর্থনীতিতে নেমে আসে গভীর সংকট।
আহমদ কায়কাউস এস আলমের জন্য যে সবচেয়ে বড় অবদানটি রেখেছিলেন তা হলো ইসলামী ব্যাংক দখল করা। ইসলামী ব্যাংক ছিল বাংলাদেশের বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে লাভজনক এবং বড় ব্যাংক। এই ব্যাংকটিকে ধ্বংস করার জন্য তাদের পরিচালকদের হেনস্তা করা হয়। এমনকি যারা উদ্যোক্তা, শেয়ারহোল্ডার তাদের ভয়ভীতি দেখিয়ে একটি পাঁচতারকা হোটেলে নিয়ে যাওয়া হয়। সেই পাঁচতারকা হোটেলে তাদের বাধ্য করা হয় মালিকানা হস্তান্তরের জন্য। এই পুরো কর্মযজ্ঞটি করেছিলেন আহমদ কায়কাউস সেনা গোয়েন্দাদের একটি অংশকে ব্যবহার করে। এ ছাড়া আরও অন্তত সাতটি ব্যাংক হস্তান্তরের ক্ষেত্রে আহমদ কায়কাউস মূল কলকাঠি নেড়েছিলেন। তবে আবদুর রউফ তালুকদার গভর্নর হওয়ার পর আহমদ কায়কাউসকে আর বেশি কষ্ট করতে হয়নি। আবদুর রউফ তালুকদারকে তিনি যেভাবে নির্দেশ দিতেন, সেভাবেই করতেন।
খেলাপি ঋণের চর্চা এবং খেলাপি ঋণের যে ব্যাপক বিস্তার সেটিও হয়েছে আহমদ কায়কাউসের জন্য। অন্তত ১০টি ব্যাংকের ঋণ পর্যালোচনা করে দেখা যায়- সব ব্যাংক ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে আহমদ কায়কাউসের একটি নজরদারি এবং হস্তক্ষেপ ছিল। কোন ব্যাংকের চেয়ারম্যান কে হবেন, বোর্ড মেম্বারে কারা থাকবেন- এসবই নির্ধারণ করতেন আহমদ কায়কাউস।
২০১৮ সালে নির্বাচনের পর প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব হয়ে তিনি ব্যাংকিং সেক্টরের ব্যবস্থাপনা তদারকি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের আওতায় নিয়ে আসেন। সেই সময় প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব হয়ে তিনি সব ব্যাংকে একটি সার্কুলার জারি করেছিলেন। সেই সার্কুলারে বলা হয়েছিল, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর পরিচালনা পর্ষদ নির্ধারণ করার ক্ষেত্রে মন্ত্রণালয়কে অবশ্যই প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অনুমতি নিতে হবে। এই অনুমতি নেওয়ার পদ্ধতি চালু করে আহমদ কায়কাউস পুরো ব্যাংকিং সেক্টরকে নিজের কর্তৃত্বের মধ্যে নিয়ে আসেন। তার নিজের লোকদের সব রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে চেয়ারম্যান করেন। তার ঘনিষ্ঠ আমলাদের বসিয়ে তিনি ব্যাংক লুণ্ঠনের নীল নকশা বাস্তবায়ন করেছিলেন। এ সময় জনতা ব্যাংক, সোনালী ব্যাংক, বেসিক ব্যাংক, অগ্রণী ব্যাংকসহ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে যে বেহিসাবি ঋণ বিতরণ করা হয়েছে, সেসব বেহিসাবি ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে আহমদ কায়কাউসের ভূমিকাই ছিল সবচেয়ে বেশি। এসব ভুয়া ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে তিনি সব সময় এস আলমের পাহারাদার হিসেবে কাজ করেছেন। বাংলাদেশে যে ব্যাংকিং সেক্টরে যেভাবে ঋণখেলাপি হচ্ছে, এ নিয়ে তথ্য গোপন করা এবং অর্থ পাচার করার নিত্যনতুন পদ্ধতি আবিষ্কার করে তিনি এস আলমকে সহায়তা করেছিলেন। এস আলমের সঙ্গে এই সখ্যতা গড়ে ওঠার ফলে একদিকে যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার করেছেন আহমদ কায়কাউস, ঠিক তেমনি সরকারের মধ্যে হয়ে উঠেছিলেন প্রচণ্ড ক্ষমতাবান।
২০১৮ সালে রাতের ভোটের পর অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল আ হ ম মুস্তফা কামালকে। মুস্তফা কামাল নিজেও ছিলেন একজন দুর্নীতিবাজ। দায়িত্ব গ্রহণের পর তিনি আহমদ কায়কাউসের সঙ্গে তাকে বৈঠক করতে হয় এবং এই বৈঠকে আহমদ কায়কাউস তাকে মন্ত্রণালয়ের কাজে বেশি হস্তক্ষেপ না করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ দিয়েছেন বলে জানান। আহমদ কায়কাউস অঘোষিতভাবে অর্থ মন্ত্রণালয়ের হর্তাকর্তা হয়ে যান। এ সময় তিনি ব্যাংকিং সেক্টরের সচিব বানান একজন দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাকে, যিনি তার ঘনিষ্ঠ এবং আজ্ঞাবহ। একইভাবে তিনি অর্থ বিভাগেরও সচিব বানান আবদুর রউফ তালুকদারকে। একইভাবে তিনি সচিব করেন ফজলে কবির এবং পরবর্তী সময়ে আবদুর রউফ তালুকদারকে। যারা তার ঘনিষ্ঠ এবং একান্ত বাধ্যগত হিসেবে পরিচিত ছিলেন। এভাবেই তিনি ব্যাংকিং সেক্টরে একটি মাফিয়া নেটওয়ার্ক তৈরি করেন। ব্যাংকিং সেক্টরের নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে আহমদ কায়কাউস মূলত তিনটি কাজ করেছেন। প্রথমত, ব্যাংকের মালিকানা কুক্ষিগত করা। যেটি এস আলমকে দিয়ে করিয়েছেন। দ্বিতীয়ত, ব্যাংকিং সেক্টর থেকে লুটেরাদের সুযোগ করে দেওয়া। যেন তারা ব্যাংক থেকে অর্থ লুণ্ঠন করতে পারেন ইচ্ছামতো। তৃতীয়ত, অর্থ পাচারে সহযোগিতা করা। এভাবে এস আলমের পাহারাদার হিসেবে তিনি বাংলাদেশের ব্যাংকিং সেক্টরকে ধ্বংস করেছেন। এস আলম যে ১ লাখ কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছেন এ টাকা পাচার করা হয়েছে মূলত আহমদ কায়কাউসের সহযোগিতায় এবং প্রত্যক্ষ মদতে।