পবিত্র কোরআন পৃথিবীর সব জ্ঞান-বিজ্ঞানের মূল উৎস। প্রিয় নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর ওপর কোরআন নাজিল শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ইসলামী শিক্ষার আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়। তখনকার পৃথিবী ছিল অজ্ঞতা ও অন্ধকারে পরিপূর্ণ। এমনকি আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তৈরিই হয়নি।
নবীজি (সা.)-এর মাধ্যমে শুরু হয় জ্ঞানের আলোকরশ্মি বিতরণের প্রাতিষ্ঠানিক কার্যক্রম। নবীজির জীবনটাই ছিল একটি চলমান শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। প্রাথমিক অবস্থায় তিনি গোপনে ইসলামের দাওয়াত দিতে থাকেন। যাতে শুরু থেকেই সাধারণ মানুষ বিরোধিতা করতে না পারে।
এই প্রক্রিয়ায় খুলাফায়ে রাশেদার চারজন খলিফাসহ প্রায় ৪০ জনের একটি দল ইসলাম গ্রহণ করেন। তাঁরাও গোপনে ইবাদত-বন্দেগি করতেন। নবদীক্ষিত সাহাবাদের মূল কাজ হলো ইসলামী শিক্ষা অর্জন। মক্কায় ইসলামী শিক্ষা বিকাশ হয়েছিল তিন পর্যায়ে—
এক. প্রিয় নবীজি (সা.) নিজেই নিকটাত্মীয়দের মধ্যে ব্যক্তি পর্যায়ে ইসলাম শিক্ষা দিয়েছিলেন।
দুই. বিভিন্ন গৃহকেন্দ্রিক শিক্ষাব্যবস্থার বিকাশ।
তিন. আনুষ্ঠানিক শিক্ষাকেন্দ্র। যেমন—মক্কা নগরীর দারুল আরকাম। আরকাম (রা.) ছিলেন সপ্তম বা দশম স্থানে ইসলাম গ্রহণকারী একজন সাহাবি। তাঁর বাড়িটি ছিল সাফা পাহাড়ের পাদদেশে।
এতে বসেই নবীজি সাহাবাদের কোরআন শিক্ষা দিতেন এবং ইসলামের বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিতেন। এই ‘দারে আরকাম’ই হলো ইসলামের ইতিহাসে প্রথম বিদ্যাপীঠ ও আবাসিক ছাত্রাবাস। রাসুল পাক (সা.) বেশি সময় ওই বাড়িতে থাকতেন। এখানে তিনি নিজেই কোরআন শিক্ষা দিতেন এবং বহু লোক ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করে। (মুসতাদরাকে হাকামে)
উমর ফারুক (রা.) এই দারুল আরকামে এসেই ইসলাম গ্রহণ করেন। সেখানে উল্লেখযোগ্য শিক্ষকের মধ্যে আবু বকর সিদ্দিক (রা.) এবং খাব্বাব ইবনুল আরত (রা.) প্রমুখ অন্যতম।
শিয়াবে আবু তালেবে শিক্ষালয় স্থাপন
মুসলমানদের সংখ্যা যখন দিন দিন বৃদ্ধি পেতে লাগল, বিশেষ করে উমর (রা.) ও জাফর (রা.) ইসলাম গ্রহণ করলে কুরাইশরা ক্ষোভে ফেটে পড়ে। তখন কুরাইশদের সব গোত্র একত্র হয়ে একটি চুক্তিপত্র সম্পাদন করে। এতে তারা লিখে যে মুহাম্মদ (সা.), বনি হাশেম ও তার সহযোগীদের সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন করা হবে। কোনো ব্যক্তি বনি হাশেমের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হতে পারবে না, তাদের সঙ্গে মেলামেশাও করতে পারবে না—যতক্ষণ না বনি হাশেম মহানবী (সা.)-কে তাদের কাছে হত্যার জন্য হস্তান্তর করে। এই শিয়াবে আবু তালেবে মুসলমানরা তিন বছর অত্যন্ত কষ্ট করে অতিবাহিত করেন। এখানেও রাসুলে পাক (সা.) কোরআন শিক্ষা অব্যাহত রেখেছিলেন।
আবু বকর সিদ্দিক (রা.) মসজিদ শিক্ষাকেন্দ্র
ইসলামী শিক্ষার আদি কেন্দ্র হিসেবে আবু বকর সিদ্দিক (রা.) মসজিদের নাম উল্লেখযোগ্য। এটি ছিল মূলত খোলা জায়গা, যেখানে আবু বকর সিদ্দিক (রা.) নামাজ আদায় করতেন এবং কোরআন তিলাওয়াত করতেন। আবু বকর (রা.) যখন কোরআন তিলাওয়াত করতেন তখন মক্কার কুরাইশ বংশের নারী ও শিশুরা সেখানে জড়ো হয়ে যেত। এই দৃশ্য মক্কার কাফির-মুশরিকদের জন্য ছিল অসহ্য যন্ত্রণার। হাদিসে রয়েছে,...এরপর তাঁর (আবু বকর) ঘরের পাশেই একটি মসজিদ তৈরি করে নিলেন। এতে তিনি সালাত আদায় ও কোরআন পড়তে লাগলেন। এতে তাঁর কাছে মুশরিকা মহিলা ও যুবকরা ভিড় জমাতে লাগল। তারা আবু বকর (রা.)-এর এই কাজে বিস্ময়বোধ করত এবং তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকত। আবু বকর (রা.) ছিলেন একজন ক্রন্দনকারী ব্যক্তি, তিনি যখন কোরআন পড়তেন তখন তাঁর অশ্রু সামলিয়ে রাখতে পারতেন না। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৩৯০৫)
পরবর্তী সময়ে আরবের সম্ভ্রান্ত এক ব্যক্তি ইবনুদ দাগিনা দায়িত্ব নিয়ে আবু বকর (রা.)-কে নিজ ঘরে নামাজ ও কোরআন তেলাওয়াতের ব্যবস্থা করে দেন।
ইবনে জুরারা (রা.)-এর ঘরে মাদরাসা
হিজরতের আগে মদিনা থেকে আসা ‘আউস’ গোত্রের কিছু লোক মহানবী (সা.)-এর সঙ্গে হজের মওসুমে দেখা করে ইসলাম গ্রহণ করেন। এদের একজন হলেন আসআদ ইবনে জুরারাহ (রা.), অন্যজন হলেন জাকওয়ান ইবনে আবদে কাইস (রা.) প্রমুখ। পরবর্তী বছরে আরো আটজন ইসলাম গ্রহণ করেন। পরের বছর হজের মওসুমে ১২ জন লোক হাজির হলো। তার মধ্যে ১০ জন খাজরাজ গোত্রের আর দুজন আউস গোত্রের ছিল। সবার প্রিয় নবীজির হাতে মিনার জামরায়ে আকবায় বায়াত গ্রহণ করলেন। তাঁরা বায়াত গ্রহণ করে মদিনায় চলে যান। এক পর্যায়ে আউস ও খাজরাজ গোত্রের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা প্রিয় নবীজি (সা.)-এর কাছে এ মর্মে চিঠি লিখে পাঠালেন যে আপনি এমন কাউকে আমাদের কাছে পাঠিয়ে দিন, যিনি আমাদের কোরআন শেখাবেন, ইসলামের বিধি-বিধান শেখাবেন। তখন মহানবী (সা.) মুসআব ইবনে উমায়ের (রা.)-কে মদিনাবাসী নতুন মুসলিমদের শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত করে পাঠান। মুসআব ইবনে উমায়ের (রা.) মদিনায় আসআদ ইবনে জুরারা (রা.)-এর ঘরে অবস্থান গ্রহণ করেন। এই ঘরই হলো ইসলামের ইতিহাসে মদিনায় সর্বপ্রথম মাদরাসা।
মসজিদে বনু জুরাইক
বর্ণিত আছে প্রিয় নবী মদিনায় হিজরতের প্রায় দুই বছর আগেই সেখানে ইসলাম শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছিল।
(ফতহুল বুলদান, বালাজুরি, পৃষ্ঠা-৪৫৯)
পরে নবীজির জীবদ্দশায় মদিনায় ৯টি মসজিদ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। মসজিদগুলোতে যাঁরা ইমামতির দায়িত্ব পালন করতেন, তাঁরা পাশাপাশি ইসলাম শিক্ষার শিক্ষক হিসেবেও শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করেছিলেন।
(ইবনে হাজার আসকালানি, আল-ইসাবা ফি তামিজিস সাহাবা : ২/১৯০)
গামিম অঞ্চলে শিক্ষালয় স্থাপন
গামিম হলো মদিনার নিকটবর্তী এলাকা। সেখানে আসলাম গোত্রের প্রায় ৮০টি পরিবারের বসবাস ছিল। নবীজি তাদের দ্বিনের দাওয়াত দিলে বুরাইদা (রা.) তাঁর সঙ্গীদের নিয়ে ইসলাম গ্রহণ করেন। অতঃপর নবীজি (সা.) তাঁদের সবাইকে নিয়ে এশার নামাজ আদায় করেন এবং তাঁদের সুরা মারইয়ামের প্রথম কয়েকটি আয়াত শিখিয়ে দেন।
মসজিদে নববী ও আসহাবে সুফফা
হিজরতের পর মদিনার ঐতিহাসিক মসজিদে নববী প্রতিষ্ঠিত হলে দ্বিনি শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাপকভাবে শুরু হয়। প্রিয় নবীজির সোহবতে মসজিদে নববী অল্প দিনের মধ্যেই মুসলমানদের কেন্দ্রীয় শিক্ষায়তন হিসেবে পরিচিত হতে থাকে। মসজিদে নববীর ‘সুতুনে আবি লুবাবা’ নামক থামের গোড়ায় বসে কোরআনের দরস পেশ করতেন। সেখানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ৭০ জন। তাঁরা সার্বক্ষণিক শিক্ষাকেন্দ্রে উপস্থিত থেকে কোরআন পাঠ ও ইসলামের বিধি-বিধান শিক্ষা লাভ করতেন।
লেখক : সিনিয়র শিক্ষক (ইসলাম শিক্ষা), চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল অ্যান্ড কলেজ
বিডি-প্রতিদিন/সালাহ উদ্দীন