জীবনের প্রতিটি মোড়ে মানুষ হোঁচট খায়, কখনো প্রবৃত্তির টানে, কখনো অজ্ঞতার অন্ধকারে। কিন্তু যে হৃদয় ভুল স্বীকারে লজ্জিত হয়, যে চোখ আল্লাহর দরবারে কান্নায় ভিজে যায়; সেখানেই ফুটে ওঠে মানবতার সবচেয়ে পবিত্র সৌন্দর্য। কারণ আল্লাহর দরজা কখনো বন্ধ হয় না; তাঁর রহমত সীমাহীন, তাঁর ক্ষমা আসমান ও জমিনের চেয়েও প্রশস্ত। মানুষ যখন অনুতাপে ফিরে আসে, তখন সে শুধু পাপ থেকে মুক্ত হয় না; বরং আল্লাহর ভালোবাসার ছায়াতলে আশ্রয় পায়।
মানুষ ভুল করে, কিন্তু ফেরে না সবাই : ভুল করা বা গুনাহে লিপ্ত হওয়া মানুষের জন্মগত স্বভাব। কিন্তু ভুল বুঝে তাওবা করে ফেরত আসাটাই মানুষের সবচেয়ে বড় গুণ। ইসলামের দৃষ্টিতে পাপ নিজে যতটা ভয়াবহ, তার চেয়েও ভয়াবহ হলো তাওবা থেকে বিমুখ থাকা। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘বলুন, হে আমার বান্দারা, যারা নিজেদের ওপর সীমা লঙ্ঘন করেছ! তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ সব গুনাহ ক্ষমা করেন।’
(সুরা : জুমার, আয়াত : ৫৩)
এই আয়াত মানবজীবনের জন্য এক বিরাট আশার বার্তা। এখানে আল্লাহ সবার জন্য তাঁর অপরিসীম দয়ার দরজা খুলে দিয়েছেন। পাপী, অবাধ্য, এমনকি যে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছে তার জন্যও।
তাওবায় আত্মার নবজন্ম হয় : তাওবা শুধু ‘আস্তাগফিরুল্লাহ’ বলার নাম নয়, এটি হৃদয়ের ভেতরে এক আত্মিক বিপ্লব। ইমাম নববী (রহ.) বলেন, তাওবার মূল শর্ত তিনটি—পাপ থেকে অবিলম্বে বিরত থাকা, অতীতের জন্য অনুশোচনা করা, ভবিষ্যতে না করার দৃঢ় অঙ্গীকার করা। যে তাওবা এই তিন শর্তে সম্পন্ন হয়, সেটিই হৃদয়কে নবজীবন দেয়।
পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ বলেন, ‘যে তাওবা করে, ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে, আল্লাহ তার মন্দ কাজগুলোকে সৎকর্মে পরিণত করে দেন।’ (সুরা : আল-ফুরকান, আয়াত : ৭০)
তাওবা তাই শুধু ক্ষমা নয়, এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে পাপের কৃষ্ণগহ্বর থেকে সওয়াবের আলোক মিনারে পৌঁছার এক অপূর্ব সৌন্দর্যময় পরিবর্তন।
আল্লাহর ভালোবাসা অর্জনের সহজতম পথ : মহান আল্লাহ তাওবাকারীদের প্রতি শুধু দয়া করেন না, বরং ভালোবাসেনও। পবিত্র কোরআনে এসেছে ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তাওবাকারীদের ভালোবাসেন এবং আত্মশুদ্ধি অর্জনকারীদেরও ভালোবাসেন।’ (সুরা : বাকারাহ, আয়াত : ২২২)
মহানবী (সা.) বলেন, ‘আল্লাহ তাঁর বান্দার তাওবায় ততটাই আনন্দিত হন, যতটা আনন্দিত হয় সেই মানুষ, যে মরুভূমিতে উট হারিয়ে ফেলে এবং হঠাৎ সেটি ফিরে পায়।’
(মুসলিম, হাদিস : ২৭৪৭)
নবীদের তাওবায় বিনয়ের শিক্ষা : নবীরা ছিলেন নিষ্পাপ, তবু তাঁরা বারবার আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইতেন। এটি ছিল তাঁদের বিনয়, তাঁদের আল্লাহভীতি। মহানবী (সা.) বলেন, ‘হে মানুষ! তোমরা তাওবা করো। আমি নিজে দিনে সত্তরবার তাওবা করি।’ (বুখারি, হাদিস : ৬৩০৭)
একজন নিষ্পাপ নবীর এই তাওবা আমাদের শেখায় যে তাওবা শুধু পাপীর দায়িত্ব নয়, বরং আল্লাহপ্রেমীদের নিত্যচর্চা।
আল্লাহর রহমত সীমাহীন : আল্লাহর রহমতের কোনো সীমানা নেই। এক হাদিসে মহানবী (সা.) বলেন, ‘আল্লাহর রহমত ১০০ ভাগ। এর মধ্যে এক ভাগ পৃথিবীতে নাজিল করেছেন, যার কারণে মা সন্তানকে ভালোবাসে, পশু তার বাচ্চাকে দয়া করে। বাকি ৯৯ ভাগ তিনি সংরক্ষণ করে রেখেছেন কিয়ামতের দিনের জন্য।’ (মুসলিম, হাদিস : ২৭৫৩)
এমন রহমত যাঁর, তাঁর দরজায় ফিরে আসা লজ্জার নয়, বরং সম্মানের।
ভুল থেকে না ফেরা অন্তরের জন্য অন্ধকার অধ্যায় : পাপ নয়, বরং পাপের ওপর অটল থাকাই মানুষকে ধ্বংস করে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘যে তাওবা করে না, তারাই তো জালিম।’
(সুরা : হুজুরাত, আয়াত : ১১)
অর্থাৎ ভুল হয়ে যাওয়া বিপদের কারণ নয়, বরং ভুলের মধ্যে গা ভাসানোই প্রকৃত অন্যায়। যে ভুল থেকে ফিরে আসে, সে আলোর পথের যাত্রী। আর যে অহংকারে ফেরে না, সে অন্ধকারে আবদ্ধ।
তাই মুমিনের উচিত গুনাহ হয়ে গেলে তাওবা করে মহান আল্লাহর দরবারে ফিরে আসা। এটি এক আত্মিক যাত্রা, যেখানে মানুষ নিজের অহংকার ভেঙে প্রভুর দরজায় মাথা রাখে। মহানবী (সা.) বলেন, ‘যে তাওবা করে, সে এমন, যেন তার কোনো পাপই ছিল না।’ (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ৪২৫০)
তাওবা তাই শুধু ক্ষমা নয়, এটি এক নতুন পরিচয়, এক নবজীবন।
লেখক : শিক্ষার্থী, তাকমিল, জামিয়া ইমদায়িদা মুসলিম বাজার, মিরপুর, ঢাকা