ইরান-ইসরায়েলের যুদ্ধ গতকাল চতুর্থ দিনে গড়িয়েছে। এদিনও পাল্টাপাল্টি ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানো হয়। এসব হামলায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির খবর পাওয়া গেছে। ইসরায়েলের অন্যতম শহর তেল আবিবে ইরানের একটি ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে মার্কিন দূতাবাস প্রকম্পিত হয়েছে। ইরান চার দিনে ৩৭০টি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছে বলে উল্লেখ করা হয়। অন্যদিকে ইসরায়েল দাবি করেছে, ইরানের এক তৃতীয়াংশ ক্ষেপণাস্ত্রসহ লঞ্চার ধ্বংস করে দেওয়া হয় এবং ইরানের আকাশসীমাও তেল আবিবের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। এদিকে দক্ষিণ চীন সাগর থেকে মার্কিন বিমানবাহী রণতরি মধ্যপ্রাচ্যের দিকে রওনা হওয়ায় যুদ্ধ পূর্ণাঙ্গ এবং নতুন মাত্রায় রূপ নিতে চলেছে বলে পর্যবেক্ষকরা জানাচ্ছেন। ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন ভবনে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েলি বিমান বাহিনী। ইরানও আবার ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছে ইসরায়েলে। সূত্র : রয়টার্স, বিবিসি, আলজাজিরা, এএফপি
এক খবরে বলা হয়েছে, ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে সংঘাত দ্রুত পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধে রূপ নিচ্ছে। দুই দেশের হামলা-পাল্টা হামলার মধ্যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সহায়তা চেয়েছেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। মার্কিন বিমানবাহী রণতরি ইউএসএস নিমিট্জ মধ্যপ্রাচ্যের দিকে রওনা হয়েছে। প্রাপ্ত খবর অনুযায়ী, গতকাল সকালে ইউএসএস নিমিট্জকে নতুন গন্তব্য অভিমুখে দেখা গেছে। আগের গতিপথ অনুযায়ী চলতি সপ্তাহের শেষ দিকে রণতরিটির ভিয়েতনামের দানাংয়ে থাকার কথা ছিল, শুক্রবার তাকে সেখানে আনুষ্ঠানিকভাবে বরণ করে নেওয়া হতো। এখন সে আয়োজন বাতিল হয়েছে বলে এক কূটনীতিকসহ দুই সূত্র নিশ্চিত করেছেন।
প্রসঙ্গত, ইউএসএস নিমিট্জের নেতৃত্বাধীন যুদ্ধজাহাজের বহর কয়েক দিন আগেও দক্ষিণ চীন সাগরে নিরাপত্তা কার্যক্রম পরিচালনা করেছে, যাকে ‘ইন্দো-প্যাসিফিকে মার্কিন নৌবাহিনীর নিয়মিত উপস্থিতির অংশ’ বলছে মার্কিন প্রশান্ত মহাসাগরীয় বহরের কমান্ডারের ওয়েবসাইট। গতকাল সকালেই একে পশ্চিমে মধ্যপ্রাচ্যের দিকে অগ্রসর হতে দেখা গেছে বলে মেরিন ট্রাফিকের তথ্য জানিয়েছে। আরেক খবর অনুযায়ী, ইসরায়েলের তেল আবিব শহরে মার্কিন দূতাবাসের কাছে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে ইরান। ইসরায়েলে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত মাইক হাকাবি সমাজমাধ্যম এক্সে পোস্টে এ তথ্য জানিয়েছেন। তিনি বলেন, তেল আবিবে মার্কিন দূতাবাস ভবনের কাছে ‘ইরানি ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে’ সামান্য ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। তবে অন্য সূত্রগুলো জানিয়েছেন, ক্ষেপণাস্ত্রের বিস্ফোরণে মার্কিন দূতাবাস বিপজ্জনকভাবে প্রকম্পিত হয়েছে। এরপর দূতাবাসটি সাময়িক বন্ধ করে দেওয়া হয়। মার্কিন রাষ্ট্রদূত মাইক হাকাবি বলেন, শনিবারও কঠিন সময় পার করতে হয়েছে। ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলার রাতটি ছিল উত্তেজনাপূর্ণ। সমাজমাধ্যমে পোস্টে তিনি জানান, সারা রাত তাঁকে পাঁচবার বিভিন্ন জায়গায় আশ্রয় নিতে বাধ্য করা হয়েছে। সুরক্ষিত আশ্রয় কেন্দ্রগুলোয় থাকতে হয়েছে। তিনি জানান, ইরানে ইসরায়েলের হামলার দুই দিন আগে বুধবার যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা বিভাগ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন স্থানে অবস্থানরত অনেক কর্মীকে সরিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করে। যেসব কর্মী জরুরি কাজে নিযুক্ত নন তাঁদের সরিয়ে নেওয়া হয়।
এদিকে ইরান-ইসরায়েল পাল্টাপাল্টি হামলা সম্পর্কে জানা গেছে, ইরানের পাল্টা হামলায় গতকাল অন্তত ২৪ ইসরায়েলি নিহত হয়েছে এবং আরও অনেকে আহত হয়েছে। ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র ইসরায়েলের প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ভেদ করে আবারও তেল আবিব ও হাইফা শহরে আঘাত হেনেছে। এতে অনেক ঘরবাড়ি ও আবাসিক ভবন ধ্বংস হয়েছে। আরেক খবরে বলা হয়, রবিবার রাতে ইরানি হামলায় চার ইসরায়েলি নিহত হয়েছে।
আরেকটি খবরে বলা হয়েছে, ইরান থেকে ইসরায়েলের দিকে মোট ৩৭০টি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ও শতাধিক ড্রোন ছোড়া হয়েছে। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় জানায়, গতকাল সকাল পর্যন্ত ইরানি হামলায় অন্তত ২৪ জন নিহত ও ৫৯২ জন আহত হয়েছে। আহতদের মধ্যে ১০ জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র ইসরায়েলের অন্তত ৩০টি স্থানে আঘাত হেনেছে। খবরে বলা হয়, ভিডিও ফুটেজে হাইফার আশপাশ এলাকায় বিস্ফোরণ, ঘরবাড়িতে আগুন ও অবকাঠামোর ক্ষয়ক্ষতি দেখা গেছে। ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ স্বীকার করেছেন, সংঘাতের চতুর্থ দিনে গতকাল সকালে চালানো ইরানের হামলা ছিল এ পর্যন্ত চালানো হামলার মধ্যে সবচেয়ে তীব্র এবং বড় আকারের। সর্বশেষ ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ইসরায়েলের কয়েকটি স্থান ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দমকল বাহিনী জানিয়েছে, ভূমধ্যসাগর উপকূলে একটি আবাসিক ভবন এতে ধ্বংস হয়ে গেছে।
এদিকে ইরানের ১২০টির বেশি ক্ষেপণাস্ত্র লঞ্চার ধ্বংস করার দাবি করেছে ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ)। ইসরায়েলের হামলা শুরুর পর থেকে এসব লঞ্চার ধ্বংস করা হয়েছে; যা ইরানের মোট ক্ষেপণাস্ত্র লঞ্চারের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ। ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনীর কর্মকর্তা এফি ডেফরিন বলেছেন, কেবল রবিবার রাতেই ইসরায়েলি বিমান বাহিনী ইরানের ২০টির বেশি ক্ষেপণাস্ত্র লঞ্চার ধ্বংস করেছে। ধ্বংস করা না হলে ইসরায়েলের দিকে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপের জন্য কয়েক মিনিটের মধ্যেই এসব লঞ্চার ব্যবহার করা হতো। তিনি বলেন, ইসরায়েল প্রায় ৫০টি যুদ্ধবিমান ব্যবহার করে ইরানের মধ্যাঞ্চলের ইস্পাহান শহরের অন্তত ১০০ সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে একযোগে হামলা চালিয়েছে। এসব লক্ষ্যবস্তুর মধ্যে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র মজুদ কারখানা, লঞ্চার এবং কমান্ড সেন্টার রয়েছে।
‘সুইসাইড ড্রোন’ পাঠিয়েছে ইরান : ইসরায়েলে হামলার পর কঠোর জবাব দিতে শুরু করেছে ইরান। দেশটি ইসরায়েলে ‘সুইসাইড ড্রোন’ পাঠিয়েছে। এ বিষয়ে ইরানের সেনাবাহিনীর গ্রাউন্ড ফোর্সের কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল কিয়ুমার্স হেইদারি বলেন, সেনাবাহিনী গত দুই দিনে ইসরায়েলি লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে কয়েক ডজন সুইসাইড ড্রোন নিক্ষেপ করেছে। ৪৮ ঘণ্টায় সেনাবাহিনী ইসরায়েলি আগ্রাসনের প্রতিশোধ হিসেবে ইসরায়েলি লক্ষ্যবস্তুতে বিস্ফোরণ ঘটাতে এ ড্রোনগুলো নিক্ষেপ করে। এ অভিযানে ব্যবহৃত ইরানের সেনাবাহিনীর শক্তিশালী আত্মঘাতী ড্রোনগুলোর মধ্যে ‘আরাশ’ অন্যতম। এ ড্রোনের পরিসর ২ হাজার কিলোমিটার। ইসরায়েলি শাসনের বিরুদ্ধে ইরানের সর্বশেষ হামলা গতকাল ভোরে শুরু হয়। এ সময় আইআরজিসি দ্বারা নিক্ষেপিত বেশ কয়েকটি হাইপারসনিক ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র তেল আবিব, হাইফা এবং অধিকৃত ভূখে র মধ্য ও উত্তরাঞ্চলের শহর যেমন ব্নেই ব্রাকের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানে।
তেহরানের আকাশসীমা নিয়ন্ত্রণের দাবি : ইরানের রাজধানী তেহরানের আকাশসীমায় পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার দাবি করেছে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ)। গতকাল সংবাদ সম্মেলনে আইডিএফ মুখপাত্র ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এফি ডেফরিন এ দাবি করেন। মুখপাত্র বলেন, ‘আমরা তেহরানের ওপর পূর্ণ বিমান নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছি। ইরানের এক-তৃতীয়াংশ ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র লঞ্চার ধ্বংস করে দিয়েছি। তাদের বড় অংশের হামলা ব্যাহত করা সম্ভব হয়েছে।’ ডেফরিন জানান, রবিবার রাত ও গতকাল ভোরে ইরান থেকে ইসরায়েলের দিকে দুই ধাপে ৬৫টি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ও ডজনখানেক ড্রোন ছোড়া হয়। এর বেশির ভাগই মাঝপথে ভূপাতিত হলেও তিনটির আঘাতে আটজন নিহত হয়।’
আইডিএফ আরও জানায়, প্রায় ৫০টি যুদ্ধবিমান ও ড্রোন একযোগে অভিযান চালিয়ে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র গুদাম, নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র ও সেনাদের অবস্থান লক্ষ করে হামলা চালায়। এর মধ্যে অনেক নিশানা ছিল ইরানের ইস্পাহান শহরে। সেখানেও শতাধিক সামরিক স্থাপনায় হামলা হয়েছে বলে জানায় ইসরায়েলি বাহিনী। তবে এসব দাবির বিষয়ে এখনো ইরান কোনো আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানায়নি।