বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরবর্তী গভর্নর হিসেবে নিয়োগ লাভ করেছেন। তার মতো একজন দক্ষ অভিজ্ঞ ব্যক্তির গভর্নর হিসেবে নিয়োগ লাভ অর্থনীতি এবং ব্যাংকিং খাতে নতুন আশার সঞ্চার করেছে। আহসান এইচ মনসুর বর্তমানে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক। আগে তিনি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি দেশের আর্থিক খাতের একজন বিশ্লেষক হিসেবে সুপরিচিত।
বাংলাদেশ ব্যাংক শুধু দুর্বল ব্যাংকগুলোকে টাকা দিয়েই ক্ষান্ত হয়নি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে রপ্তানি উন্নয়ন তহবিলের মাধ্যমে ডলার ধার দিয়েছে প্রভাবশালী উদ্যোক্তাদের। এসব ডলারের ঋণ খেলাপি হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক নথিতে দেখা গেছে, ২০ গ্রাহকের কাছেই আটকে আছে প্রায় ৭ কোটি ডলার। সদ্য সমাপ্ত গত জুলাইয়ের শেষে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে মোট বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ২ হাজার ৫৯২ কোটি ডলার। এর মধ্যে রপ্তানি উন্নয়ন তহবিলের দেওয়া আছে ২৬০ কোটি ডলার, যা বড় অংশই আবার সরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছে আটকে আছে। কিছু ব্যাংক কেন্দ্রীয় ব্যাংকের টাকায় টিকে আছে, আবার রিজার্ভ থেকে ঋণ নিয়েও অনেকে ফেরত দিচ্ছে না। এটাই ব্যাংক খাতের প্রকৃত পরিস্থিতি। আসলেই অবস্থা আরও খারাপ কি না, সেটা বের করা জরুরি। এ নিয়ে শ্বেতপত্র প্রকাশ করতে হবে। এরপর অগ্রাধিকার ঠিক করতে হবে কোন সংস্কার এখনই শুরু করা দরকার। ব্যাংক খাত সঠিক পথে ফিরিয়ে আনতে যেটা করা দরকার, তা এখনই শুরু করতে হবে। না হলে বড় বিপদ আসবে পুরো আর্থিক খাতে। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ব্যাংক খাতে শুরু হয়েছে বড় ধরনের অস্থিরতা। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দাবির মুখে সরে গেছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরসহ প্রায় পুরো নেতৃত্ব; দাবি উঠেছে বেশ কয়েকটি বেসরকারি ব্যাংকে পরিচালনা পর্ষদের পরিবর্তনেরও। এসব ব্যাংকে মালিকানা পরিবর্তনের চেষ্টা হচ্ছে ভিতর ও বাইরে থেকে। এ কারণে ব্যাংক খাতে অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়ছে। পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন না হয়ে থাকা যায় না। দ্রুততার সঙ্গে পরিস্থিতি সামাল দিতে হবে। একটি রোডম্যাপ বা পথনকশা তৈরি করে আর্থিক খাতকে বর্তমান সংকট থেকে বের করে আনতে হবে এবং এর ভবিষ্যৎ গতিপথ ঠিক করতে হবে। এ ক্ষেত্রে সাময়িক সময়ের জন্য ব্যাংক অধিগ্রহণ করার প্রয়োজন হলে সরকারকে সে পথেও হাঁটতে হবে। বর্তমান সংকটের শুরু ইসলামী ব্যাংক থেকে। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পরদিনই ইসলামী ব্যাংকের কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী ২০১৭ সালের মালিকানা পরিবর্তনের পর নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের বহিষ্কারের দাবি তোলেন। ওই বছরই ব্যাংকটি রীতিমতো দখল করে চট্টগ্রামভিত্তিক এস আলম গ্রুপ। এর মধ্যে ৭ আগস্ট নজিরবিহীন ঘটনা ঘটে বাংলাদেশ ব্যাংকে। কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী গভর্নরের ফ্লোরে গিয়ে দাবি করেন যে গভর্নর, চার ডেপুটি গভর্নর, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উপদেষ্টা ও আর্থিক গোয়েন্দা বিভাগের প্রধানদের পদত্যাগ করতে হবে। তাদের দাবির মুখে ছয় শীর্ষ কর্মকর্তা ‘পদত্যাগ’ করেন, পরে অবশ্য একজন ডেপুটি গভর্নরকে বিক্ষুব্ধ কর্মীরা সাময়িকভাবে দায়িত্বে থাকার ‘অনুমোদন’ দেন।
ইসলামী ব্যাংকের সংকটকে কেন্দ্র করে শেষ পর্যন্ত রক্ত ঝরেছে। এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর ব্যাংকে নিয়োগপ্রাপ্ত কেউ কেউ ব্যাংকে ঢুকতে চাইলে বাধা দেওয়া হয়। ঘটে সংঘর্ষ আর গুলির ঘটনা। বেসরকারি খাতের আরেক ব্যাংক আইএফআইসির চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমানের পদত্যাগ চেয়ে বিক্ষোভ হয়েছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এই উপদেষ্টাসহ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে তার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বেক্সিমকোর প্রতিনিধিত্বকারী সবাইকে সরে দাঁড়াতে বলেছেন আইএফআইসি ব্যাংকের চাকরিচ্যুত কর্মীরা। অস্থিরতা চলছে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক ও বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকেও। এরই মধ্যে পদত্যাগ করেছেন গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার, বিতর্ক যার কখনো পিছু ছাড়েনি। ফলে ব্যাংক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা কার্যত এখন নেতৃত্বশূন্য।

আওয়ামী লীগের একের পর এক ভুল নীতির কারণে দীর্ঘদিন ধরে অর্থনীতিতে যে সংকট চলছে, তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আর্থিক খাতের এই অস্থিরতা। ফলে ব্যাংক খাতের পরিস্থিতি কেবল নাজুকই হয়েছে। এই পরিস্থিতি থেকে আর্থিক খাতকে বের করে আনতে হলে সবার আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের নেতৃত্বের শূন্যতা পূরণ করতে হবে এবং এ কাজ করতে হবে দ্রুততার সঙ্গে। ইসলামী ব্যাংকসহ এস আলম গ্রুপের মালিকানায় থাকা ব্যাংকগুলোয় যে ভঙ্গুর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, তার বিস্তৃতি কতটা, তা জানতে নিরীক্ষা করা দরকার। এর ভিত্তিতে ঠিক করতে হবে, এসব ব্যাংকের সংস্কার কীভাবে হবে এবং শেষ পর্যন্ত এগুলোর দায়দায়িত্ব কার ওপর দেওয়া হবে। ইসলামী ব্যাংক এস আলম গ্রুপের হাতে থাকবে না- অর্থ উপদেষ্টার এমন ঘোষণা দেওয়া উচিত। এসব সিদ্ধান্ত হবে ‘নৈতিক ও অর্থনৈতিক’ এবং কোনোভাবেই তা ‘রাজনৈতিক’ হবে না। আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত কেউ যদি ভালোভাবে ব্যাংক পরিচালনা করেন, তাহলে কোনো সমস্যা নেই। মূল বিবেচ্য বিষয় হবে, মালিকরা কীভাবে ব্যাংক পরিচালনা করছেন। সার্বিকভাবে তহবিলের ঘাটতি ও দুর্বৃত্তায়ন থেকে ব্যাংক খাতকে মুক্ত করতে হবে। একটি কমিশন গঠন করে ব্যাংক খাতের সংস্কার করা দরকার। প্রয়োজনে ব্যাংকের সংখ্যা কমিয়ে আনতে হবে। ব্যাংক খাত সংস্কারে একটি কমিশন করা যেতে পারে। কমিশন গঠন হতে পারে দীর্ঘমেয়াদি একটি পদক্ষেপ, যার মাধ্যমে ব্যাংক খাতে যে সংস্কার কার্যক্রম দরকার, তা নিরূপণ করা হবে। তবে আশু পদক্ষেপ হিসেবে ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা ফেরানো, সুশাসন নিশ্চিত করা, নিয়ম মেনে ঋণ দেওয়া ও আস্থার ঘাটতি দূর করাতে হবে। এসব পদক্ষেপ নিতে পারলে ব্যাংক খাতে দৃশ্যমান উন্নতি হবে।
অর্থনীতির ফুসফুস হিসেবে কাজ করে ব্যাংক খাত। এটা প্রায় অচল হয়ে যাচ্ছে। এখন একটা ব্যাংক কমিশন গঠন করা দরকার। খেলাপি ঋণ আসলে কত, তা বের করা জরুরি। ব্যাংক থেকে একক ব্যবসায়ী কত ঋণ পাবেন, পরিচালনা পর্ষদে এক পরিবার থেকে কতজন থাকবেন, এগুলোর মূল্যায়নও দরকার। আরও দরকার খেলাপি গ্রাহকদের খেলাপি তালিকা থেকে বের হওয়ার নীতি এবং অবলোপন নীতি প্রণয়ন করা। অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি ভালো কাজ করে না। এখন ব্যাংক খাতের রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা দুটোই দরকার। ব্যাংক খাতকে ঠিক করতে গেলে সবার আগে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগটিকে বাদ দিতে হবে। কারণ, বিভাগটি গঠনই করা হয়েছে কর্তৃত্ব করার জন্য। এ খাতের জন্য একটা টাস্কফোর্স গঠন করা দরকার।
মুক্তিযুদ্ধের যে চেতনা এবং লক্ষ্যকে সামনে রেখে এ দেশের লাখ-কোটি মানুষ ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে শামিল হয়েছিল, সেই চেতনার বাস্তবায়ন কি হয়েছে এখনো, শোষণমুক্ত সামাজিক ন্যায়বিচারভিত্তিক শাসনব্যবস্থা কি কায়েম হয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশে? এ প্রশ্নগুলো এখন আমাদের নাড়া দিয়ে গেছে বারবার। যখন বাংলাদেশের ব্যাংক ব্যবস্থা তথা আর্থিক খাতে নানা কেলেঙ্কারির ঘটনাগুলো চোখের সামনে একের পর এক এসেছে, যখন ব্যাংক খাতে খেলাপি বেড়ে গিয়ে ভয়াবহ অবস্থায় পৌঁছেছে। রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় লুটপাটের মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যাংককে শোচনীয় পর্যায়ে নিয়ে গেছে একশ্রেণির প্রভাবশালী নেতা-কর্মীর দৌরাত্ম্য, অসৎ টাউট-বাটপার চরিত্রের ব্যবসায়ী, শিল্পপতি, ‘রাজনৈতিক বিবেচনায়’ সমাজের তথাকথিত হোমরা-চোমরা ব্যক্তিবর্গ। যখন গ্রামের অতি সাধারণ দরিদ্র কৃষক ব্যাংক থেকে নিয়ে তা যথাসময়ে পরিশোধে ব্যর্থ হওয়ায় পুলিশ তাদের কোমরে দড়ি বেঁধে থানায় আটক করে নিয়ে যায়। অথচ বড় বড় খেলাপির হাজার হাজার কোটি টাকা অনাদায়ী থাকার পরও তাদের বিরুদ্ধে তেমন জোরালো কোনো ব্যবস্থা নিতে সংকুচিত বিভিন্ন ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। বড় বিচিত্র মনে হয় স্বাধীন বাংলাদেশের এই বৈপরীত্যমূলক ব্যবস্থা। এর জন্যই কি বাংলাদেশ পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হয়েছিল ১৯৭১ এর ১৬ ডিসেম্বর? এ প্রশ্ন জাগে এ দেশের কোটি কোটি মানুষের হৃদয়ে। কে দেবে তার যথাযথ জবাব? নাকি তা নিভৃতে কেঁদে যাবে শুধু। স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার টানা ১৬ বছরের শাসনামলে দেশের অনেক প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করা হয়েছে। দেশে নিয়মনীতির বাইরে অনেক কিছুই হয়েছে। বিক্ষিপ্তভাবে সংস্কার না করে ব্যাংক খাতের কাঠামোগত সংস্কার করতে হবে। এজন্য সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে দৃঢ় রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত প্রয়োজন। দেশে স্বজনতোষী পুঁজিবাদের মাধ্যমে অভিজাত ব্যক্তিরা তাদের লক্ষ্য পূরণের জন্য ব্যাংকগুলোকে ব্যবহার করছে। ব্যাংকে অনেক শেয়ারহোল্ডার থাকলেও নিয়ন্ত্রণ করেছে একজনই। একজনের প্রভাবের কারণে ব্যাংকগুলো ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। অলিগার্করা (ধনী প্রভাবশালী গোষ্ঠী) সব জায়গা নিয়ন্ত্রণ করছে। পুরো ব্যাংক খাত ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে গেছে। ব্যাংকিং খাত সংক্রামক রোগে আক্রান্ত। ব্যবসায়ী, ব্যাংকের কিছু কর্মকর্তা ও সরকারের প্রভাবশালীরা মিলে জোট করে লুটপাট চালিয়েছে। এসব বিষয়ে খোলাখুলি আলোচনা না করলে প্রকৃত সমাধান হবে না। ব্যাংক খাতকে ঠিক করতে রাজনৈতিক সদিচ্ছা লাগবে। অর্থনীতি বিষয়ে সব রাজনৈতিক দলের ঐকমত্য থাকা দরকার। এর মধ্যে রাজনীতি খোঁজা উচিত নয়। শুরু হয়েছে নতুন সরকারের অভিযাত্রা। সামনে আছে অনেক চ্যালেঞ্জ। এখন অর্থনীতিতে শৃঙ্খলা ফেরাতে ব্যাংক খাত সংস্কার জরুরি হয়ে উঠেছে। এককথায় বলতে গেলে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের দক্ষ ব্যবস্থাপনায় ব্যাংকিং খাতে শৃঙ্খলা ফিরতে শুরু করেছে।
লেখক : সাবেক কর কমিশনার ও প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান-ন্যশনাল এফএফ ফাউন্ডেশন।