চলচ্চিত্র উন্নয়ন সংস্থা এফডিসির বয়স এখন প্রায় ৫৭ বছর। এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক বদল হয়েছে ৩৩ বার। কিন্তু সংস্থাটির ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হয়নি। বহুমুখী সমস্যায় জর্জরিত এফডিসি। ফ্লোর, মেকাপ রুম, কালার ল্যাব, প্রশাসনিক ভবনসহ পুরো সংস্থাটিই এখন শ্রীহীন ও সংস্কারবিহীন অবস্থায় পড়ে আছে। তাই এখানে বিদেশি অতিথিদের আমন্ত্রণ জানাতে গিয়ে বিব্রতকর অবস্থায় পড়েন চলচ্চিত্রকাররা। চলচ্চিত্র নির্মাণেও বেগ পেতে হচ্ছে তাদের। নেই অত্যাধুনিক ক্যামেরা, ডিজিটাল এডিটিং মেশিন ও অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি। চলচ্চিত্রকাররা এফডিসিকে এখন গোডাউন বলতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, সংস্থাটির উন্নয়নে সরকার কিংবা প্রশাসনের কোনো মাথাব্যথা নেই। গত এপ্রিলে এফডিসিতে ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে যোগদান করেছেন তথ্য মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব হারুন অর রশিদ। যোগ দেওয়ার পরপরই সংস্থার উন্নয়নে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে আধুনিকায়নের কাজ শুরু করেন তিনি। এ কাজের অংশ হিসেবে দীর্ঘদিন ঝুলে থাকা ক্যামেরা ও এডিটিং মেশিন ক্রয়ের ওয়ার্ক অর্ডার দেন তিনি। ফলে এলসি খোলা হয় এবং এ মাসের মধ্যে তিনটি সনি এফ ৫৫ ডিজিটাল ক্যামেরা এবং পাঁচ সেট এফসিও অফ ও অনলাইন ডিজিটাল এডিটিং মেশিন এসে পৌঁছার কথা রয়েছে।
হারুন অর রশিদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, এখন পাইপলাইনে থাকা কাজগুলো চলছে। আগামী মাস থেকে নতুন জিনিসপত্র ক্রয় এবং সংস্থার আধুনিকায়নের কাজ শুরু হবে। উল্লেখ্য, ২০১১ সালের ১৮ অক্টোবর একনেকের বৈঠকে এফডিসির আধুনিকায়ন সম্প্রসারণ প্রকল্প প্রস্তাব পাস হয়। এতে ব্যয় ধরা হয় ৫৯ কোটি ১৮ লাখ টাকা। তিন অর্থবছরে তিন কিস্তিতে এই টাকা দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু তিন অর্থবছর পার হয়ে গেলেও এফডিসির আধুনিকায়ন বা সম্প্রসারণ হয়নি। প্রশাসনের স্বেচ্ছাচারিতা এবং গাফিলতির কারণে সময়মতো কাজ না হওয়ায় প্রথম দুই অর্থবছরে কিস্তির সিংহভাগ টাকা সরকারের কাছে ফেরত যায়।
প্রকল্পের পরিচালক লক্ষ্মণ চন্দ্র দেবনাথ জানান, ফেরত যাওয়া টাকা অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে পুনরায় ফান্ড রিলিজ করানো হয়েছে। তা ছাড়া সংস্থার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে প্রকল্প বাস্তবায়নের শেষ সময় জুন ২০১৪ থেকে ডিসেম্বর ২০১৪ পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়েছে। আশা করা যাচ্ছে এই সময়ের মধ্যে প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন করা যাবে।
সংস্থাটিকে ডিজিটালের আওতায় আনার দাবি দীর্ঘদিনের। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে এখানে স্থাপিত বর্তমানে প্রায় নষ্ট মেশিনে জোড়াতালি দিয়ে কাজ চলছে। অথচ নতুন মেশিন আনা দূরে থাক, পুরনো অকেজো মেশিনও সংস্কার হয় না।
২০০৪ সালে ডিজিটাল কমপ্লেক্স স্থাপনের জন্য সরকার ২১ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়। কিন্তু সেই অর্থ লুটপাটের কারণে ডিজিটাল কমপ্লেক্সটি আলোর মুখ দেখেনি। একটি সাব টাইটেল মেশিন থাকলেও সেটি অকেজো। ছয় বছর আগে কোটি টাকা ব্যয়ে ডিটিএস মেশিন কেনা হলেও ত্রুটিপূর্ণ থাকায় তা সচল হয়নি। একই সময়ে কেনা ডিজিটাল এডিটিং মেশিনগুলোও অচল। কালার ল্যাবের মেশিনগুলো পুরনো হওয়ায় প্রায় সময় বিকল হয়ে যায়। যন্ত্রাংশ স্থানীয় বাজারে না থাকায় টেন্ডার আহ্বান করে বিদেশ থেকে আমদানি করতে গিয়ে অতিরিক্ত সময় লাগে। এফডিসির স্টোর ব্যবহার অনুপযোগী হওয়ায় সেখানে নষ্ট হয়ে গেছে কালজয়ী চলচ্চিত্রের সব নেগেটিভ ও প্রিন্ট। সাউন্ড নেগেটিভের অভাবে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে গিয়ে লোকসানে পড়তে হয় নির্মাতাদের। ঝরনা স্পটের ঝরনা অকেজো। সুইমিংপুল ময়লা আবর্জনায় ভর্তি। এফডিসির পুরো আঙিনাজুড়ে শুধুই আবর্জনার স্তূপ। যত্রতত্র পোস্টার লাগানো এবং চুনকাম না করায় শ্রীহীন অবস্থায় রয়েছে সংস্থার ভবন ও বাউন্ডারি দেয়ালগুলো।
এ বিষয়ে গত ১১ মার্চ বাংলাদেশ প্রতিদিনে একটি রিপোর্ট প্রকাশ হলেও সংস্থার টনক নড়েনি। তবে চলচ্চিত্র সহকারী উৎপাদন ব্যবস্থাপক সমিতি নিজ খরচে প্রায় এক মাস যাবৎ পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা অভিযান চালায়। কিন্তু এতে কারও সহযোগিতা না থাকায় তাদের একার পক্ষে দীর্ঘদিন এই কাজ অব্যাহত রাখা সম্ভব হয়নি। ফলে এফডিসি আবারও ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে।
নয়টির মধ্যে চালু সাতটি শুটিং ফ্লোরের অবস্থাও জরাজীর্ণ। প্রায় সময় ফ্লোরের ফলস সিলিং ও আস্তরণ খসে পড়ে আহত হন চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্টরা। মেকআপ রুমগুলোও অপরিচ্ছন্ন এবং এ সংলগ্ন টয়লেটগুলো নিয়মিত পরিষ্কার না করায় দুর্গন্ধে শিল্পীদের এখানে বসতে কষ্ট হয়। এ ছাড়া ৫৭ বছর বয়সী এ সংস্থাটির ভবনগুলো পুরনো হওয়ায় এগুলো ধসে পড়ার ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। এফডিসির প্রবেশদ্বারেই রয়েছে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ভাস্কর্য। এটি চরম অবহেলায় নোংরা আবর্জনার মধ্যে পড়ে আছে। জহির রায়হান কালার ল্যাবটি কেমিক্যালের বিরূপ প্রভাবে এর দেয়াল ও ছাদের আস্তরণ খসে পড়ছে এবং ভবনটি ধসের মুখে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেশ কজন চলচ্চিত্রকার বলেন, অত্যাবশ্যকীয় লোকের পরিবর্তে বহিরাগতদের দখলে রয়েছে এফডিসি। ঝরনা স্পট, কড়ইতলা, আমতলাসহ আনাচে-কানাচে অবাধে চলে অসামাজিক কর্মকাণ্ড। এঙ্ট্রা নারী শিল্পীর নামে অহরহ এখানে আনা হয় পতিতা। তা ছাড়া মাদকসেবনেরও আসর বসে প্রতিনিয়ত। অথচ সংস্থার প্রবেশদ্বারেই রয়েছে পুলিশ চৌকি এবং প্রায় ৩০ জন প্রহরী। চলচ্চিত্রকারদের অভিযোগ, এরা অর্থের বিনিময়ে যে কাউকে ভেতরে প্রবেশের সুযোগ করে দেয়। এতে শুটিং করতে গিয়ে সমস্যায় পড়তে হয় নির্মাতা-শিল্পীদের। পাস নিয়ে প্রবেশের বাধ্যবাধকতা থাকলেও এখন তার বালাই নেই। মেটাল ডিটেক্টর দিয়ে মানুষ এবং গাড়ি চেকের ব্যবস্থাও এখন আর নেই। ভেতরে পুলিশ এবং প্রহরীরা নামমাত্র টহল দেয়। খোদ প্রশাসনিক ভবনই রয়েছে শ্রীহীন অবস্থায় এবং এখানেও নেই কোনো নিরাপত্তা ব্যবস্থা। তাই ইচ্ছা করলেই বাইরের লোকজন সহজেই এখানে প্রবেশ করতে পারে।
চলচ্চিত্রকারদের কথায়, এখানে কোনো প্রশাসন আছে বলে মনে হয় না। প্রশাসনের নামে চলে দলবাজি আর গ্রুপিং। তাই প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড সবসময়ই স্থবির। মানে কেপিআইভুক্ত হওয়া সত্ত্বেও এফডিসির উন্নয়ন নিয়ে কারও মাথাব্যথা নেই।