লোকসান কাটাতে এখন যৌথ প্রযোজনার চলচ্চিত্র নির্মাণের দিকে ঝুঁকছেন নির্মাতারা। দেশে প্রেক্ষাগৃহ সংকট। উন্নত পরিবেশের অভাবে দর্শকরাও প্রেক্ষাগৃহ বিমুখ। একটি ছবি নির্মাণে কমপক্ষে দেড় কোটি টাকা ব্যয় হয়। কিন্তু প্রেক্ষাগৃহ সংকট ও দর্শকের অভাবে মুনাফা দূরে থাক মূল টাকাই ফেরত আসে না। এ অবস্থায় যৌথ আয়োজনে কলকাতার সঙ্গেও চলচ্চিত্র নির্মাণ করলে এবং দুই বাংলায় চলচ্চিত্রটি মুক্তি পেলে অন্তত মূল টাকা ফেরত আসার নিশ্চয়তা থাকে। এমন বক্তব্য স্থানীয় চলচ্চিত্র প্রযোজকদের।
আগামীকাল দুই বাংলায় একসঙ্গে মুক্তি পাচ্ছে যৌথ প্রযোজনার চলচ্চিত্র 'রোমিও বনাম জুলিয়েট'। এটি প্রযোজনা করেছে ঢাকার জাজ মাল্টিমিডিয়া ও কলকাতার এস কে মুভিজ। জাজ মাল্টিমিডিয়ার কর্ণধার মো. আজিজ বলেন, মানসম্মত ছবি নির্মাণে বিগ বাজেটের প্রয়োজন। কিন্তু বড় অঙ্কের টাকা বিনিয়োগ করে এ দেশ থেকে মূল টাকাই উঠিয়ে আনা যায় না। কারণ প্রেক্ষাগৃহ সংকট। 'রোমিও বনাম জুলিয়েট' ছবিটি নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ৫ কোটি টাকা। এটি কলকাতার ১৭৬ ও এ দেশে শতাধিক প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পাবে। ফলে যৌথ প্রযোজনায় ছবি নির্মাণ করলে ব্যবসায়িক ঝুঁকি আর থাকে না। তাই মুনাফা না হোক, মূল টাকা তো ফেরত আনতে যৌথ প্রযোজনার নির্মাণ উত্তম।
গত বছরের ১৬ মে যৌথ প্রযোজনায় অনন্য মামুন ও অশোকপতি নির্মিত 'আমি শুধু চেয়েছি তোমায়' চলচ্চিত্রটি দেশের ৬৭টিসহ কলকাতার দেড় শতাধিক প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পায়। বিগ বাজেটের ছবিটি ছিল গত বছরের বড় মাপের একমাত্র ব্যবসাসফল ছবি। নির্মাতা অনন্য মামুন বলেন, দুই বাংলায় একসঙ্গে মুক্তি দেওয়ায় বেশি প্রেক্ষাগৃহ পাওয়া গেছে। ফলে বড় অঙ্কের লাভের মুখ দেখেছে ছবিটি। যশোরের মণিহার প্রেক্ষাগৃহে প্রথমদিনের আয় রেকর্ড গড়ে। এ দিন টিকিট বিক্রি হয়েছে ২ লাখ ২১ হাজার টাকার। অন্য প্রেক্ষাগৃহগুলোরও একই চিত্র। যৌথ প্রযোজনার এ ছবির এমন সাফল্যে প্রেক্ষাগৃহ মালিকরাও খুশি। আনন্দ'র ব্যবস্থাপক শামসুল ইসলাম বলেন, দীর্ঘদিন পর লাভের মুখ দেখলাম। লোকসান গুনতে গুনতে আমাদের অবস্থা নাভিশ্বাস উঠেছে। এ ধরনের ছবি পেলে প্রেক্ষাগৃহ সংশ্লিষ্টরা বেঁচে যাবে। অন্য প্রেক্ষাগৃহ কর্তৃপক্ষেরও একই কথা। এই সাফল্যে উজ্জীবিত নির্মাতারাও। তারা চাচ্ছেন বেশি করে যৌথ আয়োজনের ছবি নির্মাণ হোক। এ কারণে অর্ধ ডজনের বেশি যৌথ আয়োজনের চলচ্চিত্র আসছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে শাকিব খান প্রযোজিত দুটি ছবি। হাসিবুর রেজা কল্লোলের 'সত্তা'। উত্তম আকাশের 'ঢাকার ছেলে কলকাতার মেয়ে'। অনন্য মামুন নির্মাণ করবেন জিৎকে নিয়ে একটি ছবি। চলচ্চিত্রকারদের মতে এ সংখ্যা ক্রমেই বাড়বে।
প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার ছটকু আহমেদ বলেন, কয়েক দশক ধরে ঢাকার চলচ্চিত্রের ব্যবসা ভালো না। মাঝেমধ্যে দুএকটি চলচ্চিত্র ব্যবসা করলেও সেই সফলতার ধারা অব্যাহত থাকছে না। এতে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে প্রেক্ষাগৃহ। নব্বই দশকের মধ্যভাগ পর্যন্ত দেশে প্রেক্ষাগৃহের সংখ্যা ছিল প্রায় ১২০০। এই সংখ্যা কমে এখন চারশ'র ঘরে এসে ঠেকেছে। প্রেক্ষাগৃহের মালিক তো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেই এর কর্মকর্তা-কর্মচারীও বেকার হয়ে বেশির ভাগ মানবেতর জীবনযাপন করছেন। অন্যদিকে চলচ্চিত্র নির্মাতা, শিল্পী, কলা-কুশলীদেরও একই অবস্থা। কাজের অভাবে অনেকেই উপোস করছে। এ অবস্থায় যৌথ প্রযোজনার ছবি নির্মাণ হলে চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্টরা বেঁচে যাবে। কারণ যৌথ আয়োজনের ছবির মান উন্নত থাকে বলে এর প্রতি স্বাভাবিকভাবেই দর্শক আগ্রহ দেখা দেয়। তা ছাড়া যৌথ প্রযোজনা নতুন কিছু নয়। স্বাধীন দেশে এ পর্যন্ত অর্ধশতেরও বেশি যৌথ আয়োজনে ছবি নির্মাণ হয়েছে। শুধু ভারত নয়, প্রতিবেশী অনেক দেশের সঙ্গে যৌথভাবে ছবি নির্মাণ হয়েছে এবং হতে পারে।
নায়করাজ রাজ্জাক বলেন, ২০১২ সালে ডিজিটাল প্রযুক্তির চলচ্চিত্র নির্মাণ এবং প্রদর্শন শুরু হলে দর্শক আবার আগ্রহ নিয়ে প্রেক্ষাগৃহে ফিরতে থাকে। কিন্তু এই প্রযুক্তিতে নির্মাণ ব্যয় কমে আসার সুযোগে কতিপয় অসাধু নির্মাতা চলচ্চিত্রের নামে টেলিফিল্ম নির্মাণ করে দর্শকদের আবার প্রেক্ষাগৃহ বিমুখ করেছে। তাই শত চেষ্টা করেও চলচ্চিত্রের সুদিন স্থায়ী করা যাচ্ছে না। এ অবস্থায়, যৌথ প্রযোজনার চলচ্চিত্র নির্মাণ করে এ দেশের চলচ্চিত্র শিল্প ও প্রেক্ষাগৃহ বাঁচানো যেতে পারে।