আম্মার সঙ্গে এক মিনিটও কথা হয়নি। এর মধ্যেই বেঁজে উঠে অফিসিয়াল ফোনটা। ফোন ধরি। কোভিড-১৯ এর খবর। কিচ্ছু বললাম না আম্মাকে। ছুটলাম খবরের সত্যতা যাচাই আর লকডাউনের তদারকি করতে।
সব মায়েরা যদি জানতো মৃত্যুভয়কে কতোটা তুচ্ছ করে তাদের সন্তানরা ছুটে চলছে অজানা উপত্যকার দিকে, নিজের জীবনের মায়া না করে কতোটা দায়িত্বশীল ভূমিকা নিয়ে তাদের সন্তানরা আলিঙ্গন করে যাচ্ছে চলমান রুঢ় বাস্তবতাকে, কতোটা ভয়-ভীতি-আতঙ্ককে সঙ্গে নিয়ে আঁধারের এই যুদ্ধে আলো-জাগানিয়া ঝলমলে দিনের জন্য কাজ করছে তাদের সন্তানরা;
মায়ের মন তো- তাই হয়তো ভেতরে ভেতরে ডুকরে কেঁদে উঠবে তাদের কোমল মন, চোখ ভরে উঠবে লোনা জলে, প্রার্থনায় আশীষ নামবে জায়নামাজে, পূজোর ঘরে কিংবা মনের উপাসনালয়ে।
গাড়ি চলছে। আকাশটা খানিক মেঘলা হয়ে এসেছে। খুব মনে পড়ছে আম্মাকে। মায়াময় দুটো হাত দিয়ে চুল আঁচড়ে দেওয়া-ঝুম বৃষ্টিতে স্কুল থেকে ভিজে বাড়ি ফিরলে স্নেহমাখা আঁচল দিয়ে গায়ের পানি মুছে দেওয়া-কালবৈশাখী ঝড়ের সময় আয়াতুল কুরসী পড়ে বুকে ফু দেওয়া-নানা বাড়ি যাওয়ার সময় ঘরভাঙ্গু চাচার ভ্যানে উঠে ভেলাজানের ভক্তি নদীর গল্প শোনাসহ আরও অনেক কিছুই ভেসে আসছে গহীন থেকে। খুব মনে পড়ছে আম্মাকে। খুউউউউব।
ক্ষণিক বাদে ফের ফোন দিলাম আম্মাকে। ওপাশ থেকে সেই চিরচেনা, চির আপন, চির মমতাভরা কণ্ঠ-'ভালো আছিস বাবু? তোদের জন্য সারাক্ষণ টেনশন হয়। সাবধানে থাকিস সব সময়। আমি একটু আগে সূরা ইয়াসিন, সূরা রহমান পাঠ করে তোদের জন্য, সবার জন্য দোয়া করলাম। তোর যে চাকরির ধরণ সব সময় মানুষের সংস্পর্শে যাওয়া লাগে। নিরাপদে কাজ করিস বেটা। ভয় পাস না। আল্লাহ আছে উপরে।
কোথায় যাচ্ছিসরে বাবু এই অসময়ে, গাড়িতে নাকি তুই?
- হ্যাঁ আম্মা।
-দাঁড়া কথা বলিস না। আমি আয়াতুল কুরসী পড়ে দেই।
আম্মা আয়াতুল কুরসী পড়তে থাকে।
আর আমি ডায়েরিতে থাকা নিকোলাস বর্নের লেখা ডার্করুম কবিতাটির সঙ্গে কথা বলি আনমনে-
'যতক্ষণ না কেউ তোমাকে দেখতে পাচ্ছে
তোমার উপর আলো এসে পড়ছে
তুমি জলে ভিজছ, ঘামে ভিজছ,
বরফের মধ্যে ডুবে যাচ্ছ
ততক্ষণ
আসলে তুমি
একটা অন্ধকার ছাড়া আর কিছু নও'
নিকোলাস, তুমি জেনে নিও- অন্ধকারের পরেই কিন্তু আসে রোদ ঝলমলে আলো।
কারণ-
আমাদের
উপরওয়ালা দেখছেন।
মা দেখছেন
জলে ভিজে, ঘামে ভিজে, বরফে ডুবে হলেও আমরা সবাই মিলে আলো আনবো।
আলো আসবেই
আলোকে আসতেই হবে।
আশা জাগানিয়া আলো।
ঝলমলে আলো।
(ফেসবুক থেকে সংগৃহীত)
লেখক: অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (দক্ষিণ খান জোন)
বিডি প্রতিদিন/আরাফাত