২৪ জুন, ২০১৮ ১২:৫১

ঐতিহ্যের স্মারক ‘পানাম নগর’

সাইফুল ইসলাম বেগ, সোনারগাঁ (নারায়ণগঞ্জ) থেকে ফিরে:

ঐতিহ্যের স্মারক ‘পানাম নগর’

বাংলার ঐতিহ্যের স্মারক মধ্যযুগীয় শহর পানাম নগরী। লোনা ইট-কালো পাথরের টেরাকোটা ধূসর স্মৃতি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ঈশা খাঁর প্রতিষ্ঠিত বাংলার প্রথম রাজধানী সোনারগাঁর উপশহর ‘পানাম নগরী’তে এখন ভ্রমণ পিপাসুদের পদচারণা বেড়েছে। ঔপনিবেশিক ধাঁচের সারি-সারি দোতলা ও একতলা বাড়ি। আছে নিখুঁত নকশার উপাসনালয়, গোসলখানা, পান্থশালা, দরবার হল ও নাচঘরের অবশিষ্টাংশ।

বাংলার প্রচীনতম শহর ‘পানাম নগরী’র এ চিত্র এখন দেশি-বিদেশি পর্যটকদের মুগ্ধ করছে রোজ। নগরের আশপাশের সর্দার বাড়ি, ঈশা খাঁর তোরণ, নীলকুঠি, বণিক বসতি, ঠাকুর বাড়ি, পানাম নগর সেতু ও নান্দনিক লোকশিল্প যাদুঘর হয়ে উঠেছে আকর্ষণের প্রতীক। শহরের প্রতিটি ইট-পাথরে লেগে থাকা এক একটি ইতিহাস-ঐতিহ্যের গল্প জানতে ও কয়েক শতাব্দী পুরনো ঔপনিবেশিক স্থাপত্যশৈলী দেখতে ওখানে লেগেই আছে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের ভিড়। 

ইতিহাস থেকে জানা যায়, পানাম নগরী পৃথিবীর ১০০টি ধ্বংসপ্রায় ঐতিহাসিক শহরের একটি। হাজার বছরের প্রাচীন নগর সুর্বণগ্রাম ছিল পূর্ব বাংলার অন্যতম রাজধানী ও নদীবন্দর। এই সূর্বণ গ্রামেই ১৩ শতকের স্থানীয় হিন্দুরাজা ধনুজমাদব দশরথদেব তার শাসন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন। ১৫ শতকে ঈসা খাঁ বাংলার প্রথম রাজধানী স্থাপন করেন সোনারগাঁয়ে। এখানে নদী পথে আসতো বিলাতি থানকাপড়, দেশ থেকে যেতো বিশ্ব সমাদৃত মসলিন কাপড়। সেই সময়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর বাণিজ্যিক কার্যক্রম ও চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে ইউরোপীয় অনুপ্রেরণায় ঔপনিবেশিক স্থাপত্যরীতিতে সোনারগাঁর ২০ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে গড়ে উঠে পানাম নগরী। ধনাঢ্য হিন্দু বণিকদের দ্বারা পানাম নগরের গোড়া পত্তন ঘটে। প্রাচীন সোনারগাঁয়ের বড় নগর, খাস নগর, পানাম নগর এই তিন নগরীরর মধ্যে পানাম ছিলো সবচেয়ে আকর্ষণীয়।

বাংলাদেশ সরকার সংরক্ষণ ও সংস্কারের মাধ্যমে বাংলার ইতিহাস, কৃষ্টি, ঐতিহ্য ও লোকজ সংস্কৃতিতে ভরপুর এ নগরকে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে। নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ে অবস্থিত ঐতিহাসিক এ শহরের প্রবেশ মুখেই চোখে পড়ে বই আকৃতির ফলক। ফলকে বাংলা ও ইংরেজীতে লেখা সংক্ষিপ্ত ইতিহাস। এর ডান রয়েছে ‘পনাম সিটি’ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর। পানাম নগরী চিরে চলে যাওয়া সড়কের দু’পাশে সারি সারি আবাসিক একতলা ও দ্বিতল বাড়িতে ভরপুর। আছে ছোট-বড় পুকুর-হ্রদ। নগরীর ভিতরে আবাসিক
ভবন ছাড়াও রয়েছে মসজিদ, মন্দির, গীর্জা, মঠ, গোসলখানা, নাচঘর, পান্থশালা, চিত্রশালা, খাজাঞ্চিখানা, দরবার, গুপ্তপথ, বিচারালয়। আছে ৪০০ বছরের পুরোন টাঁকশাল বাড়ি। সোনারগাঁ লোকশিল্প জাদুঘর থেকে পশ্চিম দিকে রয়েছে গোয়ালদী হোসেন শাহী মসজিদ। এ মসজিদটি সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহীর শাসনামলে নির্মিত হয়। মোগড়াপাড়া চৌরাস্তা দিয়ে একটু দক্ষিণ দিকে গেলে রয়েছে আরো কিছু ইমারত, বারো আউলিয়ার মাজার, হযরত শাহ ইব্রাহিম দানিশ মন্দা ও তাঁর বংশধরদের মাজার, দমদম গ্রামে অবস্থিত দমদমদুর্গ। 

এছাড়াও নগরীর আশেপাশে ছড়িয়ে আছে ঈসা খাঁ ও তাঁর ছেলে মুসা খাঁর প্রমোদ ভবন, ফতেহ শাহের মসজিদ, সোনাকান্দা দুর্গ, পঞ্চপীরের মাজার, কদম রসুল, চিলেকোঠাসহ বহু
পুরাতাত্ত্বিক গুরুত্ববহ স্থাপনা। নগরের আরেক র্কীতি অত্যাধুনিক তিনতলা বিশিষ্ট পানামা শিল্পাচার্য জয়নুল লোক ও কারুশিল্প জাদুঘর। যাদু ঘরের প্রতিটি তলায় রয়েছে প্রচীন আমলে ব্যবহৃত আসবাবপত্র, পালকি, বাদ্যযন্ত্র, কুঁটির শিল্প, কাঠের তৈরি মানুষ ও জীবজন্তু, নারীদের বিচিত্র অলংকারের সমাহার। যাদু ঘরের সম্মুখে স্থান পেয়েছে জাতীর জনক বঙ্গবন্ধু’র প্রতিকৃতি, চারপাশে রয়েছে ছোট-বড় পুকুর ও হ্রদ, বাঁশের সাঁকো, গ্রামীণ কারুকার্য, আছে শিশু শেখ রাসেলের প্রতিকৃতিও। পর্যটকদের নিরাপত্তায় সিসিটিভি বেষ্টিত পুরো এলাকায় দায়িত্ব পালন করতে দেখা গেছে আনসার সদস্যদের।

পানাম নগর দেখতে আসা জাতীয় কৃষি পদক প্রাপ্ত চাষী সিলেটের বেলাল আহমদ ইমরান বলেন,  নিঃসন্দেহে এটি আমাদের জন্যে আকর্ষণীয় স্থান। বাংলার প্রচীন এ ঐতিহ্য আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্যে টিকিয়ে রাখতে সংশ্লিষ্টদের আরো যত্নবান হওয়া জরুরি।


বিডি প্রতিদিন/২৪ জুন ২০১৮/হিমেল

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর