১৬ নভেম্বর, ২০২১ ১৫:৪৮

‘আগুন পাখি’ আর উঠে দাঁড়াবে না

মর্তুজা নুর, রাবি

‘আগুন পাখি’ আর উঠে দাঁড়াবে না

কথাসাহিত্যিক অধ্যাপক হাসান আজিজুল হক

‘সকাল হোক, সূর্যের আলোর দিকে চেয়ে আবার উঠে দাঁড়াবো আমি। একা।’ ‘আগুন পাখি’ উপন্যাসে কথাটি বলেছিলেন লেখক হাসান আজিজুল হক। দেশভাগ, মন্বন্তর, দাঙ্গা, সর্বোপরি সামগ্রিক ভেদ জ্ঞানের বিরুদ্ধে হাসান আজিজুল হক তাকে দাঁড় করান, ধ্বংসস্তূপে দাঁড়িয়ে সে মুখোমুখি হয় নতুন দিনের লাল সূর্যের, আর আমরা আভাস পাই দৃপ্ত পুনর্জাগরণের-ঠিক যেন পুরাণের ফিনিক্স-আগুনপাখি!

কিন্তু সেই ‘আগুন পাখি’ উপন্যাসের লেখক অধ্যাপক হাসান আজিজুল হক আর কখনো উঠে দাঁড়াবেন না।

ভক্তদের শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও অশ্রুসিক্ত নয়নে বিদায় নিলেন বাংলা কথাসাহিত্যে ‘আগুন পাখি’ খ্যাত ছোট গল্পের রাজপূত্র অধ্যাপক হাসান আজিজুল হক। সোমবার রাত ৯টা ১৫ মিনিটে মৃত্যুবরণ করেন তিনি। আজ মঙ্গলবার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে চির নিদ্রায় শায়িত করা হয় তাকে। সেখানে দুপুর আড়াইটায় লেখকের দাফন সম্পন্ন হয়। এর আগে জোহরের নামাজ শেষে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদ প্রাঙ্গণে জানাজা নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে অংশগ্রহণ লেখকের হাজারো ভক্ত। জানাজা নামাজের আগে দুপুর ১২টায় লেখকের মরদেহ নেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনারে। সেখানে লেখকের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন শিক্ষক, শিক্ষার্থী, লেখক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক নেতারা।

তারা বলেন, হাসান আজিজুল হক বাংলাদেশের জাতীয় জীবনের জন্য একজন হীরকখণ্ড ছিলেন। তার মৃত্যুতে যে শূন্যতা তৈরি হলো তা সহজে পূরণ হবার নয়। তার চেতনা ও মূল্যবোধ জাতির বিবেককে বহুকাল ধরে জাগ্রত রাখবে। তিনি সবার আলোকবর্তিকা হয়ে থাকবেন।  

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক গোলাম সাব্বির সাত্তার বলেন, হাসান আজিজুল হকের চলে যাওয়া এক বিশাল নক্ষত্রের পতন। তার চলে যাওয়াতে বাংলা শিল্প-সাহিত্য এক বড় অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়লো। তবে তিনি তার অবদানের জন্য বাঙালির হৃদয়ে চিরজাগরূক থাকবেন। জাতি তার অবদান চিরকাল স্মরণ করবে।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও যুক্তরাজ্যে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক হাই কমিশনার অধ্যাপক সাইদুর রহমান খান বলেন, দীর্ঘদিন ধরে হাসান আজিজুল হকের সঙ্গে আমাদের চলাফেরা। এক সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের হাউজিং সোসাইটিতে ছিলাম। এত বড় সাহিত্যিক হলেও ব্যক্তিজীবনে খুবই সাদামাটা জীবন যাপন করতেন তিনি। তার এ মৃত্যুর জন্য আমরা প্রস্তুত ছিলাম না।  

১৯৩৯ সালে পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমানে যবগ্রামে জন্ম আজিজুল হকের। দেশভাগের সময় পশ্চিমবঙ্গ ছেড়ে পূর্ববঙ্গে চলে যায় তার পরিবার। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শন নিয়ে স্নাতকস্তরের পড়াশোনা শুরু করেন তিনি। জড়িয়ে পড়েন রাজনীতিতেও। পাকিস্তান সেনার হাতে নির্যাতিত হওয়ার কাহিনি নিজেই বলেছেন লেখায় এবং সভা সমিতিতে। পরবর্তীকালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়েই অধ্যাপনার কাজ শুরু করেন।

১৯৬০ এর দশক থেকেই লেখালেখির কাজ শুরু করেন আজিজুল হক। তবে তার প্রথম উপন্যাস প্রকাশিত হয় ২০০৬ সালে। আগুন পাখির প্রেক্ষাপটে উঠে এসেছে অবিভক্ত রাঢ়বঙ্গের আখ্যান। রাজনীতি, সাম্প্রদায়িকতা, অনাহার, মহামারি। সমসময়ের বাংলা উপন্যাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এই আখ্যান দুই বঙ্গেই সাড়া ফেলে দিয়েছিল। পশ্চিমবঙ্গে তাকে এই লেখার জন্য আনন্দ পুরস্কার দেওয়া হয়। পূর্ববঙ্গে বহু পুরস্কার এবং সম্মান পেয়েছেন তিনি। একুশে পদক অর্জন করেছেন। পাশাপাশি বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, স্বাধীনতা পুরস্কার পেয়েছেন তিনি।

গত অগাস্ট মাস থেকে বার্ধক্যজনিত সমস্যায় ভুগছিলেন আজিজুল হক। সুগারের সমস্যা ছিল, হার্টের সমস্যাও হয়েছিল। ২১ অগাস্ট এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে তাকে ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। চিকিৎসায় সাড়া দিয়েছিলেন তিনি। সেপ্টেম্বরে বাড়ি ফিরে গেছিলেন। কিন্তু সম্পূর্ণ সুস্থ হননি। বাড়িতেই চিকিৎসা চলছিল। মাঝে পড়ে গিয়ে কোমরেও চোট পেয়েছিলেন।

কথাসাহিত্যিকের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি মঙ্গলবার সকালে শোকবার্তা প্রকাশ করেছেন। শোকের ছায়া নেমে এসেছে পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্য মহলে।

বিডি-প্রতিদিন/বাজিত হোসেন

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর