মঙ্গলবার, ১১ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ ০০:০০ টা

বন্ডে ৮০ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব ফাঁকি

কাপড় প্লাস্টিক সুতা ও কাগজ শিল্প হুমকিতে, আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর নজরদারি নেই, অনিয়ম বন্ধে দুদকের তদন্ত জরুরি, দ্রুত সেন্ট্রাল বন্ড চালুর দাবি ব্যবসায়ীদের

রুহুল আমিন রাসেল

বন্ডে ৮০ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব ফাঁকি

বন্ডেড ওয়্যারহাউস সুবিধা অপব্যবহারের কারণে প্রতি বছর প্রায় ৮০ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব ফাঁকির তথ্য দিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। তাদের অভিযোগ, বন্ড লাইসেন্সধারীদের ওপর কাস্টমস ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর কার্যকর নজরদারি নেই। ফলে চোরাচালানে জড়িত বন্ডের ৬৭ মাফিয়ার কাছে জিম্মি দেশীয় কাপড়, এক্সেসরিজ, সুতা, কাগজ, প্লাস্টিক শিল্প খাতসমূহ। এই মাফিয়াদের গডফাদার পুরান ঢাকার আবুল হোসেন ওরফে বন্ড আবুল, সুজন, বাশার ও তাদের সিন্ডিকেট দীর্ঘদিন ধরাছোঁয়ার বাইরে। ব্যবসার আড়ালে বন্ডের অনিয়ম বন্ধে জরুরি ভিত্তিতে দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদকের তদন্ত দাবি করেছেন ব্যবসায়ী নেতারা। অনুসন্ধানে জানা গেছে, রাজধানীর ইসলামপুর ও নয়াবাজারে এ সিন্ডিকেটের মাফিয়া-গডফাদাররা প্রতি বছর সরকারকে বিপুল পরিমাণ রাজস্ববঞ্চিত করছে। হুন্ডির মাধ্যমে তারা অর্থ পাচার করে অবৈধভাবে কাগজ ও কাপড় আনছে। এ মাফিয়াদের কারণে টেক্সটাইল, কাগজ, প্লাস্টিক, দেশীয় বিভিন্ন শিল্প হুমকির মুখে পড়েছে। তারা চোরাচালান বাণিজ্যে আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়েছে। এ সিন্ডিকেটের অন্যতম হোতা আবুল মার্কেটের সানফ্লাওয়ার ট্রেডিংয়ের মালিক আবুল হোসেন ওরফে বন্ড আবুল, নুরজাহান মার্কেটের ফনিক্স ইন্টারন্যাশনালের মালিক আবদুর রহিম, ফাল্গুনী ট্রেডার্সের মালিক আবুল কালাম সুমন, গ্লোডেন বার্ড ইন্টারন্যাশনালের মালিক অনিল, খালেদ ইন্টারন্যাশনালের মালিক আবদুল মতিন জুয়েল, আলম ট্রেডিংয়ের মালিক আলমগীর হক, বিনিময় পেপারের মালিক দুলাল, রহমত এন্টারপ্রাইজের মালিক রহমত, চৌধুরী মার্কেটের সুজন, হক ট্রেডিংয়ের মালিক জাহাঙ্গীর, সোনা মিয়া মার্কেটে সিটি পেপারের মালিক বাসার, উরিচর মার্কেটের সিয়াম অ্যান্ড সেফা দোকানের মালিক সেলিমসহ অন্য মাফিয়ারা এতটাই প্রভাবশালী যে, তাদের অপকর্ম থামাতে পারছে না কেউ। বন্ড মাফিয়া হিসেবে চিহ্নিত একেকজন রাঘব-বোয়ালের ৮-১০টি পর্যন্ত প্রতিষ্ঠান রয়েছে। তাদের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের অনুকূলেই বন্ড সুবিধার আওতায় কোটি কোটি টাকার পণ্য খোলাবাজারে ছাড়ার সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে।

সূত্র জানান, বন্ডসংক্রান্ত অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত হলেও বারবার একই অপরাধে জড়িয়ে থাকা ৬৭টি প্রতিষ্ঠানকে এ পর্যন্ত চিহ্নিত করা হয়েছে। তবে অন্যান্য মামলা ও অভিযানে জব্দ পণ্যের সূত্র ধরে মাফিয়াদের সুনির্দিষ্ট করার কার্যক্রম চলছে এখনো। ৬৭ বন্ড মাফিয়ার বিরুদ্ধেই বিভিন্ন সময় জাল জালিয়াতি ও বন্ড লুটপাটের অভিযোগে একাধিক মামলা রুজু হয়েছে। দফায় দফায় অভিযানে তাদের গুদাম ও গাড়িবহর থেকেই জব্দ করা হয়েছে শত শত কোটি টাকার মালামাল। কিন্তু মামলা সুরাহার ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রতার কারণে মাফিয়াদের এখন পর্যন্ত কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করা যায়নি। তবে সংকট উত্তরণে দ্রুত সেন্ট্রাল বন্ডেড ওয়্যারহাউস ব্যবস্থা চালুর দাবি জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ পেপার মিলস অ্যাসোসিয়েশন-বিপিএমএ মহাসচিব মুস্তফা কামাল মহিউদ্দিন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘বন্ড একটা অভিশাপ। দীর্ঘদিন যাবৎ কোনো সমাধান দেখছি না। বন্ডের অপব্যবহারের কারণে প্রতি বছর ৭০ থেকে ৮০ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব ফাঁকি বা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বন্ডাররা অত্যন্ত শক্তিশালী হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে আইনের প্রয়োগ জরুরি। কাগজশিল্পের ৭০ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সরকারের এখানে বড় ভূমিকা আছে।’ তিনি বলেন, ‘বন্ড অপব্যবহারকারীদের বিরুদ্ধে সরকারের অ্যাকশন চাই। সুনির্দিষ্টভাবে বন্ডের অপব্যবহার বন্ধ করতে হবে। সরকারের দ্রুত অ্যাকশন ও কাস্টমস, পুলিশ, র‌্যাব এবং দুদকের অঙ্গীকার থাকতে হবে।’ তার মতে, বন্ডারদের কারণে শিল্প বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। রাজস্ব আদায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। সরকারের প্রত্যাশিত লক্ষ্য ব্যাহত হচ্ছে।

বিপিএমএর তথ্যমতে, দেশে সাড়ে ৬ হাজার বন্ড লাইসেন্সধারী প্রতিষ্ঠানের মধ্যে আড়াই হাজারই কালো তালিকাভুক্ত। তাদের মধ্যে ৪ শতাধিক প্রতিষ্ঠান পণ্য আমদানি করে চোরাচালান করছে। কাগজশিল্পে ৭০ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগে ১০ লাখ লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে। ১৩০টি কাগজকলে ১৫ লাখ টন উৎপাদন ক্ষমতা থাকলেও তা হচ্ছে না। কিন্তু বন্ডের অপব্যবহারের কারণে মাত্র ৩ থেকে ৪ লাখ টন কাগজ বাজারে সরবরাহ করা যাচ্ছে। বাকি উৎপাদন ক্ষমতা ব্যবহার করা যাচ্ছে না। কাস্টমস ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থা মাঝেমধ্যে অভিযান চালাচ্ছে। কিন্তু অভিযানের ধারাবাহিকতা থাকছে না। কার্যকর অভিযান হলে অসৎ ব্যবসায়ীরা ধরা পড়তেন। এ ক্ষেত্রে কাস্টমসের সক্রিয় ভূমিকা দরকার। চোরাচালানে জড়িত ওইসব প্রতিষ্ঠান ডুপ্লেক্স বোর্ড, পেপার বোর্ড, হোয়াইট কালার, আর্ট কার্ড, লাইনার পেপার, কার্ড বোর্ড, ক্রাফট, ব্রাউন লাইনার পেপার, মিডিয়া পেপার, টিস্যু পেপার, শার্টিং, পেপার রিবন, কার্টন, মারকার পেপার, সিকিউরিট ট্যাগ, স্টিকার ইত্যাদি কাগজ-জাতীয় পণ্য আমদানি করছে। বিপিএমএ জানিয়েছে, দেশের বার্ষিক বাজেটের ঘাটতি পূরণে রাজস্ব আয় ভূমিকা রাখে। বন্ডের অপব্যবহারের কারণে প্রতি বছর ৭০ থেকে ৮০ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব ফাঁকি বা সরকার ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এ টাকা সরকারি কোষাগারে জমা হলে দেশ ও মানুষ উপকৃত হতো। এ ক্ষেত্রে কাস্টমস ও সরকারের আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো কার্যকর ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হলে মারাত্মক ক্ষতির শিকার হবে দেশ। বন্ডের অপব্যবহারে দেশীয় শিল্প খাত ধ্বংসের মুখে পড়েছে। অথচ সরকার বন্ড সুবিধা দিয়েছে রপ্তানি আয় বাড়িয়ে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের জন্য। কিন্তু তার পরিবর্তে বন্ড অপব্যবহারকারীরা অর্থনীতির ক্ষতি করছে। এখন সরকার ক্ষতির বিষয়টি গুরুত্ব না দিলে ভবিষ্যতে বড় সংকটে পড়বে শিল্প খাত।

জানা গেছে, বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের একটি টেন্ডার হয় গত বছর ২৪ এপ্রিল। এতে বন্ড সুবিধার পণ্য চোরাচালান করে ওই টেন্ডারে অংশ নেয় আল মুসলিম গার্মেন্টস, আর এফ ট্রেডিং, প্রিন্ট এজ লিমিটেড, মাস্টার সিমেক্স পেপার, গুডলাক প্রিন্টার্স, কলেজ গেট বিনডিং অ্যান্ড প্রিন্টিং, অ্যাকশন ম্যানেজমেন্ট, সেম বাংলাদেশ ও মার্কেট এজড। এ প্রতিষ্ঠানগুলো শুল্কমুক্ত সুবিধা নিয়ে দেশীয় উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর চেয়ে ১ কোটি থেকে ৫০ লাখ টাকা কম দাম অফার করে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, মূলত আমদানিপ্রাপ্ত্যতা নির্ধারণ আদেশের দুর্বলতা কাজে লাগিয়ে প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত কাঁচামাল আমদানির পর তা বিক্রি করে দিচ্ছে একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী নামধারী চোরাকারবারি। দু-একটি ঘটনা বন্ড কর্মকর্তাদের হাতে ধরা পড়লেও বেশির ভাগ থাকছে আড়ালে। ২০১৫ সালে ঢাকা বন্ড কমিশনারেট থেকে এ-জাতীয় ৪৭৭টি প্রতিষ্ঠানকে চিহ্নিত করে লাইসেন্স সাময়িকভাবে বাতিল ও ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়। সরেজমিন দেখা যায়, প্রতিদিন গভীর রাতেই ট্রাকে ট্রাকে কাপড় ও কাগজ-জাতীয় পণ্যসামগ্রী-বোঝাই ট্রাক খালাস হয় রাজধানীর ইসলামপুর, নয়াবাজার, চকবাজার মোড়, সাভার ও গাজীপুরের বিভিন্ন স্থানে। নিয়মানুযায়ী পুনর্রপ্তানির শর্তে শুল্কমুক্ত সুবিধায় আমদানি হওয়া পণ্যসামগ্রী খালাস হওয়ার কথা আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর ওয়্যারহাউসে। কিন্তু চোরকারবারিতে জড়িত একটি সংঘবদ্ধ ব্যবসায়ী চক্র সে পণ্য বিক্রি করছে কালোবাজারে। বন্ডেড ওয়্যারহাউস সুবিধার অপব্যবহার ও চুরির সঙ্গে সরাসরি জড়িত ইপিজেডগুলোর কর্মকর্তারা। আর কিছুসংখ্যক ব্যবসায়ী শুল্ক দিয়ে সামান্য পণ্য আমদানি করেন, বাকি পণ্য বন্ড থেকে অপসারিত পণ্যের সঙ্গে মিলিয়ে এক ভ্যাট চালানের রসিদ ব্যবহার করেন। এদিকে কাপড়, কাগজ, প্লাস্টিক, গার্মেন্ট এক্সেসরিজসহ সকল প্রকার শিল্প খাতে বন্ড সুবিধার নামে বছরের পর বছর ধরে নির্দিষ্ট সিন্ডিকেটের লুটপাট, দুর্বৃত্তপনা অবিলম্বে বন্ধ করে দেশীয় শিল্প রক্ষার জোর দাবি জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। তারা চোরাচালানে সম্পৃক্ত মাফিয়াদের আইনের আওতায় আনারও দাবি করেছেন। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশন-এফবিসিসিআইর সিনিয়র সহসভাপতি মুনতাকিম আশরাফ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘দেশীয় শিল্প খাত আমাদের শক্তি। অর্থনীতির প্রাণ। চোরাকারবারিদের কারণে এ শিল্প খাত ধ্বংস হতে পারে না। দেশীয় শিল্প রক্ষা করতে হবে। বন্ডে শৃঙ্খলা খুবই জরুরি। চোরাচালান নামক অবৈধ ব্যবসার সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে অ্যাকশন দেখতে চাই।’ তিনি বলেন, দ্রুত সেন্ট্রাল বন্ড চালু করতে হবে।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশন-বিটিএমএ সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘বন্ডে এখন চোরাচালান বেপরোয়া। এ খাতের মাফিয়ারা দেশীয় শিল্প খাত ধ্বংস করে দিচ্ছে। ব্যাংকিং খাত ধ্বংস করছে। শিল্প ধ্বংস করছে। চোরাকারবারিদের এই মাফিয়া গোষ্ঠী দেশ ও জাতির শত্রু। মাফিয়াদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘অনেক শিল্পপ্রতিষ্ঠান রয়েছে যেগুলো কার্যত বন্ধ কিন্তু তাদের বন্ড লাইসেন্সগুলো বিভিন্ন পন্থায় কার্যকর রেখে সুবিধা নিচ্ছে। আমরা মনে করি বন্ডেড ওয়্যারহাউস লাইসেন্সধারী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা চিহ্নিত এবং তাদের মধ্যে কতটি চালু রয়েছে, তা নির্ধারণ করে বাকি প্রতিষ্ঠানগুলোর বন্ড লাইসেন্স বাতিল করা দরকার। বন্ধ কারখানার বন্ড লাইসেন্স ব্যবহারের অনৈতিক কার্যকলাপ বন্ধ হলে দেশীয় শিল্প সুরক্ষা পাবে।’ ঢাকা কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট সূত্র জানান, বাস্তবে কোনো ধরনের পোশাক কারখানা না থাকার পরও ৪৭৯টি প্রতিষ্ঠানের নামে আছে বন্ড লাইসেন্স। এসব বন্ড লাইসেন্স ব্যবহার করে পণ্য আমদানি করে খোলা বাজারে বিক্রি করেছেন কালোবাজারের সঙ্গে জড়িত অসাধু পোশাক কারখানার মালিকরা। দেশে এখন মোট ৬ হাজার ৫৬৫টি প্রতিষ্ঠানের নামে বন্ড লাইসেন্স থাকলেও অনিয়মের কারণে ১ হাজার ৭৫৭ প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স স্থগিত করেছে কাস্টমস। আবার কারখানা বন্ধ থাকার পরও বন্ড লাইসেন্স আছে ২ হাজার ৪৩৮টি পোশাক ও প্যাকেজিং কারখানা।

সর্বশেষ খবর