শনিবার, ৫ সেপ্টেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

রাজনীতিতে খুলছে করোনাজট

উপনির্বাচনে অংশ নিচ্ছে সব দলই, সাংগঠনিক তৎপরতাও শুরু, স্বাস্থ্যবিধি মেনেই সভা-সমাবেশ, সরগরম হচ্ছে কেন্দ্রীয় কার্যালয়

মাহমুদ আজহার ও রফিকুল ইসলাম রনি

রাজনীতিতে খুলছে করোনাজট

রাজনীতিতেও স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসতে শুরু করেছে। খুলছে করোনাজট। আসন্ন পাঁচটি উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগ-বিএনপিসহ সব রাজনৈতিক দলই অংশ নিচ্ছে। এরই মধ্যে ওইসব আসনে ভোটের রাজনীতিতে উত্তাপ বইছে। আওয়ামী লীগ-বিএনপিসহ সব রাজনৈতিক দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে নেতা-কর্মীদের আনাগোনা বৃদ্ধি পেয়েছে। কার্যালয়গুলোতে এখন প্রায় প্রতিদিনই শোডাউন করছেন নেতা-কর্মীরা। প্রায় পাঁচ মাস থমকে থাকা সাংগঠনিক তৎপরতাও শুরু হয়েছে। ক্ষমতাসীন দলের বিভিন্ন পর্যায়ের কমিটি গঠন কার্যক্রম চলছে। বিএনপির অঙ্গ সংগঠনের তৃণমূলের কমিটি গঠিত হচ্ছে। শিগগিরই মূল দল বিএনপির সাংগঠনিক কার্যক্রম শুরু হবে। রাজধানীতে স্বাস্থ্যবিধি মেনেই চলছে সভা-সমাবেশ। এখন নিয়মিত জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে মানববন্ধন, সভা-সমাবেশ অনুষ্ঠিত হচ্ছে। ঢাকার বাইরেও রাজনৈতিক দলগুলোর কার্যক্রমে গতি বেড়েছে। বিশিষ্ট কলামিস্ট, গবেষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক সৈয়দ আবুল মকসুদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘বহুদিন ধরেই রাজনীতি স্থবির ছিল। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কোনো তৎপরতা ছিল না। করোনার কারণে রাজনীতি ছিল শূন্যের কোটায়। এখন জীবনযাত্রা প্রায় স্বাভাবিক হয়ে আসছে। রাজনৈতিক তৎপরতা কিছুটা দেখা যাচ্ছে। বিশেষ করে আসন্ন উপনির্বাচনকে ঘিরে রাজনীতিতে একটু উত্তাপ বইছে। গণতন্ত্রের প্রয়োজনে রাজনৈতিক তৎপরতা থাকতেই হবে। তবে রাজনৈতিক তৎপরতা শুধু বঙ্গবন্ধু এভিনিউ, জিয়ার মাজার বা প্রেস ক্লাব নয়, মানুষের কল্যাণ কাজে তৎপর থাকতে হবে দলগুলোকে। তাদের জনগণের কাছে যেতে হবে। ভয়াবহ করোনার পাশাপাশি দীর্ঘস্থায়ী বন্যা গেল। তাতে রাজনীতিবিদদের তৎপরতা খুব একটা ছিল না। তাদের জনগণের পাশে যেভাবে থাকার কথা ছিল তা দেখা যায়নি। জনগণের পাশে থাকার রাজনীতি থাকতে হবে।’

আওয়ামী লীগ : পাঁচটি শূন্য আসনের উপনির্বাচনকে ঘিরে দলীয় সভানেত্রীর ধানমন্ডির রাজনৈতিক কার্যালয় এখন জমজমাট। দলের সংসদীয় বোর্ডের সভা ও প্রার্থী চূড়ান্ত করা হলেও পাঁচটি আসনের সম্ভাব্য প্রার্থী ও কর্মী-সমর্থকদের ভিড়ে মুখর ছিল দলের কার্যালয়। কে ধরছেন সংশ্লিষ্ট এলাকার নৌকার হাল, তা নিয়ে তাদের প্রবল আগ্রহ ছিল। দুই দিন আগে মনোনয়নের দাবিতে যুব মহিলা লীগ সভাপতি নাজমা আকতার দলীয় সভানেত্রীর কার্যালয়ে শোডাউন করেছেন। স্লোগানও দিয়েছেন ‘টাকা খাওয়া দালালেরা, হুঁশিয়ার সাবধান’, ‘হাবিব হাসানের দালালেরা, হুঁশিয়ার সাবধান’, ‘নাজমা আপার ভয় নাই, রাজপথ ছাড়ি নাই’। দলের পাঁচটি সহযোগী সংগঠনের পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করতে আগামী ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়সীমা বেঁধে দেওয়ায় পদপ্রত্যাশীরাও ভিড় জমাচ্ছেন দলীয় সভানেত্রীর রাজনৈতিক কার্যালয়ে। নিয়মিত হচ্ছেন ২৩ বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ের কেন্দ্রীয় কার্যালয়েও। দলের সাধারণ সম্পাদক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের জানিয়েছেন, এখন আমাদের সাংগঠনিক কার্যক্রম সীমিত পরিসরে চলবে। ১৫ সেপ্টেম্বরের মধ্যে সম্মেলন সম্পন্ন হওয়া ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ আওয়ামী লীগ, সহযোগী সংগঠন যুুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, কৃষক লীগ, জাতীয় শ্রমিক লীগ, মৎস্যজীবী লীগের কমিটি দলীয় সভানেত্রীর কার্যালয়ে জমা দিতে বলা হয়েছে। সে কারণে আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে নেতা-কর্মীরা দলীয় সভানেত্রীর রাজনৈতিক কার্যালয় এবং কেন্দ্রীয় কার্যালয়মুখী হওয়া শুরু করেছেন। একই সঙ্গে চলতি মাস থেকেই স্বাস্থ্যবিধি মেনে জেলা-উপজেলায় বর্ধিত সভা, কর্মিসভা এবং সম্মেলন করার প্রস্তুতি চলছে।

সূত্রমতে, সামনে পাঁচটি সংসদীয় আসনে উপনির্বাচন রয়েছে। এই আসনগুলো হচ্ছেÑ পাবনা-৪, নওগাঁ-৬, ঢাকা-১৮, ঢাকা-৫, সিরাজগঞ্জ-১। এসব আসনে দলীয় প্রার্থীও চূড়ান্ত করা হয়েছে। দলীয় প্রার্থীর পক্ষে দলের কেন্দ্রীয় নেতারা প্রচারণায় মাঠে নামছেন বলে জানা গেছে। এ প্রসঙ্গে রাজশাহী বিভাগীয় দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম কামাল হোসেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন,  পাবনা-৪ আসনে দলীয় প্রার্থীর পক্ষে ঘরোয়া কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতে আমি ঈশ্বরদী এলাকায় যাচ্ছি। সেখানে ঘরোয়া কর্মিসভা ও বর্ধিত সভায় অংশ নেব।

সূত্রমতে, আওয়ামী লীগের ৭৮টি সাংগঠনিক জেলার মধ্যে ৩১টি জেলার সম্মেলন হয়েছে। এর মধ্যে পূর্ণাঙ্গ কমিটি হয়েছে মাত্র দুটি জেলায়। সে কারণে ১৫ সেপ্টেম্বরের মধ্যে কমিটি করে জমা দিতে বলা হয়েছে। বাকি জেলাগুলোর সম্মেলনের তারিখ পর্যায়ক্রমে নির্ধারণ করা হবে। জেলা সম্মেলনের আগে ইউনিয়ন ও উপজেলা সম্মেলন হবে। একইভাবে ৬ থেকে ১০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত জাতীয় সংসদের অধিবেশন হবে। অধিবেশন শেষে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়ামের বৈঠক হবে। প্রেসিডিয়ামের বৈঠকের পর আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠক ডাকা হবে। এরপর ডাকা হবে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠক।

আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক বলেন, আমাদের ঘরোয়া রাজনীতি শুরু হয়েছে। করোনার ধাক্কা কাটিয়ে আমরা এখন মাঠের রাজনীতি সচল করতে যাচ্ছি। সামনে পাঁচটি শূন্য আসনে উপনির্বাচন আছে। এই উপনির্বাচন যেন উৎসবমুখর পরিবেশে হয় সেজন্য সব ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। আমরা চাই, উৎসবমুখর ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে নৌকার বিজয়। একই সঙ্গে এখন থেকে দলীয় কার্যালয় কিংবা ঢাকা শহরে বিভিন্ন কর্মসূচি চলছে বলেও জানান তিনি।

বিএনপি : পুরোদমে সাংগঠনিক রাজনীতিতে নামছে বিএনপি। ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সভা-সমাবেশের কার্যক্রমে স্থগিতাদেশ থাকলেও এরই মধ্যে শুরু হয়েছে সাংগঠনিক তৎপরতা। স্বাস্থ্যবিধি মেনেই বিএনপির সভা-সমাবেশ চলছে। দলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে ঢাকাসহ সারা দেশে সভা-সমাবেশ হয়েছে। নেতা-কর্মীদের নিয়ে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা ও প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের কবরে শ্রদ্ধা জানান বিএনপি মহাসচিবসহ স্থায়ী কমিটির সদস্যরা। পার্টি অফিসের তিনতলা ও নিচতলায়ও নিয়মিত কর্মসূচি চলছে। বৃহস্পতিবারও তৃতীয় তলার কনফারেন্স রুমে জাতীয়তাবাদী যুবদলের সাংগঠনিক কার্যক্রমে গতি আনতে এক অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়। এতে যুবদলের কেন্দ্রীয় সভাপতি সাইফুল আলম নীরব, সাধারণ সম্পাদক সুলতান সালাউদ্দিন টুকু, সিনিয়র সহ-সভাপতি মোরতাজুল করিম বাদরু, সাংগঠনিক সম্পাদক মামুন হাসানসহ মাঠের নেতা-কর্মীরাও অংশ নেন। 

বুধবার কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের নিচতলায় ঢাকা জেলা বিএনপির এক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় কয়েকশ নেতা-কর্মী উপস্থিত ছিলেন। এ ছাড়া নিয়মিতই বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গুলশান কার্যালয়ে ও সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবীর রিজভী কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করছেন। দলের স্থায়ী কমিটির সদস্যরাও বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশ নিচ্ছেন। বিএনপির অঙ্গ সংগঠনগুলোর তৃণমূলের কমিটি গঠন প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। বিশেষ করে ছাত্রদল, যুবদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলের সাংগঠনিক কর্মকা- চলছে দেশজুড়েই। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘করোনাকালেও বিএনপি বসে নেই। ভার্চুয়ালে আমাদের সাংগঠনিক কর্মকা- চলছে। করোনা ও বন্যায় আমরা সাধ্যমতো মানুষের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছি। কেন্দ্রীয়ভাবে কমিটি করে আমরা মাঠ পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের মাধ্যমে ত্রাণ বিতরণ করছি। বিভিন্ন দিবসভিত্তিক কর্মসূচিও পালিত হচ্ছে। আমরা দ্রুতই বিএনপির সাংগঠনিক কার্যক্রম পুরোদমে শুরু করব।’

জানা যায়, সারা দেশে বিএনপির ৮১টি সাংগঠনিক কমিটির মধ্যে ৩৪টি পূর্ণাঙ্গ কমিটি, ২৩টি আহ্বায়ক কমিটি এবং ১৬টি আংশিক রয়েছে। বাকি জেলাতে অনেক বছর আগে মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়া কমিটিই রয়েছে। বিএনপির অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনগুলোর নেতৃত্বে তরুণদের আনার প্রক্রিয়া শুরু করেছে বিএনপি। ছাত্রদলের নেতৃত্ব নির্বাচনের মাধ্যমে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচন করার পর এখন কেন্দ্রীয় সংসদ গঠনের প্রক্রিয়া তারা হাতে নিয়েছে। বিএনপির সর্বশেষ জাতীয় কাউন্সিল হয়েছিল ২০১৬ সালের মার্চে। গঠনতন্ত্রে তিন বছর পর কাউন্সিল হওয়ার কথা থাকলেও সেই সময় পার হয়ে গেছে দেড় বছর আগে।

পেশাজীবী সংগঠন ‘ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-ড্যাব’ নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন নেতৃত্ব নিয়ে এগোচ্ছে। যুবদলের পূর্ণাঙ্গ কমিটি না হলেও তৃণমূল পর্যায় থেকে কমিটি গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। ১০টি বিভাগীয় টিমের মাধ্যমে সারা দেশে কমিটি গঠনের কাজ শুরু হয়েছে। জাতীয়তাবাদী স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি শফিউল বারী বাবুর আকস্মিক মৃত্যুতে সংগঠনের কমিটি গঠনের কাজ সাময়িক বন্ধ রয়েছে। শিগগিরই সাংগঠনিক কার্যক্রম শুরু হবে বলে জানান সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক আবদুল কাদের ভূইয়া জুয়েল। অন্য অঙ্গ সংগঠনের কার্যক্রমও চলছে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘দলের পুনর্গঠন একটি চলমান প্রক্রিয়া। এই কার্যক্রম শুরু হয়েছে। বিএনপি এখন অনেক গতিশীল। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নেতৃত্বে সংগঠনকে ঢেলে সাজানোর কাজ চলছে। জেলা কমিটিগুলো হচ্ছে নতুনভাবে। অঙ্গ সংগঠনগুলোর কার্যক্রমও চলছে।’

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর