ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে দেশের নিম্নাঞ্চলসহ উপকূলীয় এলাকা প্লাবিত হয়েছে। জলোচ্ছ্বাসে সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, পিরোজপুর, বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা, নোয়াখালী ও লক্ষীপুর জেলার ২৭ উপজেলা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। উপকূলীয় এলাকার ২৭ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ভেঙে গেছে। জোয়ারে পানি ঢুকে পড়েছে গ্রামগঞ্জে। পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন লাখ লাখ মানুষ।
ইয়াসে বরগুনায় শিশুসহ দুজন, বরিশালের বাকেরগঞ্জে দুই শিশু, ভোলার লালমোহনে একজন, ফেনীর সোনাগাজীতে একজন ও বাগেরহাটে এক শিশুর মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। ইয়াস বাংলাদেশে আঘাত না হানলেও জলোচ্ছ্বাসে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৯ জেলার ২৭ উপজেলা। জোয়ারের পানিতে ভেসে গেছে মাছের ঘের। লবণপানিতে তলিয়ে গেছে ফসলি জমি। জলোচ্ছ্বাসে গোটা সুন্দরবন ৪ থেকে ৬ ফুট পানির নিচে তলিয়ে যায়। এ ছাড়া বরগুনায় বেড়িবাঁধ ভেঙে প্লাবিত হয়েছে শতাধিক গ্রাম। খুলনার কয়রা, পাইকগাছা, দাকোপের বিভিন্ন স্থানে বেড়িবাঁধ ভয়াবহ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বাঁধ ভেঙে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। প্রবল জোয়ারে ভোলার ৪০টি চরের মধ্যে অন্তত ৩০টি চর ৬ থেকে ৭ ফুট পর্যন্ত প্লাবিত হয়েছে। এসব চরে ২ লাখের মতো লোকের বসবাস। ইয়াস গতকাল ভারতের উপকূল অতিক্রম শুরু করে। সে দেশের আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, স্থানীয় সময় সকাল সাড়ে ৮টার দিকে ইয়াস ওড়িশা উপকূল অতিক্রম শুরু করে। সাড়ে ১০টা থেকে সাড়ে ১১টার মধ্যে ঘূর্ণিঝড়ের কেন্দ্রভাগ বা চোখ বালাশোরের কাছ দিয়ে পুরোপুরি স্থলভাগে উঠে আসে। তখন এর কেন্দ্রে বাতাসের একটানা সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ১৩০ থেকে ১৪০ কিলোমিটার; যা দমকা বা ঝড়ো হাওয়ার আকারে ১৫৫ কিলোমিটার পর্যন্ত বাড়ছিল।
জোয়ারের পানিতে ক্ষতি ২৭ উপজেলায় : ইয়াসের প্রভাবে জোয়ারের পানি বেড়ে উপকূলীয় ৯ জেলার ২৭ উপজেলায় ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়। গতকাল দুপুরে মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে ‘ঘূর্ণিঝড় ইয়াস ও দুর্যোগ মোকাবিলায় সরকারের প্রস্তুতি ?ও ব্যবস্থাপনা’ নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান প্রতিমন্ত্রী মো. এনামুর রহমান। তিনি জানান, ঘূর্ণিঝড়ের কারণে জোয়ারের পানিতে ক্ষতিগ্রস্ত এসব উপজেলার মানুষের সহায়তায় সাড়ে ১৬ হাজার শুকনা ও অন্যান্য খাবারের প্যাকেট সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসকের অনুকূলে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। সংবাদ সম্মেলনে ১৪ উপকূলীয় জেলায় ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাব এবং তা মোকাবিলায় সরকারের প্রস্তুতি তুলে ধরেন তিনি। ইয়াসে বাঁধ ভেঙে যেসব মৎস্য ও কৃষিজীবী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তাদের স্বল্পসুদে ঋণ দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে জানিয়ে প্রতিমন্ত্রী বলেন, আন্তমন্ত্রণালয় বৈঠকে আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, মৎস্যজীবী যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন সম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে তাদের স্বল্প সুদে ঋণ দেওয়া হবে। যাদের ফসলের ক্ষতি হয়েছে তাদের কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে স্বল্প সুদে ঋণ এবং বিনামূল্যে বীজ, চারা ও সার সরবরাহ করা হবে। এনামুর রহমান বলেন, উপকূলীয় এলাকায় ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচির (সিপিপি) ৭৬ হাজার স্বেচ্ছাসেবক ছাড়াও স্কাউট, রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি, আনসার ভিডিপির স্বেচ্ছাসেবকরা কাজ করছেন। তারা ও স্থানীয় প্রশাসন মিলে নিম্নাঞ্চল এবং বিচ্ছিন্ন চরাঞ্চল থেকে আগেই মানুষকে সরিয়ে এনেছিল। তিনি বলেন, স্বাস্থ্যবিধি মানার জন্য যথেষ্ট মাস্ক এবং স্বাস্থ্য উপকরণ নিশ্চিত করা হয়েছিল। জেলা প্রশাসক, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি এবং স্বেচ্ছাসেবকরা সার্বক্ষণিকভাবে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে রেখেছেন এবং প্রয়োজন অনুযায়ী কার্যক্রম গ্রহণ করেছেন। প্রতিমন্ত্রী বলেন, যে কোনো দুর্যোগ মোকাবিলায় সার্বিক সহায়তা প্রদানের জন্য জেলা প্রশাসকদের অনুকূলে পর্যাপ্ত খাদ্যসামগ্রী ও অর্থ বরাদ্দ দেওয়া আছে। যে যে জেলায় বাঁধ ভেঙে গেছে, জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে সেসব বাঁধ মেরামতের কাজ চলছে। আমরা তথ্য পেয়েছি অনেক জায়গায় বাঁধ ভেঙে গেছে, সেগুলো মেরামত বা পুনর্নির্মাণের কাজ চলছে। নেদারল্যান্ডস সরকারের সহায়তায় উপকূলীয় অঞ্চলে বাঁধ নির্মাণে মহাপরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে জানিয়ে তিনি আরও বলেন, এখন যে বাঁধগুলো আছে সেগুলো ষাটের দশকের। এগুলো সংস্কার করলে খুব একটা লাভ হবে না। তিনি বলেন, এটা বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত কোনো রকম গ্যারান্টি দেওয়া যাবে না। কারণ আমি নিজেও ভিজিট করে দেখেছি বাঁধগুলো সরু হতে হতে জমির আইলের (আল) মতো হয়ে গেছে। তাছাড়া বেশিরভাগই হচ্ছে মাটির বাঁধ। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে যেভাবে দুর্যোগ বেড়েছে, মাটির বাঁধ দিয়ে তা রক্ষা করা যাবে না।
সাতক্ষীরায় জলোচ্ছাসে বাঁধ ভেঙে ১০ গ্রাম প্লাবিত : আমাদের সাতক্ষীরা প্রতিনিধি জানান, কপোতাক্ষ ও খোলপেটুয়া নদীর পানি উন্নয়ন বোর্ডের ১১টি পয়েন্ট বেড়িবাঁধ ভেঙে সাতক্ষীরার শ্যামনগর ও আশাশুনির ১০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। ভেসে গেছে অসংখ্য চিংড়ি ঘের ও মৎস্য পুকুর। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে জলোচ্ছ্বাস আছড়ে পড়ে সাতক্ষীরার উপকূলে। এতে আশাশুনি উপজেলার প্রতাপনগরের কুড়িকাওনিয়া, হরিশখালি, শুভদ্রাকাটি, চাকলা, দিঘলার রাইট, কুড়িকাউনিয়ার লঞ্চঘাট এলাকা, আনুলিয়া ইউনিয়নের নাকলা এবং শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা ইউনিয়নের নেবুবুনিয়াসহ বেশ কিছু এলাকার বাঁধ ভেঙে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়। এ ছাড়া গাবুরা ইউনিয়নের চাঁদনিমুখা ও নাপিতখালী ক্লোজার উপচে পড়ে তীব্র গতিতে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করে চাঁদনিমুখা, নাপিতখালী ও ৩ নং মোল্লাপাড়া প্লাবিত হয়। বুড়িগুয়ালিনী, মুন্সিগঞ্জ, পদ্মপুকুরসহ কপোতাক্ষ ও খোলপেটুয়া নদীর প্রায় শতাধিক পয়েন্টে ভয়াবহ ফাটল ও ভাঙন দেখা দিয়েছে।
কালীগঞ্জ উপজেলার হাঢ়াতদাহ লাকায় কালিন্দী নদীর জোয়ারের পানি উপচে পড়ে লোকালয়ে প্রবেশ করে। এতে রাস্তাঘাট ও বসতবাড়ি প্লাবিত হয়। এ ছাড়া পাঁচ শতাধিক মৎস্য ঘের ভেসে যায়। কপোতাক্ষ ও খোলপেটুয়া নদীর স্বাভাবিকের চেয়ে ৩ থেকে ৪ ফুট উচ্চতায় পানি বৃদ্ধি পেয়ে ১৫ থেকে ২০টির মতো স্থানে বেড়িবাঁধ উপচে পড়ে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করে।
খুলনায় তলিয়েছে মাছের ঘের, ফসলি জমি : আমাদের খুলনা প্রতিনিধি জানান, ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে সৃষ্ট জোয়ারের পানিতে খুলনার উপকূলীয় কয়রা পাইকগাছা দাকোপের বিভিন্ন স্থানে বেড়িবাঁধ ভয়াবহ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কয়েকটি স্থানে বাঁধ ভেঙে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। পাইকগাছা পৌরসভা, সোলাদানা, বেতবুনিয়া ইউনিয়নের রাস্তাঘাট ফসলি জমি কয়েক ফুট পানিতে তলিয়ে গেছে। গতকাল দুপুরে জোয়ারের অতিরিক্ত পানির চাপে কয়রার দক্ষিণ বেতকাশি আংটিহারা, গাতির গেরি, মহারাজপুর ইউনিয়নের দশালিয়া পবনা পয়েন্টে বেড়িবাঁধ ভেঙে যায়। এতে আংটিহারা গোবিন্দপুর দশলিয়া খাশিটানাসহ ৩৫টি গ্রাম প্লাবিত হয়। এ ছাড়া স্বাভাবিকের তুলনায় নদীতে তিন থেকে চার ফুট পানি বৃদ্ধি পেলে পবনা মঠবাড়ি, লোকা, মদিনাবাদ ৫নং স্লুইসগেট পয়েন্টে বাঁধ উপচে পানি লোকালয়ে ঢুকেছে। লবণপানিতে তলিয়ে গেছে অসংখ্য মাছের ঘের, ফসলি জমি। স্থানীয় প্রশাসনের তত্ত্বাবধয়ানে মাটি, বালি, জিও ব্যাগ দিয়ে বাঁধ রক্ষায় কাজ করছেন গ্রামবাসী। জোয়ারের পানিতে পাইকগাছার দেলুটি ইউনিয়নের চারটি পয়েন্টে, গড়ইখালী কুমারখালীতে বাঁধ ভেঙেছে। সোলাদানা বাজার, পাইকগাছা পৌরসভা, বেতবুনিয়াসহ কয়েকটি এলাকা প্লাবিত হয়েছে। স্থানীয়রা মাটি বালি দিয়ে বাঁধ মেরামত করলেও পরের জোয়ারে আবারও তা ভেঙে যাচ্ছে।
বাগেরহাটে ভেসে গেছে ২ হাজার ৯১ খামারের চিংড়ি : আমাদের বাগেরহাট প্রতিনিধি জানান, বাগেরহাটে জলোচ্ছ্বাসে জিনিয়া নামের ৪ বছরের এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। সকাল ১০টায় ঘরের মেঝেতে বসে খেলা করতে থাকা এই শিশু হঠাৎ করে জলোচ্ছ্বাসের তোড়ে ভেসে যায়। ৪ ঘণ্টা পর বাড়ির পাশের ডোবা থেকে তার লাশ উদ্ধার করা হয়। নিহত শিশু জিনিয়া মোরেলগঞ্জের চালিতাবুনিয়া গ্রামের কামাল গাজীর মেয়ে। গতকাল সকালে জলোচ্ছ্বাসে গোটা সুন্দরবন ৪ থেকে ৬ ফুট পানির নিচে তলিয়ে যায়। পানির তোড়ে পূর্ব সুন্দরবনের চান্দেরশ্ব ও কোকিলমুনির দুটি বন অফিস, ১টি স্টাফ ব্যারাক, ১টি রেস্ট হাউস, ১টি ফুট ট্রেল বিধ্বস্ত ও ১১টি রাস্তা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পাশাপাশি ৬টি পুকুরের লবণ পানিতে তলিয়ে গেছে। গাছপালার ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বিকাল পর্যন্ত জানাতে না পারলেও দুবলা ও শরণখোলায় দুটি মৃত হরিণ ও মোরেলগঞ্জের একটি খাল থেকে সুন্দরবনের বিলুপ্ত প্রজাতির ১টি মৃত ইরাবতী ডলফিন উদ্ধারের তথ্য নিশ্চিত করেছে বন বিভাগ। সুন্দরবনের সব থেকে উঁচু এলাকা করমজল বন্যপ্রাণী প্রজনন কেন্দ্র পানিতে তলিয়ে গেলেও বন্যপ্রাণীগুলো নিরাপদ রয়েছে। জেলার শরণখোলা, মোরেলগঞ্জ, রামপাল ও মোংলা উপজেলায় ২ হাজার ৯১টি চিংড়ি খামারের মাছ ভেসে গেছে বলে প্রাথমিকভাবে জানিয়েছে জেলা মৎস্য বিভাগ। ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের জলোচ্ছ্বাসে চার উপজেলার প্রায় ১০০ কিলোমিটার সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এসব উপজেলায় ৩ হাজারের অধিক পরিবার পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। মোংলা উপজেলার চিলা, চাঁদপাই ও বুড়িরডাঙ্গা ইউনিয়নের প্রায় ৮০০ পরিবার পানিবন্দী হয়েছে।
বরগুনায় প্লাবিত শতাধিক গ্রাম, মৃত্যু ২ : আমাদের বরগুনা প্রতিনিধি জানান : ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে বরগুনায় বেড়িবাঁধ ভেঙে ও উপচে শতাধিক গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। মঙ্গলবার রাত ও বুধবার বিষখালী, বলেশ্বর ও পায়রা নদীর জোয়ারের পানির তোড়ে বাঁধ ভেঙে ও উপচে এসব গ্রাম প্লাবিত হয়। এতে জেলার প্রায় লক্ষাধিক মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে। গতকাল সকালে বেতাগী উপজেলার দক্ষিণ কালিকাবাড়ি এলাকায় ইমামুল (৭) ও মঙ্গলবার রাতে বরগুনার বামনা উপজেলার ডৌয়াতলা এলাকায় মাছ ধরতে গিয়ে নান্না মিয়া (৩৫) নামের এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। জানা গেছে, বেতাগী উপজেলার সরিষামুড়ি ইউনিয়নের কালিকাবাড়ি গ্রামের শিপনের ছেলে ইমামুল (৭) আশ্রয় কেন্দ্রে যাওয়ার পথে বেড়িবাঁধ ভেঙে পানিতে পড়ে যায়। অনেক খোঁজাখুঁজির পর তাকে মৃত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। মঙ্গলবার রাত ১১টার দিকে বামনার ডৌয়াতলা এলাকার মতি জোমাদ্দারের ছেলে নান্না জোমাদ্দার (৩৫) নামের এক ব্যক্তি মাছ শিকারে গিয়ে পানিতে ডুবে মারা যান। জানা গেছে, জেলার প্রধান তিনটি নদী পায়রা, বলেশ্বর ও বিষখালীতে বুধবার ১২৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে জোয়ারের পানি প্রবাহিত হয়েছে। এ ছাড়াও মঙ্গলবার সকালে বিপৎসীমার ৭৭ সেন্টিমিটার ও রাতে বিপৎসীমার ১০৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে জোয়ারের পানি প্রবাহিত হয়।
পটুয়াখালীর উপকূল পানিতে থইথই : আমাদের পটুয়াখালী প্রতিনিধি জানান, ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে নদীর পানি বিপৎসীমার ৬৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় পটুয়াখালীর গোটা উপকূল দফায় দফায় প্লাবিত হয়েছে। তলিয়ে গেছে পৌর শহর থেকে গ্রামের মাইলের পর মাইল। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বেড়িবাঁধ, স্লুইস গেট, কাঁচারাস্তা, তলিয়ে গেছে মাছের ঘের, ফসলি জমি, গাছপালা, কাঁচা ঘরবাড়ি, ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান, গবাদিপশু, হাঁস-মুরগি। গ্যাংওয়ে তলিয়ে মূল সড়ক পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় ফেরি চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।
মঙ্গলবার সকাল থেকে বুধবার দুপুর পর্যন্ত বেড়িবাঁধ ভেঙে ও ক্ষতিগ্রস্ত বেড়িবাঁধ দিয়ে ঢুকে তিন দফা জোয়ারের পানি প্রবেশ করে প্লাবিত হয়েছে বেশির ভাগ গ্রাম। পানিবন্দী এসব এলাকায় বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে সড়কের যোগাযোগ ব্যবস্থা। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে কলাপাড়া, রাঙ্গাবালী, দশমিনা, বাউফল ও গলাচিপা উপজেলায়। তলিয়ে গেছে অসংখ্য মাছের ঘের ও পুকুর। পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় অন্তত ২০ গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। ডুবে গেছে অনেকের থাকার শেষ আশ্রয়টুকু। বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ভাঙা অংশ দিয়ে দুই দফা পানিতে প্রবেশ করে তলিয়ে গেছে মাছের ঘের। ফলে মানবেতর জীবনযাপন করছে এলাকার মানুষ। ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৭৬টি গ্রাম।
ভোলায় ২০ হাজার মানুষ পানিবন্দী, গাছচাপায় নিহত ১ : আমাদের ভোলা প্রতিনিধি জানান, ভোলার লালমোহনে গাছচাপায় একজন নিহত হয়েছেন। এ ছাড়া মনপুরা উপজেলায় পাকা সড়ক ও বেড়িবাঁধ ভেঙে অন্তত ২০ হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। ভেসে গেছে চরাঞ্চলের গবাদি পশুসহ অসংখ্য পুকুর ও ঘেরের মাছ। ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে গতকাল দুপুরে ভোলার মেঘনায় বিপৎসীমার ৬৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়। এতে মেঘনার মাঝের চর, কলাতলির চর, ঢালচর, চর নিজাম, সোনারচর, কুকরি-মুকরি, চরপাতিলাসহ অন্তত ৩০টি বিচ্ছিন্ন চরাঞ্চলের কয়েক হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। মেঘনার প্রবল জোয়ারের তোড়ে মনপুরা উপজেলায় প্রায় ৫০ ফুট বেড়িবাঁধ ভেঙে লোকালয় প্লাবিত প্রবেশ করে। এ ছাড়া জোয়ারের তোড়ে ভেঙে যায় এলজিইডি নির্মিত ৪০ ফুট পাকা সড়ক। এতে উপজেলার সঙ্গে উত্তর সাকুচিয়া ও দক্ষিণ সাকুচিয়া দুই ইউনিয়নের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।
নোয়াখালীতে ভেসে গেছে দোকানপাট, বাড়িঘর : আমাদের নোয়াখালী প্রতিনিধি জানান, নোয়াখালী দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ায় ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে স্বাভাবিকের চেয়ে ৫-৬ ফুট উচ্চতায় জোয়ারের পানিতে ভেসে গেছে দোকানপাট, বাড়িঘর, গবাদী পশু, ফসলি জমি। নিঝুম দ্বীপ, চর ঈশ্বর, সুখচর, সোনাদিয়া, জাহাজমারা, নলচিরা, হরনি, চানন্দি ও তমরদ্দি ইউনিয়নের অন্তত ৩০ গ্রামের কয়েক হাজার লোক পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। গৃহহারা লোকজন বেড়িবাঁধে আশ্রয় নিয়েছে। সাগর উত্তাল থাকায় দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ার সঙ্গে জেলা সদরসহ সারা দেশে সব ধরনের নৌ যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে। মেঘনা ও বঙ্গোপসাগারে মাছধরা ট্রলার ও নৌকাগুলো তীরে অবস্থান করছে।
পানিবন্দী কয়েক হাজার হরিণ : ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে অস্বাভাবিক জোয়ারের পানিতে নোয়াখালীর দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ার নিঝুমদ্বীপের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। বেড়িবাঁধ না থাকায় জোয়ারের পানি ঢুকে পড়েছে বনের ভিতর। পানিবন্দী হয়ে পড়েছে বনের কয়েক হাজার হরিণ। জোয়ারের পানিতে ভেসে পুকুরের মাছ, কাঁকড়া ও জমির ফসল। নিঝুমদ্বীপে প্রায় ৭/৮ হাজার হরিণ রয়েছে। নোয়াখালীর বিভাগীয় বন কর্মকর্তা বিপুল কৃষ্ণদাস জানান, হরিণগুলো উঁচু স্থানে নিরাপদ আশ্রয়ে উঠে গেছে। এতে প্রাণহানির কোনো খবর পাওয়া যায়নি। ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে ৭ থেকে ৮ ফুট উঁচু জোয়ারের পানি প্রবেশ করায় হরিণের আবাসস্থল তলিয়ে গেছে।
লক্ষীপুরে বিপাকে লাখো মানুষ : আমাদের লক্ষীপুর প্রতিনিধি জানান, ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে জোয়ারের পানি বেড়ে কমলনগরের একাধিক সড়ক ভেঙে কয়েকটি এলাকার যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। লোকালয়ে পানি ঢুকে কমলনগর ও রামগতির নদী তীরবর্তী অন্তত ৬টি গ্রামের শত শত ঘর বাড়ি ডুবে গেছে। এতে চরম বিপাকে পড়েছেন এ দুই উপজেলার লাখো মানুষ। বেড়িবাঁধ না থাকায় যে কোনো ধরনের বন্যা কিংবা জলোচ্ছ্বাসে এমন পরিস্থিতির শিকার হতে হন এ উপকূলের নদী তীরবর্তী বাসিন্দাদের। সরকারের সহায়তা চাইলেন ভুক্তভোগী এলাকাবাসী ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা।
কমলনগর উপজেলার চর মার্টিন ও নাসিরগঞ্জের নদী তীর এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, জোয়ারের প্রবল পানির চাপে স্থানীয় নাসিরগঞ্জ বাজার থেকে মতির হাট সড়কের একাধিক স্থানে কাঁচা-পাকা সড়ক ভেঙে যোগোযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়েছে। লোকালয়ে পানি ঢুকে ডুবে গেছে শত শত ঘরবাড়ি। বাসিন্দারা ঘরের আসবাবপত্র নিয়ে রাস্তার পাশে আশ্রয় নিয়েছে।
বাকেরগঞ্জে জোয়ারের পানিতে ডুবে দুই শিশুর মৃত্যু : আমাদের বরিশাল প্রতিনিধি জানান, বরিশালের বাকেরগঞ্জ উপজেলায় পৃথক ঘটনায় জোয়ারের পানিতে ডুবে গতকাল দুই শিশুর মৃত্যু হয়েছে। এরা হলো নিয়ামতি ইউনিয়নের ঢালমারা গ্রামের হাফিজুর রহমানের ২ বছর ৯ মাস বয়সের শিশু সন্তান সুমাইয়া আক্তার ও গারুড়িয়া ইউনিয়ন রূনসী পশুরি গ্রামের আজগর আলীর শিশু সন্তান ৩ বছর বয়সের আজওয়া আক্তার। স্থানীয়রা জানান, বাড়ির সামনে গতকাল জোয়ারের পানি ওঠে। পরিবারের সবার অজ্ঞাতে ওই দুই শিশু পানিতে নামে। কিন্তু পানির গভীরতা থাকায় তারা ডুবে যায়।
ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে জোয়ারের পানিতে বরিশালের চার উপজেলায় বাঁধ, রাস্তা ও ব্রিজ-কালভার্ট এবং মাছের ঘের, ইরি ধান ও পান বরজের ক্ষতি হয়েছে। জেলার অপর ছয় উপজেলায় পানি বাড়লেও উল্লেখযোগ্য কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। জোয়ারের পানিতে প্লাবিত হয়েছে বরিশাল নগরীর সদর রোড, ফজলুল হক এভিনিউ, আগরপুর রোড, জাজেজ কোয়ার্টারের রাস্তা নগরীর রসুলপুর বস্তিসহ নিম্নাঞ্চল। এ ছাড়া পানিতে ওই উপজেলার জয়নগর, দড়িরচর-খাজুরিয়া, বিদ্যানন্দপুর ইউনিয়নের বিভিন্ন বাঁধ, রাস্তা ও ব্রিজ-কালভার্ট ক্ষতি হয়। ভাঙনের মুখে পড়েছে দড়িচরখাজুরিয়া ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের শিকদার হাটের কমিউনিটি ক্লিনিক। মাছের ঘের, ইরি ধান ও পানের বরজ জোয়ারে পানিতে প্লাবিত হয়। এ ছাড়া জোয়ারের পানিতে বরিশাল বিভাগের তিন জেলার ১২টি পয়েন্টে বেড়িবাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
ফেনীতে একজনের মৃত্যু : আমাদের ফেনী প্রতিনিধি জানান, ফেনীর সোনাগাজীতে জোয়ারের পানিতে ডুবে হাদিউজ্জামান নামে এক জেলের মৃত্যু হয়েছে। রাত সাড়ে ১০টার দিকে ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা তার মৃতদেহ উদ্ধার করে। নিহত হাদিউজ্জামান সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার শেখ পাড়ার বাসিন্দা। তিনি মৌসুমি জেলে।
কক্সবাজারে ৪৫ গ্রাম প্লাবিত : আমাদের কক্সবাজার প্রতিনিধি জানান, ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে ও পূর্ণিমার জোয়ারের কক্সবাজারের উপকূলীয় এলাকায় ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। জেলার কুতুবদিয়া উপজেলা, সেন্টমার্টিন দ্বীপ, কক্সবাজার শহরতলি, সদর উপজেলার গোমাতলী, ইসলামপুর, পেকুয়া উপজেলার মগনামা, মহেশখালী উপজেলার মাতারবাড়ী ও ধলঘাটা এলাকায় সর্বোচ্চ ৫ ফুট উচ্চতায় জলোচ্ছ্বাসে ৪৫টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। বাড়ি ঘর বিধ্বস্ত ও নষ্ট হয়েছে পাঁচ শতাধিক। বিশেষ করে কুতুবদিয়া ও সেন্টমার্টিন দ্বীপে ক্ষয়ক্ষতি বেশি হয়েছে। টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপের বেড়িবাঁধ জোয়ারের পানির ধাক্কায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মেরিনড্রাইভ সড়কে জোয়ারের পানির ধাক্কায় জিওব্যাগ ধসে হিমছড়িসহ চারটি স্থানে ভাঙন ধরেছে। সমুদ্রসৈকতের সৌন্দর্য বর্ধনকারী ঝাউ বাগানে ঢেউয়ের তোড়ে ভাঙন ধরে বেশ কিছু গাছ উপড়ে পড়েছে।
পতেঙ্গায় বেড়িবাঁধ দিয়ে ঢুকছে জোয়ারের পানি : চট্টগ্রাম অফিস জানায়, ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে জোয়ারের পানি প্রবেশ করেছে চট্টগ্রামের পতেঙ্গা এলাকার উপকূলবর্তী অঞ্চলে। সমুদ্রের প্রবল ঢেউয়ে ক্ষতিগ্রস্ত বেড়িবাঁধ দিয়ে লোকালয়ে প্রবেশ করেছে পানি। গতকাল ভোর থেকেই জোয়ারের পানিতে তলিয়ে পতেঙ্গা এলাকার অনেক নিম্নাঞ্চল। পানি ঢুকে যায় বাসাবাড়ি ও দোকানে। লোকালয়ে পানি ঢুকে যাওয়ায় প্রাণ রক্ষায় মানুষ ছুটছেন অন্যত্র। আনোয়ারা ও বাঁশখালী উপকূলীয় এলাকায় প্রবেশ করেছে পানি। তাছাড়া, চট্টগ্রাম বন্দরের জেটিতেও হয়েছে হাঁটু পানি। পরে তা সরে যায়। বন্দরের বহির্নোঙর থেকে মাদার ভেসেলগুলোকেও অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।
ঝিনাইদহে অর্ধ-শতাধিক ঘরবাড়ি লন্ডভন্ড : আমাদের ঝিনাইদহ প্রতিনিধি জানান, ঝিনাইদহ সদর উপজেলায় চলমান ইয়াসের মধ্যেই কয়েক সেকেন্ডের টর্নেডোর আঘাতে অর্ধ-শতাধিক ঘরবাড়ি গাছপালা লন্ডভন্ড হয়ে গেছে। মঙ্গলবার রাতে নলডাঙ্গা ইউনিয়নের আড়মুখী গ্রামে কমপক্ষে ৫০টি বাড়িঘর ভেঙে যায়। অতিবৃষ্টির মধ্যে আড়মুখী কুটিপাড়া থেকে পশ্চিমপাড়া পর্যন্ত প্রায় ১০০ মিটারের মতো ব্যাস ধারণ করে ২ কিলোমিটার লম্বা স্থান ধ্বংস স্তুপে পরিণত হয়েছে।