রবিবার, ২৭ জুন, ২০২১ ০০:০০ টা

আবার জীবন-জীবিকার সংশয়

ব্যাংক বিদ্যুৎ পানি ভূমি রেজিস্ট্রেশন করসহ সরকারের রাজস্ব আয়ের সব খাত খোলা রাখার পক্ষে বিশেষজ্ঞরা

নিজস্ব প্রতিবেদক

আবার জীবন-জীবিকার সংশয়

লকডাউনের খবরে গতকাল ঘাটে ঘরমুখো মানুষের উপচে পড়া ভিড় -বাংলাদেশ প্রতিদিন

নতুন মাত্রার লকডাউনে সমাজের সব ক্ষেত্রে জীবন-জীবিকার শঙ্কা তৈরি হয়েছে। রাস্তার ছোট দোকান থেকে শুরু করে বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠান সবাই পড়েছে অজানা আশঙ্কায়। ব্যবসা-বাণিজ্যের ধাক্কা সামলানো নিয়ে তারা সংশয়ে। আসছে ঈদের আগে বিশাল সংকট গার্মেন্ট কর্মীর বেতন-বোনাস নিয়ে ভাবনায় পড়েছেন মালিকরা। উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা শুরু হয়েছে বেসরকারি চাকরিজীবী পর্যায়েও। ঈদের আগে নতুন করে বিপাকে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে দোকানের কর্মচারী থেকে করপোরেট সব চাকরিজীবীর মধ্যে। দীর্ঘকালীন মহামারী মোকাবিলা করে যখন আশার আলো দেখতে শুরু করেছিলেন ঠিক তখন আবার দুর্ভাবনায় পেয়ে বসেছে আইনজীবীসহ সব পেশাজীবীকে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জুন ক্লোজিং হওয়ার কারণে ব্যাংকের পাশাপাশি যেসব খাত থেকে সরকারের রাজস্ব আদায় হয় সেসব প্রতিষ্ঠান খোলা রাখা উচিত। ভূমি রেজিস্ট্রেশন, কর আদায়, ওয়াসা, ডেসা, বিদ্যুৎ, পানির বিল সংগ্রহসহ রাজস্ব আদায়ের খাতগুলো খোলা রাখার অভিমত ব্যক্ত করেছেন তারা। ব্যাংকগুলোও খোলা রাখার কথা বলেছেন। তারা বলছেন, লকডাউনের কারণে রাজস্ব আদায় করতে না পারলে সরকারের সব প্রকল্প মুখ থুবড়ে পড়বে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনার থাবা হঠাৎ কয়েক গুণ বৃদ্ধি পাওয়ায় আগামীকাল থেকে সরকারের সপ্তাহব্যাপী লকডাউন ঘোষণায় আবার জীবন নাকি জীবিকা সে প্রশ্ন চলে এসেছে। জীবন বাঁচাতে গেলে মানুষ জীবিকা সংকটে ভুগছে, আবার জীবিকার প্রতি নজর দিলে মানুষের জীবন হুমকির মুখে চলে যাচ্ছে। কিন্তু এক বছরের বেশি সময় ধরে চলা করোনা মহামারীতে খেটে খাওয়া মানুষের কাছে জীবনের চেয়ে জীবিকাই প্রধান হয়ে দেখা দিয়েছে। স্বাস্থ্য সুরক্ষার নিরিখে কঠোর লকডাউনের সিদ্ধান্ত শতভাগ সঠিক হলেও তা খেটে খাওয়া মানুষের জন্য তা অশনিসংকেত। কারণ গত বছর সাধারণ ছুটির কারণে অনেকে পেশা পরিবর্তন করেছেন। অনেক প্রতিষ্ঠান কর্মী ছাঁটাই করেছে, বেতন কমিয়েছে। বন্ধ হয়েছে ইনক্রিমেন্ট, প্রমোশন। অসংখ্য মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছে। তাই অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে স্বাস্থ্য সুরক্ষার সাধারণ বিষয়গুলো শতভাগ নিশ্চিত করার দিকে জোর দিয়ে দৈনন্দিন জীবন স্বাভাবিক রাখার পক্ষে সবাই।

রাজধানীর একটি ফ্যাশন হাউসে কর্মরত জহিরুল ইসলাম রাজু বলেন, ‘গত বছরও লকডাউনের কারণে কোনো ঈদে ফুল বোনাস পাইনি। বেতন পেয়েছি অর্ধেক। এবার রোজার ঈদে অর্ধেক বোনাস পেয়েছি। কিন্তু ঈদের আগে নতুন করে লকডাউন শুরু হচ্ছে, তাই বেতন বোনাস পাব কি না চিন্তায় আছি।’

দেশের একটি শীর্ষস্থানীয় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা আশিকুর রহমান বলেন, ‘বেসরকারি অফিসগুলো সব সময় কর্মীদের সুবিধা কমানোর সুযোগ খোঁজে। এখন ঈদের আগে লকডাউন শুরু হচ্ছে, তাই বোনাসটা পাব কি না শঙ্কায় আছি।’ তিনি বলেন, ‘লকডাউনের সময় দেখি শিথিল-শিথিল খেলা চলে। শিথিলের নামে অনেক প্রতিষ্ঠানই খোলা থাকছে। সমস্যা শুধু আমাদের।’

সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সম্পাদক ও সাধারণ আইনজীবী ঐক্য পরিষদের আহ্বায়ক ড. মোমতাজ উদ্দিন আহমেদ মেহেদী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘করোনা মহামারী শুরু হওয়ার পর এক বছরের বেশি সময় ধরে আইনজীবীরা অর্থনৈতিকভাবে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। একই সঙ্গে বিচারপ্রার্থীরাও ক্ষতিগ্রস্ত সময়মতো মামলার নিষ্পত্তি না হওয়ায়। লকডাউনের সময়গুলোয় আদালতের কার্যক্রম চলেছে সীমিত পরিসরে। উচ্চ আদালতে কয়েকটি ভার্চুয়াল বেঞ্চ ও নিম্ন আদালতে শুধু জামিন ও আত্মসমর্পণ শুনানি হয়েছে। এখন নতুন করে লকডাউন শুরু হওয়ার পর যদি আদালতের কার্যক্রমও সীমিত করে দেওয়া হয় তাহলে আইনজীবীদের ঈদ হবে না। আর বিচারপ্রার্থীদের দুর্ভোগের শেষ থাকবে না।’ তিনি বলেন, ‘বর্তমানে হাই কোর্টের সব বেঞ্চই ভার্চুয়াল পদ্ধতিতে চলছে। তাই প্রধান বিচারপতির কাছে আমাদের অনুরোধ লকডাউনেও ভার্চুয়াল পদ্ধতিতে উচ্চ আদালতের সব বেঞ্চ সচল রাখা হোক। একই সঙ্গে নিম্ন আদালতের কার্যক্রমও স্বাভাবিক রাখতে অনুরোধ করছি।’

ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশন-এফবিসিসিআই সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন বলেন, ‘আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষ সচেতন নয়। ফলে আমাদের করোনা নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে না। টিকার ব্যবস্থা করতে পারলেও এত কষ্ট হতো না। নতুন করে লকডাউনে শিল্পকারখানা খোলা থাকলেও সেবা খাতের ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। তাই লকডাউনে সরাসরি যারা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন তাদের পাশে সরকারকে দাঁড়াতে হবে।’

নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ নিটওয়্যার প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতি-বিকেএমইএর প্রথম সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ‘মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব আমাকে জানিয়েছেন শিল্পকারখানা চালু থাকবে। পোশাক কারখানা খোলা রাখা প্রয়োজন। সামনের মাসেই পবিত্র ঈদুল আজহা। ক্রয়াদেশ অনুযায়ী পণ্য সরবরাহ দেওয়ার চাপ রয়েছে। সময়মতো সরবরাহ না দিতে পারলে ঈদের আগে ক্রেতারা অর্থ পরিশোধ করবেন না। সেটি হলে শ্রমিকদের বেতন-ভাতা দেওয়া কঠিন হবে। বর্তমানে পোশাকের ক্রয়াদেশ আসার মৌসুম। লকডাউনে কারখানা বন্ধ থাকলে ক্রেতাদের কাছে ভুল বার্তা যাবে। তারা অন্য দেশে ক্রয়াদেশ সরিয়ে নেবে। কারখানায় থাকলেও শ্রমিকরা অনেক বেশি শৃঙ্খলার মধ্যে থাকবেন। তখন স্বাস্থ্যবিধি মানাও আমাদের জন্য সহজ হবে।’

তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতি-বিজিএমইএ সহসভাপতি শহিদউল্লাহ আজিম বলেন, ‘রপ্তানিমুখী শিল্পকারখানা ও কাভার্ড ভ্যান চালু রাখতে আমরা সরকারের উচ্চপর্যায়ে অনুরোধ করেছি। কারণ লকডাউনে কারখানা বন্ধ রাখলে শ্রমিকরা গ্রামের বাড়ির দিকে রওনা দেবেন। তাতে বিশৃঙ্খলা তৈরি হবে। আমাদের ৯০ শতাংশ শ্রমিকই গণপরিবহন ব্যবহার করেন না, তারা কারখানার আশপাশে থাকেন। আবার উৎপাদন বন্ধ থাকলে ক্রয়াদেশও চলে যাবে।’

বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশন-বিটিএমএ সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন বলেন, ‘কারখানা বন্ধ হলে শ্রমিকরা পায়ে হেঁটে বাড়ি যাবেন। তাই শিল্পকারখানা খোলা রেখে শাটডাউন করা হোক। আমরা নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় শ্রমিকদের যাতায়াতের ব্যবস্থা করব।’

বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি মো. হেলাল উদ্দিন বলেন, ‘আমরা এক সপ্তাহের লকডাউন শতভাগ মানব। তবে হকারসহ যেসব অতিক্ষুদ্র উদ্যোক্তা ফুটপাথে ব্যবসা করেন তাদের জন্য সহায়তা দেওয়া হোক।’

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর