শুক্রবার, ৬ আগস্ট, ২০২১ ০০:০০ টা

বঙ্গবন্ধুর পুরো পরিবারই ছিল ক্রীড়াপ্রেমী

মোজাফ্ফর হোসেন পল্টু

বঙ্গবন্ধুর পুরো পরিবারই ছিল ক্রীড়াপ্রেমী

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পুরো পরিবারই ছিল ক্রীড়াপ্রেমী। জাতির পিতা নিজেও ভালো ফুটবল খেলোয়াড় ছিলেন। তাঁর অনেক আত্মীয়-স্বজনও ক্রীড়াপ্রেমী, ক্রীড়ামোদী, ক্রীড়াবিদ হিসেবে পরিচিত ছিল। পাকিস্তান আমলেও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ফুটবল খেলা নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। খেলার সব খোঁজখবর নিতেন।

বঙ্গবন্ধু ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের সমর্থক এবং পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। এর অন্যতম কারণ ছিল, নিজে যেমন ক্রীড়াপ্রেমী অন্যদিকে পুরান ঢাকার মাজেদ সরদার, ওয়াজেদ সরদারসহ অধিকাংশ নামি-দামি মানুষ এই ক্লাবের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। জাতির পিতা সারা জীবন কষ্ট করেছেন। আন্দোলন-সংগ্রাম করেছেন, জেল-জুলুম খেটেছেন। তার মধ্যেও খেলাধুলার ব্যাপারে একটা অন্যরকম আকর্ষণ ছিল। আমি রাজনীতিতে এসেছি, ক্রীড়াঙ্গন থেকে। আমি শান্তিনগর ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক ছিলাম। এ সংগঠনের সভাপতি ছিলেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন। গাজী গোলাম মোস্তফা আমাদের ক্লাবের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। বঙ্গবন্ধু আমাকে খেলার মাঠ থেকে রাজনীতিতে এনেছেন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনের পর পাকিস্তান অলিম্পিক নির্বাচন ছিল। বঙ্গবন্ধু তখন এ এইচ এম কামারুজ্জামান, ইউসুফ আলীকে ডেকে বললেন, তোমরা একটা মেসেজ পাঠাও, পাকিস্তান অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশনের নির্বাচন বন্ধ করা হোক। জাতির পিতার নির্দেশে তারা তাই করলেন। এই মেসেজ পাঠানোর পর নির্বাচন স্থগিত হলো। এতেই প্রমাণিত হয়, বঙ্গবন্ধুর খেলাধুলার প্রতি আকর্ষণ ছিল।  জাতির পিতা অত্যন্ত হিসেবি মানুষ ছিলেন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে সারা দেশ চষে বেড়ান তিনি। একবার বৃহত্তর ময়মনসিংহ এলাকায় তিনি সফর শেষে ধানমন্ডি ৩২ নম্বর বাড়িতে ফিরছেন। এমন সময় ঘটনাচক্রে আমিও সেখানে উপস্থিত ছিলাম। জাতির পিতা গাড়ি থেকে নামা মাত্রই সাংবাদিকরা তাকে প্রশ্ন করলেন, বৃহত্তর ময়মনসিংহে কয়টি সিট পাবেন? জবাবে জাতির পিতা বললেন, নুরুল আমিনের সিটটা পাব না। বাকিগুলো পাব। এরপর সাংবাদিকরা আবারও প্রশ্ন করলেন, সারা দেশে কয়টি সিট পাবেন? জবাবে জাতির পিতা বললেন, হয়তো এক-দুটো সিট বাদে সবই পাব। পরবর্তীতে সেই নির্বাচনে দুটি আসন ছাড়া সবই (১৬৭) আওয়ামী লীগ জয় লাভ করে। এখানেই প্রমাণিত হয়, জাতির পিতা অনেক দূরদর্শী ও হিসেবি ছিলেন। ’৭০ সালের নির্বাচনের আগে অতি বাম ও অতি ডান লোক রাস্তায় নেমে এলো। ইয়াহিয়ার নির্বাচনে যায় যারা, তারা দালাল। জাতির পিতা উল্টো উত্তর দিতেন, আমি জনগণের ম্যান্ডেট নেওয়ার নির্বাচনে অংশ নেব। ১৯৭১ সালে এপ্রিল মাসে মুজিবনগর সরকার যদি ১৯৭০ সালের নির্বাচনের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের দিয়ে না করা হতো তাহলে পাকিস্তান আমাদের বিরুদ্ধে নানা অপপ্রচার চালাত। জাতির পিতা ৭ মার্চের ভাষণে সব ধরনের নির্দেশনা দিয়েছিলেন। ১৯৭২ সালে স্বাধীন দেশে ফিরে এসে দেখলেন চারদিকে ধ্বংসস্তূপ। গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়েছিল পাকিস্তানিরা। সর্বক্ষেত্রে কঠিন পরিস্থিতি। সেখানে যোগাযোগ ব্যবস্থা, খাদ্য, কৃষি, শিক্ষা সবক্ষেত্রে দুঃসময় চলছিল। সেখানে ক্রীড়ার দিকে নজর দেওয়ার কথা না। কিন্তু বঙ্গবন্ধু তা করেছিলেন। তখন ইউসুফ আলীকে শিক্ষা ও ক্রীড়ামন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব দিয়েছিলেন তিনি। জাতির পিতা জানতেন যে আমি খেলাধুলার সঙ্গে জড়িত, সে কারণে ইউসুফ সাহেবকে জাতির পিতা বলেছিলেন, আমার সঙ্গে কথা বলে যেন ক্রীড়া ব্যবস্থা সাজানো হয়। কথাটি ইউসুফ ভাই আমাকে জানিয়েছিলেন। এরপর এক দিন জাতির পিতা আমাকে বললেন, ইউসুফের সঙ্গে আমার (বঙ্গবন্ধুর) কথা হয়েছে, খেলাধুলা কীভাবে সাজানো যায়, সে দিকে যেন নজর দেই। এরপর ফুটবল লীগ চালু করলাম। এখানে একটা ঘটনা উল্লেখ করা দরকার, ১৯৭৩ সালে জিডিআর (তৎকালীন পূর্ব জার্মানি) থেকে বাংলাদেশ সরকারকে একটা চিঠি দেওয়া হয়, তারা ক্রীড়া সংগঠককে ডিপ্লোমা প্রশিক্ষণ দেবে। সেজন্য যেন একটা নাম পাঠানো হয়। শিক্ষা ও ক্রীড়ামন্ত্রী একজন উপ-সচিবের নাম প্রস্তাব করে পাঠালেন। বঙ্গবন্ধু চিঠিটা দেখে, উপ-সচিবের নাম কেটে আমার নাম ‘পল্টু’ লিখে পাঠালেন। বঙ্গবন্ধুর রুমে টাঙ্গাইলের আবদুল মান্নান উপস্থিত ছিলেন। আমি তখন ঢাকা জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক। আমি খেলার মাঠে এসেছি, ফুটবল ফেডারেশনের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক হাসেম সাহেব আমাকে অভিনন্দন জানালেন। এরপর জানালেন আবদুল মান্নান। বিষয়টি নিয়ে আমাকে একটু ভিন্ন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়েছিল। কারণ এতে মন্ত্রী সাহেব মনঃক্ষুণœ হয়েছিলেন। 

সে সময়ে বাংলাদেশে ক্রীড়া নিয়ন্ত্রক সংস্থা (বিকেএনএস)-এর আহ্বায়ক ছিলেন আনিসুর রহমান। ইউসুফ সাহেব আবার আনিসুর রহমানকে বলেছিলেন, পল্টু সাহেব যেতে চাইলে আমাকে বললেই হতো। তখন  আনিসুর রহমান বিষয়টি ক্লিয়ার করে দিয়েছিলেন মন্ত্রীকে। যাই হোক, ১৯৭৩ সালে আমি যখন জিডিআরে গেলাম, তখন তারা আমাকে দেখে জিজ্ঞেস করেছিল, তোমাদের দাওয়াত দিয়েছিলাম। কিন্তু আসতে পারবা, এটা ভাবতে পারিনি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আমরা পাঁচ বছর একটা রুটির জন্য লাইন দিয়েছি। তোমরা মাত্র দুই বছরের মাথায় খেলাধুলা চালু করেছ, এটা অবিস্মরণীয়। এটা তোমাদের  গ্রেট লিডার জাতির পিতার জন্যই সম্ভব হয়েছে। জাতির পিতা ক্রীড়াপ্রেমী ছিলেন বলেই এটা সম্ভব হয়েছিল। আরেকটি কথা না বলেই নয়, গুলিস্তান হোটেলের পাশে মহানগর নাট্যমঞ্চে আমরা ক্লাব করার কথা বলেছিলাম। কিন্তু জাতির পিতা বলেছিলেন, এখানে ক্লাব করা যাবে না। কারণ পুরান ঢাকায় যদি বড় ধরনের ভূমিকম্প হয় তাহলে মানুষগুলোর দৌড়ে এসে দাঁড়ানোর জায়গাও থাকবে না। কাজেই এখানে ফাঁকা রাখতে হবে। এখানেই প্রমাণিত হয়, জাতির পিতা কত দূরদর্শী ছিলেন। মানুষের জন্য কত চিন্তা করতেন। খেলা সম্পর্কে তিনি সব সময় খোঁজখবর রাখতেন। ১৯৭৩ সালে একটা স্লোগান উঠল, সমাজতান্ত্রিক দেশে ক্রিকেট খেলার দরকার নেই। এরপর ১৯৭৩ সালে জাতীয় বাজেট ঘোষণা করা হলো। সেই বাজেটে ৩০ ভাগ কর ক্রিকেটের সরঞ্জামের ওপরে। আর খেলাধুলার সরঞ্জামের ওপর ১০০ ভাগ বাড়ানো হলো। এর প্রতিবাদে তৎকালীন ক্রিকেটার রকিবুল হাসান, আশরাফুল, আলতাবসহ অনেকেই প্রেস ক্লাবের সামনে গিয়ে প্রতিবাদ করতে লাগলেন। এমন সময় শেখ কামাল আমার বাসায় আসলেন। তিনি বললেন, আপনি কি দেখেছেন, প্রেস ক্লাবের সামনে ক্রিকেটাররা প্রতিবাদ করছে? আমি বললাম, দেখিনি, শুনেছি। তাকে বললাম, তুমি বিষয়টি নিয়ে তোমার পিতার (বঙ্গবন্ধু) সঙ্গে কথা বলো। শেখ কামাল আমাকেই বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কথা বলতে বললেন। আমি জাতির পিতার কাছে গেলাম। তাকে সব খুলে বললাম। আমাকে তাজউদ্দীন আহমেদের সঙ্গে পরামর্শ করতে বললেন। আমি তাজউদ্দীনের কাছে গেলাম।  উনি বললেন, কী মতলবে এসেছ? হেসে হেসে বললাম, আপনাকে দেখতে আর মতলব তো একটা আছেই। সে সময়ে আমরা ঢাকা জেলা ভলিবল খেলায় জিতলাম। তাকে দিয়ে একটা অনুষ্ঠান করলাম। প্রধান অতিথি তাজউদ্দীন আহমেদ। আমি ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের মাজেদ, ওয়ারীর হাসেম সাহেব, শহিদুর রহমান, সিদ্দিকুর রহমান, সাইফুদ্দিন, খালেক সাহেবসহ সব ক্রীড়া সংগঠককে দাওয়াত করলাম। তাদের বললাম, যেন খেলাধুলা সামগ্রীর ওপর কর বাতিল করেন সে দাবি করার। এরপর খেলাধুলার জন্য শতভাগ কর বাতিল করলেন তাজউদ্দীন আহমেদ। অনুলেখক : রফিকুল ইসলাম রনি

সর্বশেষ খবর