রবিবার, ১৫ জানুয়ারি, ২০২৩ ০০:০০ টা

সম্পদ বিক্রির টাকা বিদেশে পাচার

রুকনুজ্জামান অঞ্জন

সম্পদ বিক্রির টাকা বিদেশে পাচার

দেশের সম্পত্তি বিক্রি করে বিদেশে টাকা পাচার করে দেওয়া হচ্ছে। উন্নত দেশে বসবাসরত বাংলাদেশিদের মধ্যে এ প্রবণতা বাড়ছে। বিদেশে থেকেই তারা জমি বিক্রির জন্য ‘পাওয়ার অব অ্যাটর্নি নিতে বাংলাদেশ দূতাবাসগুলোতে ভিড় করছেন। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং কানাডায় বসবাসরত বাংলাদেশিরা সবচেয়ে বেশি পাওয়ার অব অ্যাটর্নি নিচ্ছেন। বিষয়টি নিয়ে মানি লন্ডারিং সংক্রান্ত জাতীয় সমন্বয় কমিটিতে অভিযোগ করেছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এ সংক্রান্ত এক সভায় পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন বলেছেন, ‘ইদানীং বাংলাদেশ দূতাবাসগুলোতে বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও কানাডায় বাংলাদেশিদের কাছ থেকে পাওয়ার অব অ্যাটর্নির আবেদনের মাত্রা বেড়ে গেছে। এই পাওয়ার অব অ্যাটর্নির অর্থই হচ্ছে-বাংলাদেশে এই সম্পত্তিগুলো বিক্রি হচ্ছে এবং যে কোনো উপায়ে ওই অর্থ ওইসব দেশে চলে যাচ্ছে।’

গত মাসে অনুষ্ঠিত মানি লন্ডারিং ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধে গঠিত জাতীয় সমন্বয় কমিটির সভার কার্যবিবরণীতে পররাষ্ট্র সচিবের দেওয়া এই বক্তব্য অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। ৬ ডিসেম্বরের ওই সভায় সভাপতি ছিলেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। বিষয়টি নিয়ে জানতে অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি। মেসেজ পাঠানো হলেও উত্তর দেননি। দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)-এর নির্বাহী পরিচালক  ইফতেখারুজ্জামান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বিদেশে বসবাসরত বাংলাদেশি তারাই যে শুধু পাওয়ার অব অ্যাটর্নি নিয়ে বাংলাদেশের সম্পদ বিক্রি করে পাচার করছেন-এটা ঢালাওভাবে বলা যাবে না; বরং বাংলাদেশে বসবাস করে অনেকেই বেশি অর্থ পাচার করছেন। যারা দেশে আছেন, তারা নিজেরাই জমিজমা বিক্রি করে বিদেশে একাধিক সম্পদ গড়ে তুলছেন। আমরা আজকেও যুক্তরাষ্ট্রে বাড়ি কেনার খবর দেখলাম। কানাডায় বেগমপাড়া, মালয়েশিয়ায় সেকেন্ডহোম এভাবেই হয়েছে। বিদেশের বাংলাদেশিদের হয়তো একটি ছোট অংশ জমি বিক্রি করে হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ নিচ্ছেন, কিন্তু দেশে থেকেই যারা বিদেশে অর্থ পাচার করছে-সেদিকেও সরকারের নজর দেওয়া উচিত। অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সূত্রগুলো জানায়, বাজার মূল্যে জমি রেজিস্ট্রেশন না হওয়ার সূত্র ধরে সভায় পাওয়ার অব অ্যাটর্নির মাধ্যমে অর্থ পাচারের বিষয়টি উঠে আসে। সে সময় অর্থমন্ত্রী বলেন, বাজার মূল্যে জমি রেজিস্ট্রেশন না হওয়ায় এ খাত থেকে কাক্সিক্ষত রাজস্ব আয় করতে পারছে না সরকার। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার এ প্রসঙ্গে বলেন, পাওয়ার অব অ্যাটর্নি হোক বা অন্য কোনো মাধ্যমে সম্পত্তি বিক্রি করে সে অর্থ বিদেশে নিয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কারণ বাংলাদেশের ক্যাপিটাল অ্যাকাউন্ট নন-কনভার্টেবল। আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব শেখ মোহাম্মদ সলীম উল্লাহ বলেন, জমি বিক্রি করে যারা টাকা পাচার করবে, তাদের কাছে জমির দাম কম বা বেশি তা বিবেচনার চেয়ে অর্থ দেশ থেকে নিয়ে যাওয়াই মুখ্য বিষয়। তবে বিবেচ্য বিষয় হলো জমি যেন বাজার মূল্যে রেজিস্ট্রেশন করা হয় এবং অর্থ পাচার না হয়। আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ বলছে, পাওয়ার অব অ্যাটর্নি (পিওএ) হলো একটি গুরুত্বপূর্ণ আইনি দলিল, যা একজন ব্যক্তিকে তার সম্পত্তি (সম্পত্তির জন্য অ্যাটর্নি), চিকিৎসা সংক্রান্ত বিষয় এবং তার অনুপস্থিতিতে তার পক্ষে অর্থ পরিচালনা করার জন্য অন্য ব্যক্তি বা সংস্থাকে (আম মোক্তারনামা) নিয়োগ করতে দেয়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিদেশে বসবাসরত বাংলাদেশিরা এই সুযোগ নিয়ে দেশের জমি বিক্রি করে বিদেশে নিয়ে যাচ্ছেন। দেশ থেকে নেওয়া এই অর্থ দিয়ে কেউ কেউ আবার বিদেশে জমি, ফ্ল্যাটের মালিক হচ্ছেন। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা ছাড়াও দুবাই, মালয়েশিয়ার মতো এশিয়ার দেশগুলোতেও বাংলাদেশিদের জমি ও ফ্ল্যাট কেনার খবর দিচ্ছে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো। পাওয়ার অব অ্যাটর্নির সুযোগ নিয়ে প্রতারণা ও অর্থ পাচারের মতো মানি লন্ডারিং কার্যক্রম বেড়ে যাওয়ার কারণে মানি লন্ডারিং সংক্রান্ত জাতীয় সমন্বয় কমিটি এ বিষয়টি খতিয়ে দেখছে। ওয়াশিংটনে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের (বিইআই) প্রেসিডেন্ট এম হুমায়ূন কবীর বলেন, পাওয়ার অব অ্যাটর্নির আবেদন বাড়ার অর্থ এই নয় যে, তার মাধ্যমে সম্পদ বিক্রি করে টাকা পাচার করা হচ্ছে। প্রথমত, আগে যত বাংলাদেশি বিদেশে বসবাস করতেন, এখন তার চেয়ে অনেক বেশি মানুষ বসবাস করছেন। ফলে বিভিন্ন প্রয়োজনে তারা পাওয়ার অব অ্যাটর্নির জন্য আবেদন করতেই পারেন। ফলে আবেদনের সংখ্যা স্বাভাবিকভাবেই বেড়েছে। আর এটা অপরাধও নয়, অপরাধ হচ্ছে-এর সুযোগ নিয়ে কেউ যদি দেশের সম্পদ বিদেশে পাচার করে দেয়। সাবেক এই রাষ্ট্রদূত বলেন, বিভিন্ন সূত্রে আমরা দেশ থেকে অর্থ পাচার বেড়ে যাওয়ার কথা শুনতে পারছি। এটা অর্থনীতির জন্য ভালো নয়। দেশে যাতে সম্পদ নির্বিঘ্নে রাখা যায়, সে পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। এ সংক্রান্ত আইন-বিধিগুলো সংস্কার করে অর্থ পাচার বন্ধে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করার বিষয়টিকেও সরকারের অগ্রাধিকারে রাখতে হবে। সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, অর্থ পাচার প্রতিরোধে পাওয়ার অব অ্যাটর্নি প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন আনার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। ২০১২ সালে সর্বশেষ সংশোধন করা ১৮৮২ সালের পাওয়ার অব অ্যাটর্নি আইন আবারও সংশোধন করা হবে। বিষয়টি নিয়ে পররাষ্ট্র, স্বরাষ্ট্র, আইনসহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলো মিলে এ বিষয়ক আইন সংস্কারে কাজ করছে। এ ছাড়া পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবেদিত পাওয়ার অব অ্যাটর্নিগুলোর তদন্ত করার এখতিয়ার চেয়েছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। সিআইডির একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা মানি লন্ডারিং সংক্রান্ত জাতীয় কমিটিকে বলেছেন, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যে পাওয়ার অব অ্যাটর্নিগুলো এনডোর্স করে, সেখান থেকে নমুনা ভিত্তিতে এর কপি পাঠানো হলে তারা (সিআইডি) তা তদন্ত করে দেখতে পারে।

সর্বশেষ খবর