শনিবার, ২৫ মার্চ, ২০২৩ ০০:০০ টা

স্ট্রোক-হৃদরোগে আক্রান্ত তরুণরা

♦ খাদ্যাভ্যাস, কায়িক পরিশ্রম কমে যাওয়া, ডায়াবেটিস, জাঙ্কফুডে আসক্তি দায়ী ♦ বংশগত কারণেও আক্রান্ত হচ্ছে অনেকে ♦ সচেতন হলে ঝুঁকি কমবে

জয়শ্রী ভাদুড়ী

স্ট্রোক-হৃদরোগে আক্রান্ত তরুণরা

নোয়াখালীর সোনাইমুড়ী উপজেলার বাসিন্দা আট বছরের ইয়াছির আলী। খেলতে খেলতে মাঠেই জ্ঞান হারায় সে। এরপর দেখা যায় সে বাঁ হাত, বাঁ পা নাড়াতে পারছে না এবং মুখ ডান দিকে বেঁকে গেছে। স্থানীয় হাসপাতালের চিকিৎসকের পরামর্শে তাকে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস হাসপাতালে নিয়ে আসেন অভিভাবকরা। হাসপাতালে পরীক্ষায় ধরা পড়ে স্ট্রোকে আক্রান্ত শিশু ইয়াছির। ইয়াছিরের রোগ বিষয়ে হাসপাতালের পেডিয়াট্রিক নিউরোলজি বিভাগের কনসালট্যান্ট ডা. শ্যামল সরকার বলেন, ‘এই রোগী আমাদের কাছে এলে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা যায় তার স্ট্রোক হয়েছে। এত অল্প বয়সে স্ট্রোকের রোগী সংখ্যায় কম হলেও এখন কিছুটা বাড়ছে। জন্মগত বিভিন্ন ত্রুটি, রক্তরোগ, আয়রন কম, হৃদরোগ থাকলে শিশুরা স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়। ইয়াছির ময়াময়া রোগে আক্রান্ত ছিল। এ রোগের কারণে তার ব্রেনের এক পাশের রক্তনালি সরু হয়ে যাচ্ছিল। ব্রেনের ওই অংশে রক্ত না যাওয়ায় সে স্ট্রোক করেছে। পরবর্তীতে নিউরোসায়েন্সেস হাসপাতালের শিশু নিউরো সার্জারি বিভাগের সহায়তায় তার অপারেশন করা হয়। অপারেশন না করলে পুনরায় স্ট্রোকের ঝুঁকি বেড়ে যায় এবং জীবন বাঁচানো কঠিন হয়ে পড়ে।’ বয়স বাড়লে স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ে। দেশে তৃতীয় মৃত্যুর কারণ হিসেবে স্ট্রোককে দায়ী করা হয়। কিন্তু ৪০ বছরের নিচে বয়সী তরুণ এবং শিশুরা স্ট্রোকে আক্রান্ত হচ্ছে। একই অবস্থা হৃদরোগে আক্রান্তদেরও। বর্তমান বিশ্বে এক তৃতীয়াংশ মানুষ মারা যাচ্ছে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে। কয়েক বছর আগেও দেশে বয়স্কদের মধ্যে হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা ছিল বেশি। ইদানীং তরুণদের মধ্যেও হৃদরোগের প্রবণতা বেড়েছে। পঞ্চগড়ে চা শ্রমিকের কাজ করতেন আলিফ হোসেন (২৩)। কাজ থেকে ফিরে ঘরের মেঝেতে হঠাৎ অচেতন হয়ে পড়েন। স্থানীয় হাসপাতালে নেওয়ার পর জ্ঞান ফিরলেও শরীরের এক পাশ অবশ হয়ে যায়। চিকিৎসকের পরামর্শে তাকে পঞ্চগড় থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। আলিফ হোসেনের স্ত্রী সুরাইয়া রহমান বলেন, ‘প্রথমে ডাক্তাররা বুঝতে পারছিলেন না আলিফের কী হয়েছে। ডান হাত অবশ হয়ে যাওয়া দেখে স্ট্রোক সন্দেহ করে দ্রুত ঢাকা নিয়ে আসতে বলেন তারা। আমি তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে আসি। স্ট্রোক হওয়ার পর হাসপাতালে আনতে দেরি হওয়ায় বিপদ বেড়েছে বলে জানান চিকিৎসকরা। এত অল্প বয়সে স্ট্রোক হয় এটা শুনে অবাক হয়েছি।’

ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস হাসপাতালের অধ্যাপক ডা. এম এস জহিরুল হক চৌধুরী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘এত দিন সবার ধারণা ছিল স্ট্রোক শুধু বয়স্কদের হয়। তবে সেই ধারণা এখন পরিবর্তন হয়েছে। তরুণদের স্ট্রোকের সংখ্যা বেড়েছে। ৪০ বছরের নিচে স্ট্রোক রোগী শতকরা ১০ ভাগ। একই সঙ্গে এ রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুও বেড়েছে। ৪০ বছরের নিচে স্ট্রোক দুই ধরনের হয়- রক্ত জমাট বেঁধে ও রক্তনালি ফেটে গিয়ে।’

ঢাকার বাইরে স্ট্রোকের চিকিৎসা অপ্রতুল। স্ট্রোক হলে ব্রেনে প্রতি মিনিটে ২০ লাখ নিউরন ধ্বংস হয়। তাই প্রথম উপসর্গ দেখা দেওয়ার পরের চার ঘণ্টা গোল্ডেন আওয়ার। এ সময় রোগীকে হাসপাতালে আনলে ওষুধের মাধ্যমে কিংবা অপারেশন করে রোগীকে সুস্থ করতে পারেন চিকিৎসকরা। কিন্তু দেরি হলে পঙ্গুত্ব ও জীবনহানির ঝুঁকি বেড়ে যায়। বাংলাদেশে বর্তমানে শতকরা ৫৩ ভাগ মৃত্যু হয় অসংক্রামক রোগের কারণে। এর মধ্যে শীর্ষে রয়েছে হৃদরোগ।

জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের (এনআইসিভিডি) সহযোগী অধ্যাপক ডা. আশরাফুল হক সিয়াম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘দেশে হৃদরোগী বাড়ছে। তবে আশঙ্কার কথা হলো ৪০ বছরের নিচে বয়সীদের আক্রান্ত হওয়ার হার অনেক বেড়েছে। গত সপ্তাহে আমার পরিচিত একজন ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক করে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন, তার বয়স ৩৫। সম্প্রতি আমি এক রোগীর বাইপাস সার্জারি করেছি তার বয়স ৩০। আগে আমরা বলতাম ৪০ বছর পার হলে হৃদরোগ বিষয়ে সচেতন হতে, পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাতে। কিন্তু এখন ৩০ বছর পার হলেই হৃদরোগ বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে।’

কারণ হিসেবে এই চিকিৎসক বলেন, ‘মানুষ কায়িক পরিশ্রম একদম কমিয়ে দিয়েছে। আগে মানুষ মাঠে খেলাধুলা করত কিন্তু এখন মেদ, স্থূলতা নিয়ে ভুগছে। উৎসব, আনন্দে ঘরের তৈরি খাবারের চেয়ে অনলাইনে জাঙ্কফুড অর্ডার করছে। এ ছাড়া ডায়াবেটিস আক্রান্ত ও ধূমপায়ীরাও হৃদরোগের ঝুঁকিতে আছে। এ ছাড়া পারিবারিক রোগের ইতিহাস থাকলে বংশগত কারণে অনেকে আক্রান্ত হয়। সচেতন হলে হৃদরোগের ঝুঁকি অনেকটা কমানো যাবে।’

সর্বশেষ খবর