ফিলিস্তিনের গাজায় গণহত্যা ইস্যুতে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে দক্ষিণ আফ্রিকার দায়ের করা মামলায় অন্তবর্তীকালীন রায় দিয়েছেন আন্তর্জাতিক বিচার আদালত (আইসিজে)।
শুক্রবার এই রায় দেন নেদারল্যান্ডসের হেগে অবস্থিত জাতিসংঘের এই আদালত। রায়ে গাজায় গণহত্যা ও গণহত্যার উসকানিমূলক কর্মকাণ্ড রোধে সাধ্যের মধ্যে সব ধরনের ব্যবস্থা নিতে ইসরায়েলকে নির্দেশ দিয়েছেন আইসিজে।
সেই সঙ্গে গাজায় মানবিক সংকট নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন জাতিসংঘের ওই আদালত।
তবে যুদ্ধবিরতি বা ইসরায়েলকে সামরিক অভিযান বন্ধের কোনও নির্দেশ দেননি বিচারকেরা।
এই রায়ে প্রকৃতপক্ষে ইসরায়েলই জয় পেয়েছে বলে দেশটির প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যম ‘জেরুজালেম পোস্টের’ একটি বিশ্লেষণধর্মী প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, “আন্তর্জাতিক বিচার আদালত (আইসিজে) দীর্ঘ ৩৫ মিনিট ধরে ইসরায়েলকে গালমন্দ করলেন, কিন্তু তারপর ইসরায়েল প্রতিরক্ষা বাহিনীর (আইডিএফ) বিরুদ্ধে বাস্তবিক কোনও আদেশ জারি না করে ইহুদিবাদী রাষ্ট্রটিকেই বিস্মিত করেছে।
রায়ে না ছিল যুদ্ধ বন্ধের কোনও আদেশ। না ছিল গাজা থেকে আইডিএফ সেনাদের প্রত্যাহারের কোনও নির্দেশ।
রায়ে ইসরায়েলের জন্য সমস্যাজনক ব্যবহারিক যে বিষয়টি বলা হয়েছে তা হল- এক মাসের মধ্যে আইসিজে-তে রিপোর্ট করতে হবে- গণহত্যা প্রতিরোধে ইসরায়েল কী কী ধরনের ব্যবস্থা নিয়েছে, যার মাধ্যমে সেই সময়ে আরও গুরুতর আদেশের জন্য দরজা উন্মুক্ত রাখা হল।
এছাড়া আইসিজের আদেশের অন্য সমস্ত পদক্ষেপের সঙ্গে সাধারণভাবে ইসরায়েল নিজেও একমত। সেগুলো হল- গণহত্যা করা যাবে না, মানবিক সহায়তা প্রদান করতে হবে, অভিযুক্ত যুদ্ধাপরাধের তদন্তের জন্য প্রমাণ সংরক্ষণ করতে হবে এবং ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে অবৈধ উসকানিতে জড়িত ইসরায়েলিদের বিচার করতে হবে।
আইসিজের এই জটিল সিদ্ধান্ত এবং কেন এটি ইসরায়েলের জন্য একটি বড় জয়- তা বোঝার জন্য, ডিক্লারেটিভ এবং অপারেটিভ আইনের মধ্যে পার্থক্য বুঝতে হবে।
ডিক্লারেটিভ আইন হল- মূলত কোনও পক্ষকে কোনও কিছু করতে বলা বা পরামর্শ দেওয়া। কিন্তু কোনও বাধ্যবাধকতা বা শাস্তির বিধান নেই।
শুধুমাত্র অপারেটিভ আইনে বাধ্যবাধকতা ও শাস্তি রয়েছে।
রায়ে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কোনও সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি
ইসরায়েলের সমালোচকরা আশা করেছিলেন- রায়ে যুদ্ধ শেষ করার এবং আইডিএফ সেনাদের গাজা থেকে প্রত্যাহারের আদেশ দেওয়া হবে। ২০০৪ সালে আইসিজে ইসরায়েলের পশ্চিম তীরের নিরাপত্তা বেষ্টনিকে অবৈধ ঘোষণা এবং ইসরায়েলকে এটি অপসারণের নির্দেশ দেওয়ার পরে- তাদের এই ধরনের রায়ই আশা করার কথা।
আর এটি হলে- তা ইসরায়েলকে অস্বস্তিকর অবস্থানে ফেলত। তখন হয় ইসরায়েলকে তার জাতীয় নিরাপত্তা ইস্যুকে বাদ দিতে হতো, নয়তো আইসিজের সিদ্ধান্ত অমান্য করে প্রকাশ্য অপরাধীর তকমা পেতে হতো।
এক্ষেত্রে ইসরায়েলের মিত্ররা আরও কঠিন অবস্থার মুখোমুখি হতো। তখন মিত্রদের মধ্যে কেউ কেউ ইসরায়েলকে কূটনৈতিক, এমনকি অর্থনৈতিকভাবেও শাস্তি দেওয়ার সম্ভাবনা ছিল। এটি হলে- ইসরায়েল এবং তার যুদ্ধ প্রচেষ্টার উপর বাস্তবিক-বিশ্ব প্রভাব এসে পড়ত।
কিন্তু এর পরিবর্তে, আইসিজে ফিলিস্তিনি বেসামরিক নাগরিকদের হত্যা এবং গাজায় ধ্বংসযজ্ঞের জন্য ইসরায়েলের তীব্র সমালোচনা করেছে। কিন্তু ইসরায়েলের জন্য তাৎক্ষণিক বড় ধরনের বিপর্যয় এড়িয়ে গেছে।
বর্তমানে মার্কিন এবং ইইউ মিত্রদের অবস্থান ইসরায়েলকে যুদ্ধের তীব্রতা অবশ্যই হ্রাস করতে হবে। আইসিজের এই এক মাসের সময়সীমা ইসরায়েলকে মিত্রদের সেই অবস্থান মানতে প্রভাবিত করবে।
এর মানে এই নয় যে, এক মাসের মধ্যে ইসরায়েল সেনা প্রত্যাহার করবে বা ‘সন্ত্রাসীদের’ খুঁজে বের করা বন্ধ করবে।
ইসরায়েল এক পর্যায়ে ঘোষণা করতে পারে যে, আনুষ্ঠানিক যুদ্ধ শেষ। গাজায় আনুষ্ঠানিকভাবে আইডিএফের (ইসরায়েল প্রতিরক্ষা বাহিনী) কার্যক্রম পশ্চিম তীরে যা ঘটছে, তার কাছাকাছি আইন প্রয়োগকারী সংস্থা হিসেবে ঘোষণা করা হবে। সেক্ষেত্রে ‘সন্ত্রাসীদের’ ( হামাস নেতাকর্মীদের) গ্রেফতারের উপর জোর দেওয়া এবং শুধুমাত্র আত্মরক্ষার ক্ষেত্রে তাদের উপর গুলি চালানোর কথা ঘোষণা দেওয়া হতে পারে।
ইসরায়েল হয়তো হামাস নেতাদের নির্মূল এবং ইসরায়েলি জিম্মিদের উদ্ধার সংক্রান্ত অপারেশনগুলোর জন্য ব্যতিক্রমী পদক্ষেপগুলো পরিত্যাগ করতে পারে। তবে সেগুলো বিশেষ অভিযানের লক্ষ্যবস্তু হবে, পূর্ণাঙ্গ ‘যুদ্ধ’ নয়।
এছাড়াও আরেকটি পদক্ষেপ হতে পারে ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মকভাবে উসকানিমূলক বক্তব্য দেওয়ার জন্য সরকারি কর্মকর্তাদের বিচারের আওতায় আনতে অ্যাটর্নি-জেনারেল গালি বাহরাভ-মিয়ারার হাতকে আরও শক্তিশালী করা। তিনি এখন স্পষ্টভাবে বলতে পারবেন যে, তিনি ইসরায়েলি আইন প্রয়োগ এবং যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ ও বয়কটের প্রবাহ থেকে দেশকে রক্ষা করতে পদক্ষেপ নিচ্ছেন।
৭ অক্টোবরের ঘটনা উপেক্ষা করে ৩৫ মিনিট ধরে ইসরায়েলকে গালমন্দ করায় আইসিজের বিরুদ্ধে ইসরায়েলিরা ক্ষুব্ধ হতে পারেন। তবে ইহুদিবাদী ইসরায়েল রাষ্ট্রকে রুখে দিতে তার বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী নিষেধাজ্ঞার যে জোয়ার আসতো তা তাৎক্ষণিকভাবে এড়ানো গেছে। এবং সেই ইস্যুতে অন্তত ৩০ দিনের জন্য জেরুজালেম একটি বড় বুলেটকে পাশ কাটাতে পেরেছে। সূত্র: জেরুজালেম পোস্ট
বিডি প্রতিদিন/আজাদ