১৯ এপ্রিল, ২০২৪ ২০:৩৫

বিক্ষিপ্ত সহিংসতায় ভারতে লোকসভা নির্বাচনের প্রথম দফার ভোট অনুষ্ঠিত

দীপক দেবনাথ, কলকাতা

বিক্ষিপ্ত সহিংসতায় ভারতে লোকসভা নির্বাচনের প্রথম দফার ভোট অনুষ্ঠিত

বিক্ষিপ্ত কিছু অশান্তি, সহিংসতা ছাড়া ভারতের লোকসভা নির্বাচনের প্রথম দফার ভোট গ্রহণ মোটামুটি শান্তিপূর্ণ হয়েছে। শুক্রবার প্রথম দফায় ভারতে ২১ রাজ্য ও কেন্দ্রীয় শাসিত অঞ্চলের ১০২টি লোকসভা কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ হয়। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ, মণিপুরসহ কয়েকটি রাজ্যে বিক্ষিপ্ত কিছু সহিংসতা, ভোটারদের প্রভাবিত করা, ভোট লুটের মতো ঘটনা ঘটেছে।

প্রথম দফায় তামিলনাড়ুর ৩৯টি কেন্দ্রে, রাজস্থান (১২), উত্তর প্রদেশ (৮), মধ্যপ্রদেশ (৬), উত্তরাখন্ড (৫), মহারাষ্ট্র (৫), আসাম (৫), বিহার (৪), পশ্চিমবঙ্গ (৩), অরুণাচল প্রদেশ (২), মণিপুর (২), মেঘালয় (২), ছত্রিশগড় (১), মিজোরাম (১), নাগাল্যান্ড (১), সিকিম (১), ত্রিপুরা (১), আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ (১), লাক্ষাদ্বীপ (১), পদুচেরি (১) ও জম্মু-কাশ্মীরের ১টি কেন্দ্রে ভোট নেওয়া হয়।

পশ্চিমবঙ্গের মোট ৪২ লোকসভার আসনের মধ্যে এদিন প্রথম দফায় ভোট নেওয়া হয় কোচবিহার, আলিপুরদুয়ার এবং জলপাইগুড়ি- এই তিন কেন্দ্রে। তিনটি কেন্দ্রেই তৃণমূল কংগ্রেস, বিজেপি ও বাম-কংগ্রেস জোট প্রার্থী দিলেও মূল লড়াই বিজেপি ও তৃণমূল কংগ্রেসের মধ্যে। গত নির্বাচনে এই তিনটি আসনই বিজেপির দখলে ছিল, দ্বিতীয় স্থানে ছিল তৃণমূল কংগ্রেস।

এদিন গোটা দেশেই সকাল ৭টায় শুরু হয় ভোটগ্রহণ পর্ব। কোনোরকম বিরতি ছাড়াই শেষ হয় সন্ধ্যা ৬ টায়। কিন্তু ভোট শুরুর পরই বিক্ষিপ্ত কিছু অশান্তির ঘটনা ঘটে। কখনো বিজেপির তীর তৃণমূলের দিকে, আবার কখনো বিজেপিকে নিশানা করেছে তৃণমূল।

পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহার শহরের ১৮ নম্বর ওয়ার্ডে উত্তেজনা হয়। সাধারণ ভোটারকে ভয় দেখানো এবং বাড়ি ভাঙচুর ও মারধরের অভিযোগ তৃণমূলের দুষ্কৃতীদের বিরুদ্ধে। অভিযোগ অস্বীকার করে তৃণমূল।

কোচবিহার জেলায় চান্দামারী এলাকায় তৃণমূল কর্মী সমর্থকদের ছোড়া পাথরের আঘাতে বিজেপি বুথ সভাপতি লব সরকার আহত হয়েছে বলে অভিযোগ বিজেপির। হাসপাতালে ভর্তি ওই বিজেপি নেতা। এছাড়াও নাটাবাড়ি এলাকায় তাদের আরও বেশ কয়েকজন কর্মী সমর্থকের ওপর হামলার অভিযোগ উঠেছে। আহত অবস্থায় তাদেরকে তুফানগঞ্জ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পাল্টা তৃণমূলের অভিযোগ, কোচবিহারের বিজেপি প্রার্থী কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী নিশ্চিত প্রামাণিক তার পদের অপব্যবহার করে দলীয় কার্যালয় অস্ত্র মজুদ করেছে। ইতিমধ্যে নির্বাচন কমিশনকে চিঠি লিখে অভিযোগ জানিয়েছে তৃণমূল। শীতলকুচিতে দুর্বৃত্তদের আঘাতে এক সাধারণ ভোটারের চোখ ক্ষতিগ্রস্ত হয় বলে অভিযোগ। চিকিৎসা করিয়ে আপাতত সুস্থ তিনি।

অন্যদিকে আলিপুরদুয়ারে তৃণমূলের বুথ এজেন্ট এর ওপর হামলা, তুফানগঞ্জ-২ ব্লকের হরিরহাট এলাকায় দলের অস্থায়ী কার্যালয়ে অগ্নিসংযোগ, তৃণমূল নেতা এবং তৃণমূলের বেতাগুড়ি ব্লক প্রেসিডেন্ট অনন্ত বর্মনের ওপরও হামলার অভিযোগ তুলেছে তৃণমূল। নির্বাচনী সহিংসতাসহ বিভিন্ন ঘটনায় দুই পক্ষই একে অপরের বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ দায়ের করেছে।

এদিকে প্রচণ্ড গরমে অসুস্থ হয়ে জলপাইগুড়ি জেলার ধূপগুড়িতে মৃত্যু হয় এক স্থানীয় সিপিআইএম নেতার। ধূপগুড়ি ব্লকের বিনয় সাহা মোড় এলাকায় ১৫/১২৪ নং বুথের বাইরে থাকা সিপিএমের অস্থায়ী ক্যাম্পে বসেছিলেন ৫৮ বছর বয়সী সিপিএম নেতা প্রদীপ দাস। হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ায় দলীয় কর্মী সমর্থকরা তাকে উদ্ধার করে ধুপগুড়ি মহকুমা হাসপাতালে নিলে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করে।

ভোটগ্রহণ শুরুর আগে বৃহস্পতিবার রাতে কোচবিহারের মাথাভাঙায় এক সিআরপিএফ জাওয়ানের রহস্যজনক মৃত্যু হয়। নীলেশ কুমার নিলু নামে বিহারের বাসিন্দা মাথাভাঙ্গা বাইশগুরি উচ্চ বিদ্যালয়ে কিউআরটি টিমের কমান্ডেন্ট পদে কর্মরত ছিলেন। কিন্তু রাতে হঠাৎ তার নাক মুখ দিয়ে রক্তপাত শুরু হলে হাসপাতালে নিলে তাকে মৃত ঘোষণা করা হয়।

বিক্ষিপ্ত অশান্তির ঘটনা ঘটেছে উত্তরপূর্ব ভারতের রাজ্য মণিপুরেও। রাজ্যটির রাজধানী ইমফলে বেশ কিছু ভোটগ্রহণ কেন্দ্রে বুথ দখল, ইভিএম এবং ভিভিপ্যাট মেশিন নষ্ট করে দেওয়ার অভিযোগ ওঠে। মইরাং বিধানসভার অধীন থামানপোকপি এলাকায় একটি ভোটগ্রহণ কেন্দ্রে গুলি চালানোর অভিযোগ ঘটে দুর্বৃত্তদের বিরুদ্ধে। তাতে তিনজন গুলিবিদ্ধ হয়। এরপরই অতিরিক্ত নিরাপত্তা বাহিনী মোতায়েন করা হয়। ওই ঘটনার ২৫ সেকেন্ডের একটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছে যেখানে প্রথমে দুটি গুলির শব্দ শোনা যায়, পরে আরেকটি গুলির শব্দ শোনা যায়। ইম্ফল ইস্ট জেলার থাঙ্গজু বিধানসভা কেন্দ্রের অধীন একটি ভোটগ্রহণ কেন্দ্রে ভাঙচুরের অভিযোগ ওঠে দুর্বৃত্তদের বিরুদ্ধে। স্থানীয় খঙ্গমান এলাকায় একটি বুথে ঢুকে দুর্বৃত্তরা নির্বিচারে ছাপ্পা ভোট দিতে থাকে।

মাওবাদী অধ্যুষিত ছত্রিশগড়ের বাস্তার লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত একটি জায়গায় বিস্ফোরণে এক সিআরপিএফ কমান্ডেন্ট আহত হয়েছেন। পুলিশ জানিয়েছে, বিজাপুর জেলার মাওবাদীদের পেতে রাখা ‘ইমপ্রভাইসড এক্সক্লুসিভ ডিভাইস বিস্ফোরিত হলে (আইইডি) ওই সিআরপিএফ কর্মকর্তা আহত হন।

আসামে ইভিএম বহনকারী একটি গাড়ি নদীর পানির মধ্যে ডুবে যায়। ওই গাড়িটি ফেরিতে করে নদী পারাপার করছিল। নদীর পানির স্তর বেড়ে যাওয়ার কারণে গাড়িটি আংশিক ডুবে যায়।

এদিকে গণতন্ত্রের শ্রেষ্ঠ উৎসবে যোগ দিয়ে নিজেদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছেন সমাজের বিশিষ্ট মানুষ। যোগ-গুরু বাবা রামদেব এবং তার সহযোগী আচার্য বাল কৃষ্ণান হরিদ্দারের একটি কেন্দ্রে ভোট দেন। চেন্নাইয়ের স্টেলা মেরিজ কলেজে একটি বুথে ভোট দেন অভিনেতা রজনিকান্ত, তুরা কেন্দ্রে ভোট দিয়েছেন মেঘালয়ের মুখ্যমন্ত্রী কনরাড সাংমা, থেনির একটি বুথে ভোট দেন তামিলনাড়ুর সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ও. পনিরসেলভাম, ডেলারস্পেটের বুথে ভোট দেন পদুচেরীর মুখ্যমন্ত্রী এন. রঙ্গস্বামী, বিকানেরে ভোট দেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অর্জুন রাম মেঘা ওয়াল, চেন্নাইয়ে ভোট দেন তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী এম.কে স্টালিন, কোয়ামবেদু কেন্দ্রে ভোট দেন অভিনেতা কমল হাসান, চেন্নাইয়ের আলওয়ার পেট কেন্দ্রে ভোট দেন অভিনেতা ধনুশ। ভোট দিয়েছেন বিশ্বের সবচেয়ে কম উচ্চতার নারী জ্যোতি আমগে। মায়ের কোলে চেপে মহারাষ্ট্রের নাগপুরে একটি বুথে ভোট দেন তিনি। আবার বিয়ের পোশাকে উত্তরাখাণ্ডে ভোট দিতে আসেন এক নব দম্পতি।

এদিকে ভারতের নির্বাচন নিয়ে শুক্রবার দুপুরে মধ্যপ্রদেশের দামোহ এলাকায় একটি সভা থেকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেন, ভারতকে বিশ্বের বড় শক্তিতে পরিণত করতেই এই নির্বাচন। গোটা বিশ্বে যখন যুদ্ধের পরিবেশ তৈরি হয়েছে, তখন যুদ্ধের বিরুদ্ধে কাজ করা একটি সরকার ভারতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এরকম একটি সময়ে, একটি শক্তিশালী সরকার গঠন হওয়া উচিত এবং শুধু পূর্ণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে বিজেপি সরকারই এটি করতে পারে।

চলমান নির্বাচনে কেন্দ্রে মোদি সরকারকে উৎখাত করার ডাক দিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি। এদিন মুর্শিদাবাদের নির্বাচনী প্রচারণায় গিয়ে মমতা বলেন, কংগ্রেস কিংবা সিপিএমকে একটি ভোটও নয়। তাদেরকে একটা ভোট দেওয়া মানেই বিজেপিকে দুটি ভোট দেওয়া। তৃণমূলকে বাদ দিয়ে অন্য কোন দলকে ভোট দেওয়া মানেই বিজেপির হাতকে আরও শক্তিশালী করা। চলমান নির্বাচনের পরেই তৃণমূলের নেতৃত্বে ইন্ডিয়া জোট সরকার করবে। 

এ দফায় গোটা দেশে মোট ভোটারের সংখ্যা ছিল ১৬.৬৩ কোটি, এর মধ্যে পুরুষ ভোটারের সংখ্যা ৮.৪ কোটি, নারী ভোটারের সংখ্যা ৮.২৩ কোটি, তৃতীয় লিঙ্গের ভোটার ১১,৩৭১ জন।

উল্লেখ্য, মোট সাত দফায় লোকসভার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সেক্ষেত্রে আর ছয়টি দফার ভোটগ্রহণ বাকি রয়েছে। দ্বিতীয় দফায় ২৬ এপ্রিল, তৃতীয় দফায় ৭ মে, চতুর্থ দফায় ১৩ মে, পঞ্চম দফায় ২০ মে, ষষ্ঠ দফায় ২৬ মে এবং সপ্তম শেষ দফার ভোট ১ জুন। ভোট গণনা আগামী ৪ জুন। 

বিডিপ্রতিদিন/কবিরুল

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর