একসময় যা ছিল মাছ ও কাভিয়ারের অফুরন্ত উৎস, আজ সেই কাস্পিয়ান সাগর নিজেই বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে। কাজাখস্তানের আকতাউ শহরের বাসিন্দারা খালি চোখেই দেখতে পাচ্ছেন এই হ্রদের পানি কতটা পিছিয়ে গেছে – প্রায় ১০০ মিটার! এক সময়ের চিরচেনা সেই কাস্পিয়ান সাগর আজ যেন এক মরুময়তার প্রতিচ্ছবি।
পরিবেশবিদ ও অ্যাক্টিভিস্টরা এই দৃশ্য দেখে আতঙ্কিত। তাঁদের আশঙ্কা, শতাব্দীর শেষ নাগাদ কাস্পিয়ান সাগরের জলস্তর ১৮ মিটার পর্যন্ত নেমে যেতে পারে, যা এর পৃষ্ঠের ৩৪ শতাংশ কমিয়ে দেবে। এর ফলস্বরূপ ক্ষতিগ্রস্ত হবে বহু বিপন্ন প্রজাতি, যার মধ্যে রয়েছে কাস্পিয়ান সিল ও স্টারজন মাছ, যা থেকে তৈরি হয় দামী কাভিয়ার।
আকতাউয়ের ৫১ বছর বয়সী পরিবেশবিদ আদিলবেক কোজাইবাকভের শৈশবের স্মৃতিতে আজও উজ্জ্বল হয়ে আছে স্টারজন কাভিয়ারের স্বাদ। তাঁর মা প্রতিদিন রুটি আর মাখনের সাথে কাভিয়ার মেখে খেতে দিতেন, যা তাঁদের স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী ছিল বলে তিনি বিশ্বাস করতেন। আজ ৪ দশকেরও বেশি সময় পর, কোজাইবাকভ সেই দিনের কথা মনে করে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। আকতাউয়ের দোকানে এখন আর প্রাকৃতিক কাভিয়ার মেলে না। অতিরিক্ত মাছ ধরা এবং আবাসস্থলের ধ্বংসের কারণে স্টারজন মাছ আজ বিলুপ্তপ্রায়।
কোজাইবাকভ আক্ষেপ করে বলেন, আমাদের কোনো গবেষণা করার প্রয়োজন নেই এটা জানার জন্য যে হ্রদটি শুকিয়ে যাচ্ছে। এটা খালি চোখেই দেখা যাচ্ছে।
কাস্পিয়ান সাগরের সঙ্কটের কারণ
ভূ-রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ কাস্পিয়ান সাগর রাশিয়া, কাজাখস্তান, তুর্কমেনিস্তান, ইরান ও আজারবাইজানের মাঝে অবস্থিত। এটি শুধু বিশ্বের বৃহত্তম স্থলবেষ্টিত জলাধারই নয়, চীন থেকে ইউরোপে পণ্য পরিবহনের দ্রুততম পথ 'মিডল করিডোর'-এর অংশ। এটি তেল ও গ্যাসেরও এক বিশাল উৎস।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কাস্পিয়ান সাগরের এই দশার পেছনে শুধু জলবায়ু পরিবর্তনই দায়ী নয়। এর প্রধান কারণগুলির মধ্যে অন্যতম হলো রাশিয়ার জল ব্যবস্থাপনা। ইউরোপের বৃহত্তম ও দীর্ঘতম নদী ভলগা, কাস্পিয়ান সাগরের ৮০ থেকে ৮৫ শতাংশ জলের উৎস। রাশিয়া বহু বছর ধরে ভলগা নদীর উপর বাঁধ ও জলাধার নির্মাণ করেছে এবং কৃষি ও শিল্পের জন্য এর জল ব্যবহার করেছে। এর ফলে কাস্পিয়ান সাগরে জলের প্রবাহ অনেক কমে গেছে।
কোজাইবাকভ আরও উল্লেখ করেন, একশো বছর আগেও স্টারজন মাছ কয়েক দশক ধরে বেঁচে থাকত এবং কেউ তাদের স্পর্শ করত না। সেগুলো বিশাল আকারের হত, যা আমরা ঐতিহাসিক ছবিতে দেখতে পাই। আজ স্টারজন মাছের সংখ্যা শিকারীরা ধ্বংস করেছে এবং তেল কোম্পানিগুলি এর পরিবেশ দূষিত করেছে। কাজাখস্তানের তিনটি প্রধান তেলক্ষেত্র, যা সোভিয়েত আমলে আবিষ্কৃত হয়েছিল, বিদেশি কোম্পানিগুলো এই খনিগুলো পরিচালনা করে।
আইনি লড়াই ও জনসচেতনতা
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে কাজাখস্তানের পরিবেশ আইনজীবী ভাদিম নি, "সেভ দ্য কাস্পিয়ান সি" প্রচারাভিযানের অংশ হিসেবে তাঁর নিজের সরকারের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন। তিনি যুক্তি দেন যে, বহুজাতিক তেল ও গ্যাস কোম্পানিগুলির সাথে রাষ্ট্রের গোপন চুক্তিগুলির কারণে পরিবেশের উপর তাদের প্রকৃত প্রভাব নির্ধারণ করা অসম্ভব। নি বলেন, আরহাস কনভেনশন অনুসারে পরিবেশ সংক্রান্ত তথ্যে অবাধ প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করা উচিত, কিন্তু এই চুক্তিগুলি এর পরিপন্থী।
আদালত এখনও মামলাটি গ্রহণ করেনি, তবে নি জানিয়েছেন, তাঁর আপিল ব্যর্থ হলে তিনি আন্তর্জাতিক আইনি ব্যবস্থার আশ্রয় নেবেন।
আকতাউতে কোজাইবাকভ স্থানীয় প্রশাসন, বাসিন্দা এবং নাগরিক সমাজ গোষ্ঠীর সাথে কাজ করছেন। তিনি জাতীয় পর্যায়েও পরিবেশগত উদ্যোগে যোগ দিয়ে এই সঙ্কট সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াচ্ছেন। তিনি বলেন, আমরা এই সমস্যাগুলো তৃণমূল থেকে তুলে ধরতে চাই যাতে সরকারকে দেখানো যায় যে মানুষ চিন্তিত। শুধুমাত্র পরিবেশবিদরাই নন, সাধারণ নাগরিকরাও, আকতাউয়ের বাসিন্দারা যারা এখানে বড় হয়েছেন এবং তাদের সন্তান ও নাতি-নাতনিদের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন।
আরাল সাগরের মতো কাস্পিয়ান সাগরও যেন একই নিয়তির শিকার না হয়, এটাই এখন সকলের প্রার্থনা। এই বিশাল জলরাশিকে বাঁচাতে প্রয়োজন জরুরি পদক্ষেপ এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতা।
সূত্র: আল জাজিরা
বিডি প্রতিদিন/নাজমুল