আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থাকে অসহযোগিতা করার যে অবস্থান নিয়েছে ইরান, এতে দেশটির পারমাণবিক কর্মসূচির স্বচ্ছ্বতার প্রশ্নে উদ্বেগ বাড়তে পারে। একই সঙ্গে আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক নিরাপত্তার প্রভাব নিয়েও উদ্বেগ সৃষ্টির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
অন্যদিকে, বিশ্বজুড়ে পারমাণবিক স্থাপনাগুলোর নিরাপত্তা রক্ষায় আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা (আইএইএ) কতটা ভূমিকা রাখছে, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
ইরান তাদের অসহযোগিতার অবস্থানের পেছনে আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি কমিশনের বিরুদ্ধে যথাযথ দায়িত্ব পালন না করার অভিযোগ করেছে।
সম্প্রতি ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাকে লক্ষ্যবস্তু করে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের হামলায় আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা তাদের দায়িত্ব পালন করেনি। দেশটির পার্লমেন্টই অভিযোগ করেছে।
ইরানের পার্লামেন্ট এমন অভিযোগও বলেছে যে, ‘আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা একটি রাজনৈতিক হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে।’
কী কাজ করে আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা?
প্রায় সাত দশকের পুরোনো আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা (আইএইএ) বিশ্বে পারমাণবিক শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহার নিশ্চিত করতে কাজ করে থাকে। একইসঙ্গে সংস্থাটির কাজের মধ্যে রয়েছে পারমাণবিক অস্ত্রের বিস্তার রোধ করা।
এটি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৫৭ সালে এবং এটি জাতিসংঘের অধীনে একটি স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা। সংস্থাটি এর সদস্য দেশগুলোয় পারমাণবিক স্থাপনা এবং উপকরণগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ব্যাপারে সহায়তা করে। সে ক্ষেত্রে তারা পারমাণবিক নিরাপত্তা বিষয়ক মান ও গাইড লাইন তৈরি করে।
এছাড়াও, আইএইএ পারমাণবিক প্রযুক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহারের জন্য সদস্য দেশগুলোকে প্রযুক্তিগত সহায়তাও প্রদান করে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ক্ষমতায় থাকাকালে ২০১৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি, চীন এবং রাশিয়া, অর্থাৎ পি ফাইভ প্লাস ওয়ান নামে পরিচিত পরাশক্তিগুলোর সাথে চুক্তি করে ইরান।এর ভিত্তিতে ইরানের পারমাণবিক কার্যক্রম পর্যবেক্ষণের দায়িত্বে ছিল আইএইএ।
এরপর ২০১৭ সালে ট্রাম্প প্রথবার আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর ২০১৮ সালে ইরানের সাথে পরমাণু চুক্তি বাতিল করা হয়। এরপর থেকে ইরান তার পারমাণবিক কার্যক্রমের গতি বাড়ায় এবং ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করতে থাকে।
আইএইএ’র সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইরান প্রায় ৬০ শতাংশ পর্যন্ত ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করেছে, যা পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির কাছাকাছি। সাধারণত ৯০ শতাংশের বেশি সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম পারমাণবিক অস্ত্র তৈরিতে ব্যবহার করা হয়।
ইরান পারমাণবিক বোমা তৈরির দ্বারপ্রান্তে এমন অভিযোগে দেশটির পারমাণবিক স্থাপনাকে লক্ষ্যবস্তু করে গত ১৩ জুন হামলা চালায় ইসরায়েল। এই ঘটনায় ইরানও পাল্টা হামলা চালালে দুই দেশের মধ্যে সংঘাত শুরু হয়।
বিবাদমান দুই দেশের পাল্টাপাল্টি হামলার ১০ দিনের মাথায় ইরানের তিনটি পারমাণবিক স্থাপনাকে লক্ষ্যবস্তু করে ‘সুনির্দিষ্ট’ সামরিক অভিযান চালায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। যাতে ফোর্দো, নাতাঞ্জ ও ইসফাহানের পারমাণবিক স্থাপনার ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে দাবি করেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প।
‘ইরানের নতুন পারমাণবিক স্থাপনার তথ্য অজানা’
এদিকে, পারমাণবিক অস্ত্র বিশেষজ্ঞ অ্যালেক্স বলফ্রাস বলেন, ইরানে ইসরায়েল হামলা চালানোর আগে গত ১২ জুন ইরান আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থাকে জানিয়েছিল যে, তারা একটি নতুন পারমাণবিক স্থাপনা নির্মাণ করেছে, যেটি বেশ সুরক্ষিত এবং যেখানে তারা ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করতে পারবে।
অ্যালেক্স বলেন, ‘আমরা যতটুকু জানি ওই স্থাপনা কোথায়-তা প্রকাশ করা হয়নি, হয়তো আমেরিকান বা ইসরায়েলিরাও জানে না। সম্ভবত তারা ইউরেনিয়ামগুলো ওখানে সরিয়ে ফেলতে পারে।’
হামলার তিন দিনের মাথায় বুধবার পেন্টাগনের মূল্যায়নে বলা হয়েছে, ইরানের সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম মজুদ ধ্বংস হয়নি।
এতে বলা হচ্ছে, ইরানের সেন্ট্রিফিউজগুলো প্রায় অক্ষত রয়েছে এবং ক্ষয়ক্ষতি মূলত স্থলভাগের অবকাঠামোতেই সীমাবদ্ধ রয়েছে।
এছাড়া ইরানের দুটি পারমাণবিক স্থাপনার প্রবেশপথ বন্ধ হয়ে গেছে এবং কিছু অবকাঠামো ধ্বংস বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে, ভূগর্ভস্থ মূল স্থাপনাগুলো অনেকটাই অক্ষত রয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক গোয়েন্দা সূত্র মার্কিন সংবাদমাধ্যমগুলোকে বলেছে, ‘যুক্তরাষ্ট্র ইরানকে কয়েক মাস পিছিয়ে দিয়েছে মাত্র, সর্বোচ্চ এইটুকুই।’
যদিও এটিকে ভুয়া খবর বলে উড়িয়ে দিয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। ট্রাম্পের এই দাবির পর, সিআইএ প্রধানও বলেন, তারা ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় ‘সেন্ট্রিফিউজ’ এর ব্যাপক ক্ষতি সাধন করেছেন।
ইরানের অসহযোগিতার সিদ্ধান্ত, যুক্তি কী?
ইরানের পারমাণবিক কার্যক্রম কেমন চলছে, তা তদারকি করতো আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা। ফোর্দো ও নাতাঞ্জ-এর পারমাণবিক স্থাপনায় নজরদারী বাড়ানোর জন্য সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন এবং আইএইএ’কে তা সার্বক্ষণিক নজরদারি করতে দিতে ইরানকে বলেছিল সংস্থাটি।
ইসরায়েলি ও মার্কিন হামলার পর বুধবার ইরানি পার্লামেন্ট সদস্যরা আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থার সঙ্গে সহযোগিতা স্থগিত করার পরিকল্পনা অনুমোদন করেছে।
এর আগে, ইরানি পার্লামেন্টের জাতীয় নিরাপত্তা ও পররাষ্ট্রনীতি কমিশন এর ‘খসড়া অনুমোদন করে যাতে সরকারকে আইএইএ-এর সঙ্গে সহযোগিতা স্থগিত করতে বলা হয়।’
ইরানের ওই কমিশন আইএইএ এর প্রতিবেদনকে ইরানের ওপর হামলার অজুহাত বলে অভিহিত করে। আসহযোগিতার পরিকল্পনা অনুযায়ী, ‘নিরীক্ষণ ক্যামেরা স্থাপন, পরিদর্শন এবং সংস্থায় রিপোর্ট প্রদান’ এর মতো কার্যক্রম স্থগিত থাকবে, যদি না ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়।
এছাড়া ইরানের ইসলামি এডভাইজরি কাউন্সিলের স্পিকার মোহাম্মদ বাকের কালিবাফ বলেন, ইরান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করতে চায় না, ‘আন্তর্জাতিকআণবিক শক্তি সংস্থা তাদের দায়িত্ব পালন করেনি এবং একটি রাজনৈতিক হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে।’
যদিও আইএইএ’র সর্বশেষ প্রতিবেদনে, ইরানকে অসহযোগিতার জন্য সমালোচনা করা হয়েছে।
সংস্থাটি ইরানকে অঘোষিত পারমাণবিক স্থাপনাগুলোর বিষয়ে প্রশ্নের উত্তর দিতে বলেছিল এবং ইরানের সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামের মজুদের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিল।
পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন
ইরানে ইসরায়েলের হামলা শুরুর পর আণবিক শক্তি সংস্থার প্রধান ইসরায়েলকে সতর্ক করে বলেছিলেন, কোনো পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন।
জেনেভা কনভেনশনের ৫৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, কোনো দেশের পারমাণবিক স্থাপনার উপর হামলা নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
আণবিক শক্তি সংস্থার ওয়েবসাইটে বলা আছে, ‘যদি কোনো দেশ এই আইন লঙ্ঘন করে, তাহলে তারা আন্তর্জাতিক নিন্দা এবং বিচারিক প্রক্রিয়ার মুখোমুখি হতে পারে।’-এর অর্থ হলো, জেনেভা কনভেনশন যুদ্ধের সময় দেশগুলোকে তাদের কর্মের জন্য জবাবদিহিতার আওতায় আনতে সহায়তা করে।
এদিকে, জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকে পর্যবেক্ষক দেশগুলোও ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলার নিন্দা জানিয়েছে।
জাতিসংঘে পাকিস্তানে স্থায়ী প্রতিনিধি অসীম ইফতেখার নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকে বলেন, ‘আন্তর্জাতিক পারমাণবিক শক্তি সংস্থার তত্বাবধানে থাকা পারমাণবিক স্থাপনায় এই ধরণের হামলা আইএইএ, জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের অনুচ্ছেদ ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।’
অন্যদিকে, জাতিসংঘে যুক্তরাজ্যের স্থায়ী প্রতিনিধি বারবারা উডওয়ার্ড নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকে বলেন, ‘আমাদের জানানো হয়েছিল যে, ইরান কোনো ধরনের পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করতে পারবে না, আমরা এখনো চাই তাদের সাথে কূটনৈতিক আলোচনা করে এটার মীমাংসা হোক।’
অন্যদিকে, ইরান আইএইএ-কে সহযোগিতা স্থগিত করা নিয়ে ইরানের পার্লামেন্টের নেওয়া সিদ্ধান্তের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে রাশিয়া।
বুধবার ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ নিয়মিত প্রেস ব্রিফিংয়ে বলেছেন, ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিতে হামলাই দেশটিকে জাতিসংঘের আনবিক শক্তি সংস্থা বা আইএইএ-এর সাথে সহযোগিতা স্থগিত করতে বাধ্য করেছে।
ইরানে ফিরতে চান জাতিসংঘ পরিদর্শকরা
ইরানের এমন সিদ্ধান্তের পরেও জাতিসংঘের আনবিক শক্তি সংস্থা বা আইএইএ প্রধান রাফায়েল গ্রসি বলেছেন, তার সংস্থার পরিদর্শকরা ইরানে ফেরত গিয়ে দেশটির সাথে কাজ শুরু করতে চান।
ইরানের পরমাণু কর্মসূচি শুধু কয়েক মাসের জন্য পিছিয়েছে-এমন খবরের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এই দৃষ্টিভঙ্গী আমি পছন্দ করি না, এটি দর্শকের চোখে দেখা, পরমাণু প্রযুক্তি সেখানে আছে। কারিগরি সক্ষমতাও সেখানে আছে। এটা কেউ অস্বীকার করতে পারে না।
ইরান এখন কী করবে?
আমেরিকার গণমাধ্যমে দেশটির গোয়েন্দা সংস্থার বরাত দিয়ে ইরানে হামলার যে প্রাথমিক পর্যালোচনা রিপোর্ট এসেছে, সেটি সত্যি হলে ইরান এরপর কী করতে যাচ্ছে-তা নিয়ে প্রশ্ন ও উদ্বেগ তৈরি করবে।
ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের বিমান হামলা ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি বিলম্বিত করার পরিবর্তে যতটা ক্ষতি হয়েছে, সেই ক্ষতিগ্রস্ত স্থাপনার মেরামত ও হত্যার শিকার হওয়া বিজ্ঞানীদের জায়গায় নতুন বিজ্ঞানীদের নিয়ে আসার পর-এটা আরও গতি পাবে? এমন প্রশ্ন কিন্তু এখন উঠতেই পারে।
হামলায় ক্ষয়ক্ষতি সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা পেতে সময় লাগবে। একই সাথে ইরান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির দ্বারপ্রান্তে বলে ইসরায়েল যে দাবি করছিলো, তা নিয়েও বিতর্ক চলতে থাকবে।
ইরানের কর্মকর্তারা ইতোমধ্যেই বলেছেন যে, তাদের পরমাণু কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে। যদিও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলেছেন, ইরানের আর কখনোই পরমাণু কর্মসূচি থাকবে না।
বিডি-প্রতিদিন/বাজিত