লন্ডন বৈঠকের পর এখন পর্যন্ত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করা হয়নি। সরকারের পক্ষ থেকে নির্বাচন কমিশনকে দেওয়া হয়নি রোডম্যাপের কোনো নির্দেশনাও। যদিও কমিশন বলছে তারা প্রস্তুত। কিন্তু ১৩ জুন লন্ডন বৈঠকের পরও সরকারের নীরব ভূমিকায় অনেকের মধ্যেই এ বিষয়ে সংশয় সৃষ্টি হচ্ছে। কারণ বিএনপি ও সমমনা দলগুলো নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণার দাবি জানিয়ে আসছে বহুদিন ধরে। এমন পরিস্থিতিতে গত বৃহস্পতিবার প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিনের একান্ত বৈঠক নিয়ে দেশে চলছে বিস্তর আলোচনা ও গুঞ্জন। কারণ ওই বৈঠকে শুধু তাঁরা দুজনই উপস্থিত ছিলেন। বৈঠক শেষেও প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় বা নির্বাচন কমিশন থেকে গণমাধ্যমে কোনো বক্তব্যও দেওয়া হয়নি। এজন্য বৈঠকটি নিয়ে জনমনে ব্যাপক কৌতূলহের জন্ম নিয়েছে। বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সিইসির বৈঠকের বিষয়টি পরিষ্কার হওয়া দরকার। শুধু সালাহউদ্দিন আহমেদ নয়, সব রাজনৈতিক মহল বৈঠক সম্পর্কে জানতে চায়। বৈঠক নিয়ে সবার এক প্রশ্ন-‘কী কথা হলো সিইসির সঙ্গে?’
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন হতে পারে ওই বৈঠকের প্রধান আলোচ্য বিষয় ছিল আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিনক্ষণ। কারণ লন্ডনে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের সঙ্গে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বৈঠকের পর যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়, ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন করা যেতে পারে বলে মত দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা। তখন সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড. খলিলুর রহমান বলেছিলেন, ‘সঠিক তারিখ নির্ধারণে আমরা কোনো সমস্যা দেখছি না। নির্বাচন কমিশন শিগগিরই একটা তারিখ ঘোষণা করবে।’
এর ঠিক দুই দিন পর ১৫ জুন সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ওই যৌথ ঘোষণাকে ‘সরকারি নয়’ বলে মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, যৌথ ঘোষণায় কারও ‘সই নেই’। থাকলে বলা যেত এটি ‘সরকারিভাবে’ এসেছে। এ ছাড়া পর্যবেক্ষরা বলছেন, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন কবে হবে তা নিয়ে সরকারের সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের এখনো আনুষ্ঠানিক আলোচনা হয়নি। সরকারের সঙ্গে আলোচনা হলে ইসি সরকারের ‘ভাব’ বুঝতে পারবে। তখন নির্বাচনের তারিখের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হতে পারে। সে ক্ষেত্রে গত বৃহস্পতিবার প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে অনুষ্ঠিত বৈঠকে ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন আয়োজনের ব্যাপারে সিইসি সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা পেয়ে থাকতে পারেন বলে অনেকেই মনে করছেন। প্রথা অনুযায়ী তফসিল ঘোষণার আগে নির্বাচন কমিশন সব প্রস্তুতির বিষয়ে সরকারপ্রধানকে অবহিত করে থাকে।
তবে ঘোষণা না আসা পর্যন্ত কোন বিষয়ে আলোচনা হয়েছে, তা স্পষ্ট হবে না বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। তাঁরা বলছেন, জাতীয় নির্বাচন নাকি স্থানীয় সরকার নির্বাচন আগে হবে, তা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে একটা বিভেদ আছে। জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন দেওয়ার দাবি জানিয়ে আসছে জামায়াত, এনসিপিসহ কয়েকটি দল। অন্যদিকে বিএনপিসহ বিভিন্ন দল চায় আগে জাতীয় নির্বাচন হোক। এসব বিষয় নিয়েও বৈঠকে আলোচনা হতে পারে। এ ছাড়া বিপ্লবীদের দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) ইসির কাছে দলীয় প্রতীক ‘শাপলা’ দাবি করেছে। এ নিয়েও বৈঠকে কোনো নির্দেশনা থাকতে পারে। সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য বিভিন্ন আইন সংশোধনের ব্যাপারে নির্বাচন কমিশনের প্রস্তাবনা নিয়েও আলোচনা হতে পারে। নির্বাচনি আচরণবিধিসহ সব আইন ও বিধিমালা সংশোধনের অগ্রগতি, সংসদীয় আসনের সীমানা নির্ধারণ, ভোটার তালিকা আইন সংশোধন, ভোটার তালিকা চূড়ান্তকরণ, তরুণদের ভোটাধিকার দেওয়া, প্রবাসী বাংলাদেশিদের ভোট গ্রহণের ব্যবস্থা করা, রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন, নির্বাচনি কেনাকাটা ও বরাদ্দ, গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধন নিয়েও আলোচনা হতে পারে।
পর্যবেক্ষরা মনে করছেন, প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সিইসির ওই সাক্ষাতের পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয় নির্বাচনের তফসিলের আগে একটি সুনির্দিষ্ট ভোটের তারিখও ঘোষণা করা হতে পারে। আগামীকাল সিইসি এ বিষয়ে কমিশনের সঙ্গে বৈঠকে বসতে পারেন। তখন প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকের আলোচ্য বিষয়টি সামনে আসতে পারে।
নির্বাচন বিশ্লেষকরা বলছেন, সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন নিজেই সংসদ নির্বাচনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে। যেহেতু সংবিধান এখন কার্যকর নেই, তাই প্রধান উপদেষ্টার নির্দেশনার অপেক্ষায় ছিল কমিশন। এ ছাড়া আগামী ডিসেম্বরেই নির্বাচন আয়োজনের একটা সম্ভাব্য সময় ঘোষণা করেছিলেন প্রধান উপদেষ্টা। সেজন্য সব প্রস্তুতি আছে বলে কমিশন আগেই জানিয়েছিল। তাই প্রস্তুতি নিয়ে কোনো সংকট নেই। শুধু দরকার ছিল সবুজসংকেতের। বৃহস্পতিবার হয়তো ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন আয়োজনের ব্যাপারে নির্দেশনা পেয়েছেন সিইসি। শিগগিরই হয়তো নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করবেন তিনি।