আফগানিস্তানের পূর্বাঞ্চলে পাকিস্তান সীমান্তের কাছে ভূমিকম্পের আঘাতে নিহতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯০০ জনে। সরকারি হিসেবে আহত হয়েছেন আরও তিন হাজার মানুষ। এই ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৬। এর উপকেন্দ্র ছিল প্রায় ৮ কিলোমিটার (৫ মাইল) গভীরে।
ভূকম্পবিদদের ভাষায় এটি অগভীর স্তরে সংঘটিত ভূমিকম্প, যা ভূমি কাঁপনকে অনেক বেশি তীব্র ও বিধ্বংসী করে তোলে। বিশেষ করে দুর্বল ঘরবাড়ি ও ঝুঁকিপূর্ণ সম্প্রদায়ের জন্য এই কম্পন বিধ্বংসী।
ভূমিকম্প সাধারণত অগভীর স্তরেই ঘটে। মাত্রা এক হলেও অনেক ক্ষেত্রে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণে ব্যপক পার্থক্য দেখা যায়। কিন্তু কেন?
ভূমিকম্প কীভাবে ঘটে?
সবচেয়ে সহজ ভাষায়, ভূমিকম্প তখনই ঘটে যখন পৃথিবী কেঁপে ওঠে। পৃথিবীর ভূ-পৃষ্ঠ কয়েক কিলোমিটার পুরু কঠিন শিলা দিয়ে গঠিত, যা একে অপরের সাথে লেগে থাকা চলমান টুকরোতে বিভক্ত। এসব টুকরোকে বলা হয় টেকটোনিক প্লেট। এগুলো তরল গলিত শিলার সাগরের ওপর ভাসমান থাকে। সেই গলিত শিলা ঠান্ডা হতে হতে ঘূর্ণায়মানভাবে নড়াচড়া করে, ফলে প্লেটগুলোকে একে অপরের সঙ্গে লেগে যায়।
যখন এই প্লেটগুলো মিলিত হয়, তখনই ভূমিকম্প ও আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত ঘটে। যদিও প্লেটগুলো সর্বদা নড়াচড়া করছে, কিন্তু বেশিরভাগ সময় সেগুলো একে অপরের সঙ্গে আটকে থাকে। এভাবে ভূগর্ভে প্রচুর চাপ জমে। হঠাৎ করে এই চাপ মুক্ত হলে প্লেটগুলো ফাটলের রেখা বরাবর সরে যায়। এ ধরনের ফাটলগুলোকে ফল্ট লাইন বলা হয়, যা অনেক কিলোমিটার লম্বা হতে পারে। যখন চাপ হঠাৎ মুক্ত হয় এবং প্লেট নড়ে ওঠে, তখন শক্তি চারপাশের শিলার মধ্যে বিস্ফোরিত হয়।
ভূমিকম্প কীভাবে মাপা হয়?
ভূমিকম্প পরিমাপ করতে বিজ্ঞানীরা সিসমোগ্রাফ ব্যবহার করেন। আগে এগুলো ছিল সূক্ষ্ম সূঁচের মতো যন্ত্র, যা কাঁপনকে কাগজে আঁকতো। এখন সবই ডিজিটাল পদ্ধতিতে করা হয়।
বিশ্বব্যাপী একটি বিশাল সিসমিক নেটওয়ার্ক রয়েছে, পাশাপাশি স্থানীয় ও আঞ্চলিক নেটওয়ার্কও আছে। এই তথ্যের বড় একটি অংশ ওপেন-সোর্স এবং স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংযুক্ত থাকে। অন্তত তিনটি সিসমিক রেকর্ড মিলে গেলে সিস্টেম ভূমিকম্পের অবস্থান, সময়কাল ও মাত্রা নির্ভুলভাবে নির্ধারণ করতে পারে।
ভূমিকম্প পরিমাপের বিভিন্ন পদ্ধতি থাকলেও সবচেয়ে প্রচলিত স্কেল হলো মাত্রা (Magnitude)। প্রতিবার এক ইউনিট বাড়লে তার শক্তি দশগুণ বেশি হয়। ভূমিকম্পের গভীরতাও একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান, যা ক্ষতির মাত্রাকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে। অগভীর ভূমিকম্প সাধারণত বেশি ক্ষতি করে।
অগভীর ভূমিকম্প কেন বেশি বিধ্বংসী?
একই মাত্রার হলেও গভীরতা নির্ভর করে ভূমিকম্প কতটা ক্ষতি করবে। অগভীর ভূমিকম্প সাধারণত বেশি বিধ্বংসী কারণ এর শক্তি মাটির কাছাকাছি মুক্ত হয়। ফলে মানুষ ও ভবনের ওপর সরাসরি তীব্র কাঁপন পড়ে। অন্যদিকে গভীর ভূমিকম্পে শক্তি ভূগর্ভের স্তর পার হতে হতে অনেকটাই ক্ষয় হয়ে যায়। কিন্তু অগভীর ভূমিকম্প সরাসরি ভূ-পৃষ্ঠকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করে।
ভূমিকম্পের গভীরতা সাধারণত তিনভাবে শ্রেণিবদ্ধ করা হয়:
অগভীর (০-৭০ কিলোমিটার বা ০-৪৩ মাইল)
মধ্যম গভীরতা (৭০-৩০০ কিলোমিটার বা ৪৩-১৮৬ মাইল)
গভীর (৩০০-৭০০ কিলোমিটার বা ১৮৬-৪৩৫ মাইল)
আফগানিস্তানের ভূমিকম্পগুলো কোথায় বেশি ঘটে?
আফগানিস্তান পৃথিবীর সবচেয়ে সক্রিয় ভূমিকম্প প্রবণ অঞ্চলের একটি। হিন্দুকুশ পর্বতমালা বিশেষভাবে ভূমিকম্পের হটস্পট। এ অঞ্চলে ভারতীয় প্লেট এবং ইউরেশিয়ান প্লেটের সংঘর্ষ হয়। এই সংঘর্ষের ফলে প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি হয়, যা ভূ-পৃষ্ঠে ভাঁজ ও ফাটল তৈরি করে। হিন্দুকুশ অঞ্চলে লিথোস্ফিয়ারের কিছু অংশ গভীর ম্যান্টলের দিকে ঢলে পড়ে। এর ফলেই এই অঞ্চলে এক বিরল ভূতাত্ত্বিক ঘটনা ঘটে, গভীর স্তরেও ভূমিকম্প হয়, যা পৃথিবীর খুব কম জায়গাতেই দেখা যায়।
অন্যদিকে সুলায়মান পর্বতমালা (পশ্চিম পাকিস্তান ও দক্ষিণ-পূর্ব আফগানিস্তান) এবং মেইন পামির থ্রাস্ট এলাকায় ভূমিকম্পগুলো সাধারণত অগভীর ও বিধ্বংসী হয়, কারণ এগুলো মাটির খুব কাছাকাছি ঘটে। সূত্র: আল-জাজিরা
বিডি প্রতিদিন/একেএ