উত্তর-পশ্চিম ইউরোপের একটি দেশ বেলজিয়াম। এটি ইউরোপের সবচেয়ে ক্ষুদ্রতম ও ঘনবসতিপূর্ণ দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। বেলজিয়াম একটি সমতল দেশ। এটি উন্নত ও মিশ্র অর্থনীতির দেশ।
বেলজিয়ামের ভৌগোলিক অবস্থান হলো, এর উত্তরে নেদারল্যান্ডস, পূর্বে জার্মানি ও লুক্সেমবার্গ এবং দক্ষিণে ও পশ্চিমে ফ্রান্স অবস্থিত। দেশটির আয়তন ৩০ হাজার ৫২৮ বর্গকিলোমিটার। জনসংখ্যা এক কোটি ১৩ লাখ। জনসংখ্যার ৪৯ শতাংশ খ্রিস্টান, ৪১ শতাংশ মানুষের কোনো ধর্ম নেই।
আর ৪ শতাংশ মানুষ মুসলিম। সে হিসাবে দেশটিতে মুসলিম জনসংখ্যা আনুমানিক চার লাখ ৫২ হাজার।
বেলজিয়ামে ইসলামের আগমন ও বিকাশ
বেলজিয়ামে প্রথম মুসলিম উপস্থিতি নিবন্ধিত হয় ১৮২৯ সালে। ১৯৬৪ সালে বেলজিয়াম, তুরস্ক ও মাগরেবের দেশগুলোর মধ্যে দ্বিপক্ষীয় শ্রম অভিবাসন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
এই দেশগুলো থেকে ১০ হাজার কর্মী বেলজিয়ামে আসেন। এসব কর্মীরা বেশির ভাগ কয়লা খনি, ইস্পাত তৈরি এবং অটোমোবাইলশিল্পে দক্ষ কারিগর হিসেবে চাকরি করেন। এসব কর্মীর বেশির ভাগ ছিলেন মুসলিম। ১৯৭৪ সালে বেলজিয়াম সরকার ইসলামকে একটি ধর্ম হিসেবে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি প্রদান করে। ফলে বেলজিয়ামে ইসলাম ধর্মের বিস্তার ঘটে এবং মুসলিম জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে।
২০১৪ সালে বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, বেলজিয়ামের মুসলিম জনসংখ্যা তখন ছিল ৪ থেকে ৬.৫ শতাংশ। ২০০০ সালে ‘সেন্টার ডি রিলেশনস ইউরোপেনেস’-এর তথ্য মতে, বেলজিয়ামে প্রায় ৩০ হাজার মানুষ ধর্মান্তরিত হয়েছিল। ২০১৬ সালে নিউ রিসার্চ সেন্টারের মতে, বেলজিয়ামে জনসংখ্যার ৭.৬ শতাংশ মুসলিম ছিল। বেলজিয়ামের প্রায় ৪০ শতাংশ মুসলিম রাজধানী ব্রাসেলসে বাস করে। দেশটির সংখ্যাগরিষ্ট মুসলিম সুন্নি। অনুমান করা হয়েছিল মুসলমানদের ১০ শতাংশ শিয়া মুসলিম। শিয়া মুসলমানদের বেশির ভাগ এসেছিল লেবানন, ইরান, সিরিয়া, ইরাক এবং অন্যান্য দেশ থেকে।
বেলজিয়ামের মুসলিমদের মধ্যে দেশের রাজনৈতিক বিষয়েও সচেতনতা লক্ষ করা যায়। ২০১২ সালে বেলজিয়ামের মুসলমানরা ‘ইসলাম’ নামের একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করে। চারজন প্রার্থী নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় এই রাজনৈতিক দল। ‘ইসলাম’ স্থানীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। দলটি ব্রাসেলসের মোলেনবিক এবং আন্ডারলেখট জেলায় দুটি আসন লাভ করে।
বেলজিয়াম ইসলামিক সেন্টার
বেলজিয়ামে একটি ইসলামিক সেন্টার স্থাপিত হয় ১৯৩৬ সালে। নাম আল-মারকাজুল ইসলামী আস-সাকাফি। এই সেন্টার পশ্চিম ইউরোপে ইসলামী শিক্ষা প্রচার-প্রসার এবং ইসলামী সংস্কৃতিচর্চার প্রাণকেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে।
এদিকে বেলজিয়াম সরকার ইসলামকে দেশের স্বীকৃত ধর্ম হিসেবে ঘোষণা করে। এই ঘোষণা ইসলামের বিকাশের জন্য ছিল এক বিরাট অনুষঙ্গ। ইসলাম ধর্ম হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার পর গোটা ইউরোপে ইসলামের প্রভাব দ্রুত বেড়ে যায়। ১৯৬৮ সালের শেষের দিকে বেলজিয়াম সরকার ইসলামিক সেন্টারকে সে দেশের প্রথম মসজিদ হিসেবে অনুমোদন প্রদান করে।
এই অনুমোদনের সূত্র ধরে বেলজিয়ামে ইসলামের বিকাশে আরো অনেক অগ্রগতি সাধিত হয়। ১৯৭৫ সালে বেলজিয়াম সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয় দেশটির স্কুলে অধ্যয়নরত মুসলিম শিক্ষার্থীদের জন্য ইসলামবিষয়ক পড়াশোনার অনুমতি প্রদান করে। ১৯৭৮ সালে সৌদি বাদশাহ খালেদ এই নতুন ইসলামিক সেন্টারের উদ্বোধন করেন। ১৯৮২ সাল থেকে ‘ওয়ার্ল্ড মুসলিম লীগ’ বা ‘রাবেতাতুল আলামিল ইসলামী’ এই সেন্টারের তত্ত্বাবধান করে আসছে।
বেলজিয়াম ইসলামিক সেন্টারের অধীনে ‘ইউরোপ ইসলামিক একাডেমি’ নামের একটি ইনস্টিটিউট কাজ শুরু করে ১৯৮৩ সালে। বেলজিয়ামে ইসলামী শিক্ষা বিস্তারে এই একাডেমি গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা পালন করছে। এখানকার স্নাতকধারীদের বেলজিয়ামের স্কুলগুলোতে ইসলামিয়াত পাঠদানের জন্য শিক্ষক পদে নিয়োগ দেওয়া হয়।
এক তথ্য থেকে জানা যায়, বেলজিয়ামে ৭০০-এর বেশি মসজিদ রয়েছে। এসব মসজিদের ইমাম ইউরোপ ইসলামিক একাডেমি নির্বাচন করে থাকে।
বেলজিয়াম ইসলামিক সেন্টার ইসলামিক স্কুল স্থাপন ও পরিচালনা, আরবি ভাষা শিক্ষা কোর্স পরিচালনা, মেয়েদের জন্য আলাদা স্কুল পরিচালনা, নও-মুসলিমদের জন্য প্রাথমিক শিক্ষা কোর্স পরিচালনা এবং দৈনিক ও সাপ্তাহিক ভিত্তিতে দরসুল কোরআনের ব্যবস্থা করে থাকে।
ইসলামিক সেন্টার এর বাইরে আরো কিছু কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে। এর মধ্যে রয়েছে—পাঁচ ওয়াক্ত ও ঈদের নামাজের ব্যবস্থাপনা, ইসলামের ওপর বিভিন্ন বিষয়ে সেমিনার ও কর্মশালার আয়োজন করা, বেলজিয়ামে বসবাসরত মুসলমানদের ধর্মীয় বিষয়ে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদান করা।
বেলজিয়ামে মুসলমানরা ইউরোপের অন্য দেশ থেকে বেশ ভালো অবস্থায় আছে। ফলে বেলজিয়ামে ইসলাম বিকশিত হচ্ছে। বাড়ছে মুসলিমের সংখ্যাও। দেশটিতে মুসলমানরা শক্তিশালী ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত বলে মনে করা হয়।
লেখক: প্রাবন্ধিক, শিশুসাহিত্যিক এবং ঊর্ধ্বতন ইসলামী ব্যাংকার