জলিলে কদর সাহাবি আবু মুসা আশআরি (রা.) থেকে বর্ণিত, রসুল (সা.) বলেছেন, ‘অবশ্যই এমন এক সময় আসবে, যখন আমার একদল উম্মত ভিন্ন নামে মদ পান করবে’ (আবু দাউদ, ৩৬৮৮; ইবনে মাজাহ, ৪০২০)। মুহাদ্দিসগণ এ হাদিসের দুটি ব্যাখ্যা করেছেন। একটি হলো- মানুষ কোমল পানীয়, এনার্জি ড্রিংকস, সফট ড্রিংকস ইত্যাদি নামে অ্যালকোহলসমৃদ্ধ ড্রিংকস পান করবে। তাদের বলা হবে, তোমরা তো মদ পান করছ। তারা বলবে, কই! বোতলের গায়ে তো মদ লেখা নেই। আমরা তো এনার্জি ড্রিংকস পান করছি।’ এই হলো ভিন্ন নামে মদ পান করা।
দ্বিতীয়টি ব্যাখ্যাটি আরও গভীর অর্থবহ-মানুষ সরসারি মদ পান করবে না, তবে তারা এমন জিনিসে ডুবে যাবে যেভাবে মাদকাসক্ত নেশায় বুঁদ হয়ে থাকে। কোনো সন্দেহ নেই আধুনিক প্রযুক্তির চোখধাঁধানো এই দুনিয়ায় নামহীন সেই নতুন মদ সোশ্যাল মিডিয়া। সোশ্যাল মিডিয়া মানে হলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। বোতলটির গায়ে সোশ্যাল লেখা থাকলেও ভিতরে আছে আন সোশ্যাল বা অ্যান্টি স্যোশাল মাদক।
তাবৎ গবেষক এক বাক্যে স্বীকার করেছেন, বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম চরম অসামাজিক করে তুলছে আমাদের। সমাজ তো বটেই পরিবারও ভেঙে দিচ্ছে এই অসামাজিক মাধ্যমটি। সারা দিন কাজ শেষে ক্লান্ত শরীর নিয়ে স্বামী বাসায় ফেরলে স্ত্রীর কর্তব্য স্বামীকে পানি এগিয়ে দেওয়া, খাবার বেড়ে দেওয়া, মাথায় হাত বুলিয়ে দেওয়া, ভালোবাসার আলিঙ্গন দিয়ে সব ক্লান্তি ভুলিয়ে দেওয়া।
কিন্তু আজকের স্ত্রীরা কী করছে? ফেসবুক, ইউটিউব, এক্স এসব সাইটে ডুবে থাকে। কখনো পোস্ট দেয়, কখনোবা ঘণ্টার পর ঘণ্টা রিলস দেখায় বুঁদ হয়ে থাকে। আবার ভিন্ন চিত্রও আছে। স্ত্রী সারা দিন অপেক্ষায় থাকে স্বামী কখন আসবে। একটু সুখদুঃখের আলাপ করবে। কিন্তু স্বামী বাসায় এসেই মোবাইল ফোনে ডুবে যায়। স্ত্রী-সন্তান কাউকে সময় দেয় না। এভাবে ধীরে ধীরে আমাদের পরিবারগুলো ধ্বংসের অতল গহ্বরে এসে দাঁড়িয়েছে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম আবিষ্কারের ইতিহাস কী? পাশ্চাত্য সভ্যতায় যেখানে আত্মীয়তা, সামাজিকতা জাদুঘরে পৌঁছে গেছে, যারা কাজের চাপে রোবট মানবে পরিণত হয়েছে, তাদের জন্য আবিষ্কার হয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। কিন্তু আমরা প্রাচ্যবাসী তো আগে থেকেই একান্নবর্তী পরিবারের জান্নাতে অবগাহন করছি, প্রতিবেশীদের সঙ্গে আমরা আত্মীয়ের ভালোবাসা নিয়ে বসবাস করি, ক্ষেত্রবিশেষ আত্মীয়দের চেয়েও প্রতিবেশীদের সঙ্গে আমাদের সখ্য বেশি। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজে গেলে এলাকার মুরুব্বি-যুবকদের সঙ্গে আমাদের দেখা হয়। আমরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা চায়ের দোকানে আড্ডা দিয়ে যেমন সময় নষ্ট করি, তেমনি ধর্মীয় মজলিশ, তাবলিগেও আমাদের স্বতঃস্ফূর্ত উপস্থিতি পাওয়া যায়।
মোট কথা আমরা আগে থেকেই সামাজিক। বাস্তব সামাজিক। রিয়েল সোশ্যাল লাইফে অভ্যস্ত। যে জীবন পাশ্চাত্যের হতাশাগ্রস্ত মানুষের কাছে স্বপ্নের মতো। হায়! আমরা পাশ্চাত্যের ট্যাবলেট খেয়ে দিক্ভ্রান্ত হয়ে পড়েছি। বাস্তব সামাজিকতা ভুলে আমরা ভার্চুয়াল সামাজিকতায় বুঁদ হয়ে আছি। মা অসুস্থ। তাঁর সেবা না করে দোয়া চেয়ে ফেসবুকে পোস্ট করছি। রাস্তায় কেউ দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে, তাকে হাসপাতালে না নিয়ে ছবি তোলায়, ভিডিও পোস্ট করায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছি।
সবচেয়ে ভয়ংকর ব্যাপার হলো, আমরা মোবাইল ফোন ছাড়া দুই-পাঁচ মিনিটও থাকতে পারছি না। নামাজের তাকবির বাধার আগে সর্বশেষ কাজ মোবাইল ফোন চেক করা। আবার সালাম ফেরানোর পরের কাজ মোবাইল চেক করা। ঘুমানোর আগে গভীর রাত পর্যন্ত মোবাইল ফোন ব্যবহার করি। আবার ঘুম থেকে উঠে প্রথমেই মোবাইলের দিকে তাকাই। অনেকের তো বিছানাতেই এক দুই ঘণ্টা কেটে যায় রিলস নামক আধুনিক ‘মাদকে’।
মাদক নিয়ে একটি হাদিস অনেকেরই জানা আছে। আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রসুল (সা.) বলেছেন, ‘প্রত্যেক নেশা সৃষ্টিকারী বস্তুই মাদক। তাই নেশা সৃষ্টি করে এমন প্রত্যেক বস্তুই হারাম।’ (মুসলিম, ২০০৩, মুসনাদে শোয়াইব, ৪৮৬৩)। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করা ইসলামের দৃষ্টিতে দোষণীয় নয়। ব্যবসার কাজে, সংবাদ আদানপ্রদানে সোশ্যাল মিডিয়ার গুরুত্ব অস্বীকারের সুযোগ নেই। কিন্তু আমরা যেভাবে স্ক্রিনে আসক্ত হয়ে পড়েছি এটা ইসলামের দৃষ্টিতে মারাত্মক দোষণীয়। এটা মাদকতা। এটা নিষিদ্ধ। আপনি দেখবেন, চার পাঁচ মিনিট ফোন ছাড়া থাকলে ভিতরে কেমন অস্থিরতা দেখা দেয়। মোবাইলে যদি হঠাৎ চার্জ ফুরিয়ে যায় তখন কেমন যন্ত্রণা যন্ত্রণা লাগে। যদি কোনো কারণে ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন থাকে তখন সময় এগোতে চায় না। ভিতরে শুধু একটা প্রশ্নই বারবার জাগে, কীভাবে সময় কাটাব। মোবাইল হাতে নিয়ে একই পেজ বারবার স্ক্রল করি, ঘণ্টার পর ঘণ্টা রিলস দেখি। নামাজের খবর নেই, দায়িত্বে অবহেলা, পরিবার ধ্বংস, ব্যবসা লাটে-কোনো কিছুই আমরা পরোয়া করি না।
লেখক : প্রিন্সিপাল, সেইফ এডুকেশন ইনস্টিটিউট