মানসিক উদ্বেগ বা দুশ্চিন্তা মানবজীবনের একটি স্বাভাবিক বিষয়। তবে অতীতের তুলনায় বর্তমানে তা বেশ প্রকট হয়েছে। জীবনযাত্রার জটিলতা, পারস্পরিক সম্পর্কের টানাপড়েন, আর্থিক অনিশ্চয়তা ও ভবিষ্যতের ভয় মানুষের মনে উদ্বেগ সৃষ্টি করে। তবে একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা হিসেবে ইসলাম মানুষের মন ও আত্মার প্রশান্তির পথ দেখিয়েছে।
নিম্নে এ বিষয়ে আলোচনা করা হলো—
মানসিক উদ্বেগ ও প্রশান্তির কারণ
প্রকৃত পক্ষে একজন মুমিন কখনো উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠায় আক্রান্ত হতে পারে না। কেননা সে মহাপরাক্রমশালী আল্লাহর ওপর ঈমান এনেছে এবং আল্লাহই তার সর্বোত্তম অভিভাবক। উদ্বেগে কাতর হয় দুনিয়ার মোহে আক্রান্ত ব্যক্তি।
আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তির চিন্তার বিষয় হবে পরকাল, আল্লাহ সেই ব্যক্তির অন্তরকে অভাবমুক্ত করে দেবেন, তার যাবতীয় বিক্ষিপ্ত কাজকে সুসংযত করে দেবেন, দুনিয়া হীন হয়ে তার কাছে ধরা দেবে।
আর যে ব্যক্তির চিন্তার কেন্দ্রবিন্দু হবে দুনিয়া, আল্লাহ তাআলা দরিদ্রকে তার দুই চোখের সামনে লাগিয়ে রাখবেন, তার কাজগুলোকে এলোমেলো ও ছিন্নভিন্ন করে দেবেন এবং তার জন্য যা নির্দিষ্ট করে রেখেছেন (তাকদিরে রেখেছেন) দুনিয়াতে সে এর চেয়ে বেশি পাবে না।’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস : ২৩৮৯)
মানসিক উদ্বেগ নিয়ন্ত্রণযোগ্য
কোরআন, হাদিস ও পূর্বসূরি আলেমদের নির্দেশনা থেকে জানা যায়, মানুষের উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা নিয়ন্ত্রণযোগ্য বিষয়। মূলত মানুষ তার বিশ্বাস ও কাজের মাধ্যমে তা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।
আল্লামা ইবনুল কায়্যিম জাওজি (রহ.) বলেন, ‘যদি বান্দা সকালে বা সন্ধ্যায় এ অবস্থায় উপনীত হয় যে তার একমাত্র ভাবনা এক আল্লাহ, তখন আল্লাহ তার সব প্রয়োজনের ভার বহন করেন, তার সব দুশ্চিন্তার ভার গ্রহণ করেন, তার হৃদয়কে খালি করে দেন, যাতে তাঁর ভালোবাসায় সেটি পূর্ণ হয়, তার জিহ্বাকে তাঁর জিকিরে ব্যস্ত রাখেন, তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে তাঁর আনুগত্যে নিয়োজিত করেন। আর যদি বান্দা সকালে বা সন্ধ্যায় এ অবস্থায় উপনীত হয় যে তার একমাত্র ভাবনা দুনিয়া, তখন আল্লাহ তার ওপর সব দুশ্চিন্তা ও দুর্ভাবনার ভার চাপিয়ে দিয়ে তাকে তার নিজের দিকে সমর্পণ করেন। সে আল্লাহকে ভালোবাসার বদলে মানুষকে ভালোবাসে, তার জিহ্বা আল্লাহকে স্মরণ করার বদলে মানুষের স্মরণে ব্যস্ত থাকে, তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ আল্লাহর আনুগত্যের বদলে মানুষের সেবায় ও চাকরিতে ব্যস্ত থাকে। অন্যের কাজ করতে গিয়ে সে বন্য পশুর মতো পরিশ্রম করতে থাকে।'
যেমনটি আল্লাহ বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি দয়াময় আল্লাহর স্মরণ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, আমি তার জন্য এক শয়তানকে নিয়োজিত করি, অতঃপর সে-ই হয় তার সহচর।’ (সুরা : জুখরুফ, আয়াত : ৩৬; আল-ফাওয়াইদ, পৃষ্ঠা-১৫৯)
উদ্বেগ থেকে বাঁচার উপায়
তারপরও মুমিন যদি কখনো উদ্বেগে আক্রান্ত হয়, তবে ইসলাম তা থেকে নিষ্কৃতির উপায়ও বর্ণনা করে দিয়েছে।
যেমন—
১. আল্লাহর ওপর ভরসা রাখা : মানসিক উদ্বেগ অনেক সময় আসে ভবিষ্যতের চিন্তা থেকে—কী হবে, কিভাবে হবে ইত্যাদি প্রশ্ন মানুষকে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত করে। ইসলাম শিক্ষা দেয়, সব কিছুর মালিক শুধু আল্লাহ, তিনিই আমাদের রিজিক, জীবনের গতিপথ ও পরিণতির নিয়ন্ত্রণকারী। আল্লাহ বলেন, ‘আর যে ব্যক্তি আল্লাহর ওপর ভরসা করে, তার জন্য তিনিই যথেষ্ট।’ (সুরা : তালাক, আয়াত : ৩)
২. নামাজ : নামাজ শুধু ইবাদত নয়, বরং এটি মানসিক প্রশান্তি লাভের এক অনন্য মাধ্যম। এটি দৈনন্দিন জীবনের ক্লান্তি ও উদ্বেগ থেকে মুক্তির পথ। এর মাধ্যমে আল্লাহর সাহায্য ত্বরান্বিত হয়। আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা ধৈর্য ও নামাজের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা করো। নিশ্চয়ই এটা কঠিন বিনয়ী ব্যক্তি ছাড়া অন্য সবার জন্য কঠিন।’ (সুরা : বাকারাহ, আয়াত : ৪৫)
৩. কোরআন তিলাওয়াত ও জিকির : কোরআন তিলাওয়াত ও আল্লাহর জিকির মানুষের অন্তরকে প্রশান্ত করে, যা আধুনিক গবেষণায়ও প্রমাণিত হয়েছে। জিকির ও তাসবিহ মস্তিষ্কে সেরোটোনিন হরমোনের ক্ষরণ বাড়ায়, যা মানসিক প্রশান্তি দেয়। আল্লাহ বলেন, ‘জেনে রেখো, আল্লাহর জিকিরেই অন্তরগুলো প্রশান্ত হয়।’ (সুরা : রাআদ, আয়াত : ২৮)
৪. ধৈর্য ও কৃতজ্ঞতা : ধৈর্য ও কৃতজ্ঞতা এমন দুটি গুণ, যা মানুষকে মানসিকভাবে দৃঢ় করে তোলে। দুশ্চিন্তার মুহূর্তেও যদি কেউ কৃতজ্ঞ থাকতে পারে এবং ধৈর্য ধারণ করে, তবে তার অন্তরে এক ধরনের স্বস্তি ও স্থিরতা আসে। ইমাম গাজালি (রহ.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর প্রতি খুশি থাকে, আল্লাহও তাকে নিজের জন্য পছন্দ করেন। তার অন্তরে উদ্বেগ টিকতে পারে না।’ (ইহয়াউ উলুমিদ্দিন : ২/৩৬৯)
৫. দুনিয়ার মোহ থেকে মুক্তি : বেশির ভাগ মানসিক উদ্বেগের কারণ পার্থিব জীবনের জীবনের চাওয়া-পাওয়া ও মোহ। ইসলামের শিক্ষা হলো পার্থিব জীবনের মোহ ত্যাগ করে পরকালীন জীবনকে প্রাধান্য দেওয়া। রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তির চিন্তার বিষয় হবে পরকাল, আল্লাহ সেই ব্যক্তির অন্তরকে অভাবমুক্ত করে দেবেন, তার যাবতীয় বিক্ষিপ্ত কাজকে সুসংযত করে দেবেন, দুনিয়া হীন হয়ে তার কাছে ধরা দেবে।’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস : ২৩৮৯)
আল্লাহ সবাইকে উদ্বেগমুক্ত জীবন দান করুন। আমিন।