আল্লাহ তাআলা এই মহাবিশ্বকে বিনা উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করেননি। আকাশ, পৃথিবী, পানি, আরশ ও মানুষ—সব কিছুই তাঁর অনন্ত জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও ইচ্ছার বহিঃপ্রকাশ। তবে প্রশ্ন জাগে—আল্লাহ সর্বপ্রথম কী সৃষ্টি করেছিলেন? এ বিষয়ে ইসলামিক পণ্ডিতদের মধ্যে মতভেদ আছে। কেউ বলেছেন—প্রথম সৃষ্টি ছিল কলম, কেউ বলেছেন—আরশ (সিংহাসন), আবার অনেকে বলেছেন—পানি।
প্রথম অভিমত : আল্লাহর সর্বপ্রথম সৃষ্টি ‘কলম’
আল্লামা ইবনে জারির তাবারি ও ইবনুল জাওজি (রহ.)-এর মতে, আল্লাহ তাআলা সর্বপ্রথম কলম সৃষ্টি করেন। উবাদাহ ইবনে সামিত (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, “আল্লাহ তাআলা সর্বপ্রথম কলম সৃষ্টি করেছেন। তিনি তাকে বলেন, ‘লেখো’। তখন কলম ভবিষ্যতে যা কিছু ঘটবে, কিয়ামত পর্যন্ত সব লিখে ফেলল।
” (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস : ৪৭০০)
আরেক হাদিসে রাসুল (সা.) বলেন, ‘আল্লাহ আকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টি করার ৫০ হাজার বছর আগে সব সৃষ্টির তাকদির নির্ধারণ করেছিলেন।’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস : ২১৫৬)
এই বর্ণনাগুলো থেকে বোঝা যায় যে আল্লাহ তাআলা তাঁর চিরন্তন জ্ঞান অনুযায়ী সৃষ্টির ভাগ্য লিখে রেখেছিলেন, আর এই লেখন প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল কলমের মাধ্যমেই। সুতরাং এই মতানুসারে কলমই ছিল আল্লাহর প্রথম সৃষ্টি।
দ্বিতীয় অভিমত : আল্লাহর সর্বপ্রথম সৃষ্টি ‘আরশ’।
আরেক দল আলেমের মতে, আরশ ছিল সর্বপ্রথম সৃষ্টি। সাহাবিরা আল্লাহর রাসুল (সা.)-কে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল, সর্বপ্রথম কী সৃষ্টি করা হয়েছিল?’ তিনি বলেন, ‘আল্লাহ ছিলেন, তাঁর আগে কিছুই ছিল না। আর তাঁর আরশ ছিল পানির ওপর। এরপর তিনি আসমান ও জমিন সৃষ্টি করলেন।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৭৪১৮)
আবু জাফর তাবারি (রহ.) ইবনে আব্বাস (রা.)-এর সূত্রে এরূপ বর্ণনা করেছেন, ‘আল্লাহ সর্বপ্রথম আরশ সৃষ্টি করেছিলেন এবং তিনি তার ওপর প্রতিষ্ঠিত হন।’ আরেক বর্ণনায় আবু রাজিন (রা.) বলেন, ‘আমি জিজ্ঞাসা করলাম, হে আল্লাহর রাসুল (সা.), সৃষ্টির আগে আমাদের প্রভু কোথায় ছিলেন? তিনি বললেন, ‘তিনি অন্ধকারে ছিলেন; তাঁর নিচে কোনো বাতাস ছিল না, ওপরেও না; এবং তিনি তাঁর আরশ পানির ওপর সৃষ্টি করেছিলেন।’
(সুনানে তিরমিজি, হাদিস : ৩১০৯)
এই দলিলগুলো থেকে ইবনে তাইমিয়া ও ইবনে কাইয়িম (রহ.)সহ বহু ইসলামিক পণ্ডিতের মত হলো—আল্লাহ তাআলার সর্বপ্রথম সৃষ্টি ‘আরশ’, তারপর কলম ও অন্য সৃষ্টি। ইবনে আমর (রা.) বর্ণনা করেন, ‘আল্লাহ আকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টি করার ৫০ হাজার বছর আগে সব সৃষ্টির তাকদির নির্ধারণ করেছিলেন, এবং তখন তাঁর আরশ ছিল পানির ওপর।’
(সহিহ মুসলিম, হাদিস : ২৬৫৩)
এতে বোঝা যায় যে তাকদির লেখা (যা কলম দ্বারা সম্পন্ন হয়েছিল) আরশ সৃষ্টির পর ঘটেছিল। অতএব, এই মতানুসারে আরশের সৃষ্টি কলম সৃষ্টির আগে হয়েছিল।
তৃতীয় অভিমত : আল্লাহর সর্বপ্রথম সৃষ্টি ‘পানি’।
আবু হুরাইরা (রা.) বর্ণনা করেন, তিনি রাসুল (সা.)-কে সৃষ্টির বিষয়ে জিজ্ঞাসা করেন। নবী করিম (সা.) উত্তর দেন, ‘সব কিছুই পানির মাধ্যমে সৃষ্টি করা হয়েছে।’
(মুসনাদে আহমাদ, হাদিস : ৭৯১৯)
এই হাদিস থেকে বোঝা যায়, আল্লাহ তাআলা জীবের সৃষ্টির উপাদান হিসেবে প্রথমে পানি সৃষ্টি করেছিলেন, যা ইঙ্গিত করে যে পানি প্রাণিজ সৃষ্টির আগে বিদ্যমান ছিল। আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনে বলেন : ‘তাঁর আরশ ছিল পানির ওপর।’ (সুরা : হুদ, আয়াত : ৭)
এটি ইঙ্গিত করে যে পানি ছিল প্রথম দিকের সৃষ্টি, যার ওপর আল্লাহর আরশ প্রতিষ্ঠিত ছিল। তবে এই তিনটি মতই একে অপরের বিরোধী নয়, বরং সৃষ্টির ধারাবাহিকতা ও স্তরভেদ প্রকাশ করে। সম্ভবত আল্লাহ তাআলা প্রথমে আরশ সৃষ্টি করেছেন—যা তাঁর মহিমার প্রতীক, তারপর পানি—যা জীবনধারার ভিত্তি এবং এরপর কলম—যা জ্ঞানের মাধ্যমে তাকদিরের ঘোষণা।
অতএব, এ থেকে বোঝা যায় যে সৃষ্টি কোনো কাকতালীয় ব্যাপার নয়, বরং তা এক মহান পরিকল্পনার বাস্তব রূপ, যেখানে প্রতিটি কণায়, প্রতিটি বিন্দুতে ফুটে আছে আল্লাহর প্রজ্ঞা।
বিডি-প্রতিদিন/সালাহ উদ্দীন