২০১৪ সালে ভারতের লোকসভার ভোটের আগে সারদা আর্থিক কেলেঙ্কারিতে পশ্চিমবঙ্গের শাসকদল তৃণমূলের লেজে গোবরে অবস্থা এখনও স্মৃতি থেকে হারিয়ে যায়নি। বিষয়টির গভীরতা যাই হোক না কেন, ভোট বাক্সে তার তেমন একটা প্রভাব পড়েনি। লোকসভা ভোটে ৪২ টি আসনের মধ্যে ৩৪ টি আসন পেয়েছিল তারা। এরপর পুরসভা ও পঞ্চায়েত ভোটেও তৃণমূলের জয়ের ধারা অব্যাহত ছিল। যদিও সারদা নিয়ে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির কাছে যথেষ্ট বেইজ্জত হতে হয়েছিল তৃণমূলকে।
দুই বছরের মধ্যেই আবার একটা ভোট। আবার একটা কেলেঙ্কারি। আবার সেই শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেস। শুধুমাত্র সারদা'র জায়গায় নারদা। এবারের বিধানসভা নির্বাচনে প্রধান ইস্যুই হল নারদা নিউজের করা স্টিং অপারেশনটি। যেখানে তৃণমূলের একাধিক শীর্ষ সাংসদ, নেতা, মন্ত্রীদের ঘুষ নিতে দেখা গেছে। ক্যামেরার সামনে ঘুষ নেওয়ার সেই ছবি গণমাধ্যমে প্রকাশিত হতেই তোলপাড় ভারতের রাজ্য-রাজনীতিতে। কংগ্রেস থেকে শুরু করে সিপিআইএম, বিজেপি প্রত্যেকেই প্রচারণার ইস্যু করেছে এই ঘুষ কেলেঙ্কারিকে। অবস্থা এমন যে ভবানীপুরের মতো হেভিওয়েট কেন্দ্রে রাজ্যটির মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়কে হারানোরও স্বপ্ন দেখা শুরু হয়েছে বাম-কংগ্রেস জোট শিবিরে। এই কেন্দ্রের জোট প্রার্থী সাবেক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ও সাবেক কংগ্রেস দীপা দাশমুন্সি মমতাকে কটাক্ষ করে বলেই ফেলেছেন, 'দিদি এসেছিলেন স্যান্ডেলে, যাবেন স্ক্যান্ডেলে'।
দুই দিন আগেই পশ্চিম মেদিনীপুরের খড়গপুরে প্রচারণায় এসে দুর্নীতি নিয়ে মমতাকে তোপ দাগেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তাঁর অভিযোগ দলের সব শীর্ষ নেতারাই ক্যামেরার সামনে রুপি নিচ্ছেন। এখানেই থামেননি, মমতার নাম করেও আক্রমণ শাণিয়ে বলেছিলেন মমতা এখন শাহেনশা হয়ে গিয়েছেন, রাজ্যের দিকে তাঁর কোন মন নেই। কিন্তু মোদির সেই আক্রমণের পাল্টা জবাব দিতে দেখা যায় নি মমতাকে। এমনকি মোদির নাম পর্যন্ত নেন নি মমতা। শুধু মাত্র কেন্দ্রীয় সরকারকে দোষ দিয়েই নিজের বক্তৃতা শেষ করে দেন মুখ্যমন্ত্রী। মোদি চলে যাওয়ার পরই মঙ্গলবার পশ্চিমবঙ্গ সফরে এসে বিজেপি সভাপতি অমিত শাহও ‘সারদা থেকে নারদা’ দুর্নীতি ইস্যুতে বিঁধেছেন মমতাকে। এমনকি এই ঘটনার প্রকৃত কারণ অনুসন্ধানে সিবিআই তদন্তের দাবিও জানিয়েছে তিনি।
সারদার মতোই নারদ স্টিং অপারেশন ভোটের মুখে পশ্চিমবঙ্গের মানুষের মনে কোন প্রভাব ফেলতে পারবে কি না তা বোঝার জন্য ফলাফলের দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। তবে এটা পরিস্কার যে শাসকদল গত পাঁচ বছরে তাদের উন্নতির ফিরিস্তি তুলে ধরে আবার মানুষে দরবারে ভোট ভিক্ষা চাইতে বেরোচ্ছেন সেখানে নারদ ইস্যুটি যথেষ্ট বিপাকে ফেলছে। মমতা বন্দোপাধ্যকে নিয়ে কাগজে কলমে বিরোধীরা ছাড়া সাধারণ মানুষের মনেও একটা বড় রকমের আস্থা রয়েছে। কিন্তু মমতার সততাকে ভাঙিয়ে দলের যারা যারা করে-কম্মে খেয়েছেন বা খাচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে তাদের দায়টাও ঘুরিয়ে এসে পড়ছে মমতার ওপর। ‘ডাল মে কুছ কালা হ্যায়’ সেটা হয়তো মমতা নিজেও বুঝতে পারছেন। আর তাই নারদা নিয়ে মমতা আশ্চর্যজভাবে নীরবতা পালন করেছেন। বিরোধীদের দাবি মেনে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়ার সাহস দেখাতে পারছেন না দিদি। কারন ভোটের আগে যদি 'ঝুলি থেকে বেড়াল বেরিয়ে যায়' এই ভয়ে।
তার ওপর নারদা নিয়ে তৃণমূলের এক একজন নেতার এক এক রকম মন্তব্যে দলের বিড়ম্বনা আরও বাড়ছে। যে সাধারণ মানুষ গত বিধানসভা ভোটে দুই হাত তুলে মমতাকে আশীবার্দ করেছে তারা কি করবেন ভেবে কুল পাচ্ছেন না। আর তাই উত্তরবঙ্গ থেকে দক্ষিণবঙ্গে প্রচারণায় গিয়ে মমতাকে বলতে হচ্ছে 'আলাদা করে প্রার্থী দেখবেন না। ২৯৪ টা আসনে আমিই প্রার্থী। আমাকে দেখেই ভোট দিন'। রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ বিশ্বনাথ চক্রবর্তী জানিয়েছেন, 'সারদা আর্থিক কেলেঙ্কারির পর ঠিক সময়ে ড্যামেজ কন্ট্রোল করেছিল বলে তৃণমূলের জয়ের ধারা অক্ষত ছিল। কিন্তু নারদা স্টিং অপারেশটি তাদের কাছে বিনা মেঘে বজ্রাঘাত হয়ে দেখা দিতে পারে'।
নারদা স্টিং অপারেশন যে রাজ্য সরকার ও মমতার ভাবমূর্তিকে ক্ষুন্ন করেছে তা সম্প্রতি একটি জরিপেই উঠে এসেছে। এসি নিয়েলসন ও এবিপি আনন্দে'র যৌথ জরিপে দেখা গেছে রাজ্যের ৬৭ শতাংশ মানুষ মনে করেন স্টিং ঘটনায় রাজ্য সরকারের ভাবমূর্তি ধাক্কা খেয়েছে এবং ৫৬ শতাংশ মানুষ মনে করেন এই ঘটনায় মমতার ব্যক্তিগত ভাবমূর্তি ধাক্কা খেয়েছে।
২০১১ সালে তহেলকা ঘুষের ঘটনা সামনে আসতেই এনডিএ সরকার ছেড়ে বেরিয়ে আসেন মমতা। এবার নিজ দলের নেতাদের বিরুদ্ধে ঘুষের অভিযোগ। কী করবেন মমতা- এ প্রশ্ন এখন রাজনৈতিক অঙ্গনে ঘুরপাক খাচ্ছে।
বিডি-প্রতিদিন/৩১ মার্চ ২০১৬/ এস আহমেদ