১৯ মে'র পর পশ্চিমবঙ্গের শাসন ক্ষমতায় কে আসবে তা নিয়ে ইতোমধ্যেই বিস্তর জল্পনা শুরু হয়েছে। যদিও সোমবারের বুথ ফেরত জরিপে স্পষ্ট ইঙ্গিত মিলেছে যে, এবারেও দিদির দখলেই থাকবে বাংলা। যদিও বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি এই জরিপ মানতে নারাজ। বিরোধী জোটের দুই নেতা সিপিআইএম নেতা সূর্যকান্ত মিশ্র ও কংগ্রেসের অধীর চৌধুরী-দুইজনেরই দৃঢ় বিশ্বাস জোটই ক্ষমতায় আসছে। তবে ক্ষমতায় কে আসবে-তা নিয়ে যেমন যেমন কৌতুহলের শেষ নেই ঠিক তেমনি রাজ্যটিতে এবার নজরকাড়া কেন্দ্রগুলির হেভিওয়েট প্রার্থীদের কপালে কি আছে তা জানতেও ভোটাররা সমান আগ্রহী।
রাজ্যের ২৯৪টি আসনের অনেকগুলিতে এবার প্রতিটি রাজনৈতিক দলের তরফে একাধিক রাজনীতিবিদ, সেলিব্রেটি, বিদ্বজনেরা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। এরমধ্যে হেভিওয়েট প্রার্থী বলতে যার নাম প্রথমেই আসে তিনি হলেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়। ২০১১ সালের বিধানসভার উপনির্বাচনে দক্ষিণ কলকাতার ভবানীপুর কেন্দ্র থেকে জিতেছিলেন মমতা। সেবার সিপিআইএম প্রার্থীকে অধ্যাপক নন্দিনী মুখোপাধ্যায়কে ৫৪২১৩ ভোটে হারিয়ে জয়লাভ করেছিলেন তৃণমূল নেত্রী। এবারে এই কেন্দ্রে মমতার বিরুদ্ধে বাম-কংগ্রেসের জোট প্রার্থী হয়েছেন কংগ্রেসের সাবেক সাংসদ দীপা দাশমুন্সি, বিজেপি’র হয়ে লড়াই করেছেন নেতাজি সুভাষ চন্দ্রের নাতি চন্দ্র কুমার বসু। এতএব লড়াইটা যে একটু কঠিন তা সকলেই মেনে নিয়েছেন। তবে অনেকেই বলছেন, ভবানীপুর থেকে যিনিই দাঁড়ান না কেন মমতার বিরুদ্ধে, তিনি পরাজিত হবেনই। কিন্তু মমতার বিরুদ্ধে কেউ ধোপে টিকবে না বলে যারা দাবি করছেন তাদের মনে রাখা উচিত, ২০১১ সালে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যও কিন্তু পরাজিত হয়েছিলেন যাদবপুর থেকে। শুধু তাই নয়, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও সিপিএমের হেভিওয়েট সোমনাথ চট্টপাধ্যায়কে হারিয়ে দিয়েছিলেন। তাই জোটের প্রভাবে এবং বিজেপির তুরুপের তাস চন্দ্র বসুর ভোট কাটাকাটিতে মমতা’র জেতার পথ কি আদৌ মসৃণ হবে সেদিকেই এখন নজর রাজ্যবাসীর।
ভবানীপুরের পরই এবারের ভোটে যে কেন্দ্রটির দিকে নজর থাকবে তা হল কামারহাটি। পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক ইতিহাসে এই প্রথম কারাগারের মধ্যে থেকে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন কোন প্রার্থী। সারদা আর্থিক কেলেঙ্কারির সাথে যুক্ত থাকার অভিযোগে মন্ত্রিত্ব খুইয়ে গত দুই বছর ধরে কারাগার-হাসপাতালের চার দেওয়ালের মধ্যে কাটাতে হয়েছে। এবার সেই মদনকেই প্রার্থী করেছেন মমতা। কারাগারে থেকে তার নির্দেশেই মদনের হয়ে প্রচারণায় নেমেছিলেন স্ত্রী, পুত্র, পুত্রবধূ। মদনকে হারাতে দুর্নীতিকে হাতিয়ার করে সর্বশক্তি দিয়ে প্রচারণা করেছিল সিপিআইএম প্রার্থী সাবেক বিধায়ক মানস মুখার্জি এবং বিজেপি’র কৃশানু মিত্রও। যদিও মদন মিত্র নিজে দাবি করেছেন, তিনি এবার ৫ হাজার ভোটে জিতবেন। সবকিছুর পরেও নির্বাচনে যদি সত্যিই মদনের জিত হয় তবে সেটাও ইতিহাস হয়ে থাকবে রাজ্যের রাজনীতিতে।
পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার একটি কেন্দ্র নারায়ণগড়। বুথ ফেরত সমীক্ষায় বাংলার একটি বৈদ্যুতিন গণমাধ্যমে এই কেন্দ্র থেকে বাম-কংগ্রেস জোটের প্রধান নেতা, সিপিআইএম-এর বর্তমান বিধায়ক ও বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র হারছেন বলে দেখানো হয়েছে। তবে সত্যিই তিনি হারছেন না কি তৃণমূল প্রার্থী প্রদ্যুৎ ঘোষ বাজিমাৎ করবেন সেদিকেই তাকিয়ে রাজ্যবাসী।
উল্লেখযোগ্য কেন্দ্রগুলির মধ্যে আরেকটি অন্যতম হল হাওড়া উত্তর। এই কেন্দ্রের বিজেপি প্রার্থী রূপা গাঙ্গুলীর বিরুদ্ধে প্রার্থী হয়েছেন তৃণমূলের সাবেক ভারতীয় ক্রিকেটার লক্ষীরতন শুক্লা ও বাম-কংগ্রেস জোট প্রার্থী সন্তোষ পাঠক। রূপালী জগত থেকে বিজেপিতে নাম লেখানোর পরই দলের নারী নেত্রী হিসাবে জনপ্রিয় হয়ে উঠে মহাভারতের ‘দ্রৌপদী’। এখন রাজনীতিতেও ছাপ ফেলতে পারেন কি না সেটাই দেখার।
বসিরহাট দক্ষিণ কেন্দ্রে বিজেপির বর্তমান বিধায়ক সমীক ভট্টাচার্যকে এবার তৃণমূলের সেলিব্রিটি প্রার্থী দীপেন্দু বিশ্বাসের বিপক্ষে কঠিন লড়াইয়ের মুখোমুখি পড়তে হয়েছে বলেই ধারণা সকলের। ২০১৪ সালে উপনির্বাচনে অল্প সংখ্যক ভোটে জিতে একমাত্র সদস্য হিসাবে বিধানসভায় খাতা খুলেছিল বিজেপি। এবারও জয়ের সেই ধারা বজায় থাকবে কি না তা সময়ই বলবে।
খড়গপুর সদর থেকে এবার কঠিন প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নেমেছেন বিজেপি’র পশ্চিমবঙ্গ শাখার সভাপতি দিলীপ ঘোষ। তার প্রধান প্রতিপক্ষ এই কেন্দ্র থেকেই ১০ বারের বিজয়ী কংগ্রেস বিধায়ক জ্ঞান সিং সোহনপাল, তৃলমূলের প্রার্থী হয়েছেন রামপ্রসাদ তিওয়ারি।
নির্বাচনী ময়দানে এই প্রথম প্রার্থী হয়েছেন অভিনেত্রী লকেট চট্টোপাধ্যায়। বিজেপি’র টিকিটে তিনি লড়েছেন বীরভূমের ময়ূরেশ্বর কেন্দ্র থেকে। তার প্রতিপক্ষ তৃণমূলের অভিজিত রায় এবং সিপিআইএম-এর অরূপ বাগ। জেলার তৃণমূল নেতা অনুব্রত মন্ডলের হুমকিকে ডোন্ট কেয়ার করে যিনি দাপট নিয়ে ভোটের প্রচার করেছিলেন সেই দাপটই তাঁকে আবার বিপাকেও ফেলেছিল। ভোটের দিন বুথের মধ্যে ঢুকে প্রিসাইডিং অফিসারের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করার জন্য এবং হুমকি দেওয়ার অভিযোগে কমিশন তাকে শোকজ ও করেছিল।
একইভাবে নজর থাকবে সোহমের দিকেও। বাঁকুড়ার বড়জোড়া আসনে এই প্রথম নির্বাচনে লড়াই করেছেন তৃণমূলের সেলিব্রিটি প্রার্থী সোহম চক্রবর্তী। এই কেন্দ্রে তাঁর বিপক্ষে দাঁড়িয়েছেন সিপিআইএম’এর সুজিত চক্রবর্তী ও বিজেপি সুজিত অগাস্তি।
শিলিগুড়ি কেন্দ্র থেকে এবার তৃণমূলের টিকিটে লড়ছেন ভারতীয় ফুটবলের সাবেক অধিনায়ক বাইচুং ভুটিয়া। এই কেন্দ্র থেকেই লড়াই করেছেন সাবেক মন্ত্রী সিপিআইএম’এর অশোক ভট্টাচার্য। এর আগে ২০১৪ সালে লোকসভার নির্বাচনে দার্জিলিং কেন্দ্র থেকে বিজেপি প্রার্থী এস.এস.আলুওয়ালিয়ার কাছে ১,৯৬,৭৯৫ ভোটে পরাজিত হয়েছিলেন বাইচুং। এবার কি হবে সেটাই দেখার।
কলকাতার চৌরঙ্গী কেন্দ্রে এবার নজর থাকবে কংগ্রেসের সিনিয়র নেতা সৌমেন মিত্র’এর দিকে। এই কেন্দ্রে বর্তমান বিধায়ক তৃণমূলের অভিনেত্রী প্রার্থী নয়না বন্দোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে এবার লড়াইয়ে নেমেছিলেন সৌমেন মিত্র। পশ্চিমবঙ্গের সাবেক কংগ্রেস সভাপতি গত ২০০৯ সালে দল পরিবর্তন করে তৃণমূলের টিকিটে সাংসদ নির্বাচিত হয়েছিলেন কিন্তু পরে তৃণমূল ছেড়ে ফের পুরোনো দল কংগ্রেসেই ফিরে আসেন তিনি।
কলকাতার জোড়াসাঁকো কেন্দ্রে বর্তমান বিধায়ক তৃণমূলের স্মিতা বক্সির বিরুদ্ধে প্রার্থী হয়েছিলেন রাজ্যটির সাবেক বিজেপি সভাপতি রাহুল সিনহা।
নজর থাকবে বেহালা পশ্চিম বিধানসভা কেন্দ্রের দিকেও। এই কেন্দ্রের প্রার্থী রাজ্যটির শিক্ষা মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়। ২০০১ সাল থেকে এই কেন্দ্র থেকে জয়ী হয়ে আসছেন তিনি। এবার তার প্রতিপক্ষ সিপিআইএম’এর কৌস্তভ চ্যাটার্জি।
দক্ষিণ কলকাতার আরেকটি উল্লেখযোগ্য কেন্দ্র হল যাদবপুর। ২০১১ সালে এই কেন্দ্রের বিধায়ক রাজ্যটির সাবেক মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে হারিয়ে লাইমলাইটে চলে আসেন তৃণমূল প্রার্থী সাবেক সচিব মণীশ গুপ্ত। এবার এই কেন্দ্র থেকে মণীশের বিপক্ষে লড়াইয়ে নেমেছিলেন সিপিআইএম’র সুজন চক্রবর্তী। ২০০৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে এই কেন্দ্র থেকে সিপিআইএম’এর টিকিটে জয়ী হয়েছিলেন এই বাম নেতা।
অন্য কেন্দ্রগুলির সাথেই এবার নজর থাকবে সিঙ্গুর বিধানসভা কেন্দ্রের দিকেও। টাটাদের ছোট গাড়ি (ন্যানো) কারখানা গড়ে ওঠাকে কেন্দ্র করে একসময় উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল এই সিঙ্গুর। পরবর্তী সময়ে এই সিঙ্গুরের জমি আন্দোলনকে হাতিয়ার করেই রাজ্যে ক্ষমতায় এসেছিল মমতার তৃণমূল কংগ্রেস। কিন্তু ক্ষমতার পালা বদল হলেও টাটারাও আর ফিরে আসেনি, সিঙ্গুরের মানুষেরও কোন আমূল পরিবর্তন হয়নি। এবার এই কেন্দ্র থেকেই বর্তমান বিধায়ক তৃণমূলের মন্ত্রী রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের বিপক্ষে লড়াই করেছেন সিপিআইএম-এর রবীন দেব এবং বিজেপির সুরেন পাত্র।
দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলার রায়দিঘি কেন্দ্র থেকে তৃণমূলের অভিনেত্রী প্রার্থী দেবশ্রী রায় টানা দ্বিতীয়বারের জন্য বিধায়ক হন কি এবার সেদিকে তাকিয়ে আছে এলাকার মানুষ। ২০১১ সালে রাজ্যের তৎকালীন মন্ত্রী সিপিআইএম প্রার্থী কান্তি গাঙ্গুলীকে হারিয়ে প্রথমবারেই বাজিমাৎ করেছিলেন দেবশ্রী। এবারও মুখোমুখি লড়াইয়ে নেমেছিলেন তারা। কিন্তু স্থানীয়দের একাংশের অভিযোগ, ভোটের পর থেকে ওই কেন্দ্রে দেবশ্রীকে আর দেখা যায়নি। যা নিয়ে মানুষের মধ্যে ক্ষোভও রয়েছে। যার আঁচ পেয়েছেন দেবশ্রী নিজেও। এখন দেখা যাক দেবশ্রীকে পরাজিত করে ফের কান্তির ওপর মানুষ আস্থা রাখতে পারেন কি না।
কুচবিহারের দিনহাটার দিকেও রয়েছে সবার নজর। কারণ এই কেন্দ্রে লড়াই করছেন দীর্ঘদিন বাম ঘরানার রাজনীতি করে আসা ফরওয়ার্ড ব্লকের নেতা উদয়ন গুহ। এবার দল ছেড়ে তৃণমূলে যোদ দিয়েছেন তিনি। তার বাবা কমল গুহ সাবেক বামফ্রন্ট সরকারের ক্যাবিনেট মন্ত্রীও ছিলেন। তাই বাবা নাকি নিজের ক্যারিশমার ওপর ভর করে এই আসনটিতে জেতেন সেদিকেই তাকিয়ে মানুষ।
দক্ষিণ পব্বিশ পরগনা জেলার ভাঙড় কেন্দ্রটিও এবারের নির্বাচনের অন্যতম আলোচনার কেন্দ্র। সিপিএমের দীর্ঘদিনের বিধায়ক এবং সাবেক মন্ত্রী ২০১৪ সালে দলবিরোধী কাজের জন্য সিপিআইএম থেকে বহিষ্কৃত হন রেজ্জাক মোল্লা(৭০)। এরপর চলতি বছরের গোড়ার দিকে ভোটের ঠিক আগে পুরোনো দল ছেড়ে তৃণমূলে যোগ দিয়েই তৃণমূলের টিকিকে এই কেন্দ্র থেকে প্রার্থী হন। যদিও প্রার্থী হওয়ার পরই ওই কেন্দ্রে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব প্রবল আকার নেয়। ভোটের দিনও রেজ্জাক মোল্লা এবং তার বিরোধী বলে চিহ্নিত আরাবুল ইসলামের অনুগামীদের মধ্যে বিবাদ শুরু হয়। এখন দেখার, তৃণমূলের দলীয় কোন্দলের জেরে ওই কেন্দ্র জোট প্রার্থী রশিদ গাজী কিংবা বিজেপি’র অবনী কুমার মণ্ডল বাজিমাৎ করতে পারে কি না।
বিডি-প্রতিদিন/ ১৮ মে, ২০১৬/ আফরোজ