বাম-কংগ্রেস জোটকে পরাজিত করে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে তৃণমূল কংগ্রেস পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতায় এলেও একাধিক মন্ত্রীকে এবার তাদের পদ খোয়াতে হয়েছে। মন্ত্রীর পাশাপাশি বেশ কয়েকজন সেলিব্রিটি প্রার্থীকেও হারাতে হয়েছে তৃণমূলকে। অন্যদিকে তৃণমূলের প্রত্যাবর্তনের ঝড়ে বাম-কংগ্রেস জোট থেকে শুরু করে বিজেপি’র পোড়খাওয়া রাজনীতিবিদ থেকে শুরু করে সেলেব্রিটি প্রার্থীরাও হেরে বসে আছেন।
২০১৬’এর বিধানসভার নির্বাচনে রাজ্যের ২৯৪ আসনের অনেকগুলিতে এবার প্রতিটি রাজনৈতিক দলের তরফে একাধিক রাজনীতিবিদ, সেলিব্রিটি, বিদ্বজনেরা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। এরমধ্যে হেভিওয়েট প্রার্থী বলতে যার নাম প্রথমেই আসে তিনি হলেন রাজ্যটির মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়। দক্ষিণ কলকাতার যাদবপুর কেন্দ্রে নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী জোট প্রার্থী কংগ্রেসের দীপা দাসমুন্সিকে ২৫,৩০১ ভোটে হারিয়েছেন। যদিও জেতার মার্জিন গতবারের চেয়ে অনেক কম। তৃতীয় হয়েছেন বিজেপি’র হেভিওয়েট প্রার্থী ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম সদস্য নেতাজীর নাতি চন্দ্র কুমার বসু। গত ২০১১ সালের বিধানসভার উপনির্বাচনেও এই ভবানীপুর কেন্দ্র থেকে জিতেছিলেন মমতা। সেবার সিপিআইএম প্রার্থীকে অধ্যাপিকা নন্দিনী মুখোপাধ্যায়-কে ৫৪২১৩ ভোটে হারিয়ে জয়লাভ করেছিলেন তৃণমূল নেত্রী।
মমতার পাশাপাশি রাজ্যটির একাধিক মন্ত্রীও ফের জয়ের মুখ দেখেছেন। এর মধ্যে রয়েছেন রয়েছেন রাজ্যের নারী ও শিশুকল্যাণ মন্ত্রী তৃণমূলের শশী পাঁজা। তিনি শ্যামপুকুর কেন্দ্রে ১৩,১৬০ ভোটে বিজয়ী হয়েছেন। বেহালা পশ্চিম কেন্দ্রে জিতেছেন রাজ্যটির শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়, কলকাতা বন্দর কেন্দ্রে জয়লাভ করেছেন রাজ্যের নগরোন্নয়ন মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম, চৌরঙ্গী কেন্দ্রে তৃণমূল প্রার্থী নয়না বন্দোপাধ্যায় জিতেছেন ১৩,২২১ ভোটে, তিনি হারিয়েছেন কংগ্রেসের হেভিওয়েট প্রার্থী সৌমেন মিত্রকে। ৪৯,১০২ ভোটে হাবড়া কেন্দ্রে জয়ী হয়েছেন রাজ্যের খাদ্য ও সরবরাহ মন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক। খড়দা কেন্দ্রে সাবেক অর্থমন্ত্রী সিপিআইএম’এর অসীম দাসগুপ্তকে হারিয়ে ফের বিজয়ী হয়েছেন বর্তমান অর্থমন্ত্রী তৃণমূলের অমিত মিত্র। বালিগঞ্জ কেন্দ্রে ১৫২৪৫ আসনে জিতেছেন পঞ্চায়েত মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়। টালিগঞ্জে জিতেছেন যুব কল্যাণ মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস। ডোমজুড়ে জিতেছেন সেচ মন্ত্রী রাজীব ব্যানার্জি। দমদমে পর্যটন মন্ত্রী ব্রাত্য বসু, ডাবগ্রাম-ফুলবাড়ি কেন্দ্রে উত্তরবঙ্গ উন্নয়ণ মন্ত্রী গৌতম দেব, কসবায় ফায়ার সার্ভিস মন্ত্রী জাভেদ খান জয়ী হয়েছেন।
তবে মমতার জয়ের মধ্যেও কাঁটা হয়ে রইল তাঁরই মন্ত্রিসভার কয়েকজন সদস্যের পরাজয়। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হল রাজ্যটির সাবেক পরিবহন মন্ত্রী কারাগার বন্দী মদন মিত্র। ভবানীপুরের পরই এবারের ভোটে যে কেন্দ্রটির দিকে নজর ছিল সেটি হল কামারহাটি। পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক ইতিহাসে এই প্রথম কারাগারের মধ্যে থেকে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন কোন প্রার্থী। সারদা আর্থিক কেলেঙ্কারির সাথে যুক্ত থাকার অভিযোগে মন্ত্রিত্ব খুইয়ে গত দুই বছর ধরে কারাগার-হাসপাতালের চার দেওয়ালের মধ্যে কাটাতে হয়েছে। এবার সেই মদন’কেই প্রার্থী করেছিলেন মমতা। কারাগারে থেকে তাঁর নির্দেশেই মদনের হয়ে প্রচারণায় নেমেছিলেন স্ত্রী,পুত্র,পুত্রবধু। কিন্তু তবু জেতানো যায় নি মদনকে। ৪০৬৪ ভোটে হারতে হল প্রধান প্রতিপক্ষ সিপিআইএম’এর প্রার্থী মানস মুখার্জীর কাছে।
মদনের দেখানো পথে হাঁটতে হয়েছে রাজ্যটির বিদ্যুৎ মন্ত্রী মণীশ গুপ্ত, দক্ষিণ কলকাতার যাদবপুরে সিপিআইএম’এর সুজন চক্রবর্তী’র কাছে হেরেছেন মণীশ। ২০১১ সালে এই কেন্দ্রের বিধায়ক রাজ্যটির তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে হারিয়ে লাইমলাইটে চলে এসেছিলেন রাজ্যটি সাবেক প্রধান সচিব মণীশ গুপ্ত। জিতেই বিদ্যুৎ দফতরের মতো গুরুত্বপূর্ণ দফতরের মন্ত্রীত্ব পান তিনি। কিন্তু এবারে জোটের ধাক্কায় কুপোকাৎ হয়ে গেলেন মণীশ গুপ্ত।
জোটের ধাক্কায় পরাজিত হয়েছেন রাজ্যের আরও একাধিক মন্ত্রী। এরমধ্যে রয়েছেন আইন মন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য। ৬৩২৪ ভোটে সিপিআইএম’এর তন্ময় ভট্টাচার্যের কাছে হেরেছেন চন্দ্রিমা। পরাজিত হয়েছেন খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ মন্ত্রী কৃষেন্দু নারায়ন চৌধুরী, দফতর বিহীন মন্ত্রী সাবিত্রি মিত্র, সমবায় মন্ত্রী শঙ্কর চক্রবর্তী, বস্ত্রমন্ত্রী শ্যামাপ্রসাদ মুখ্যার্জি।
তৃণমূলের সেলিব্রিটি প্রার্থীদের মধ্যে বারাসত কেন্দ্র থেকে জয়ী হয়েছেন তৃণমূলের অভিনেতা প্রার্থী দীপক (চিরঞ্জিত) চক্রবর্তী। রায়দিঘি কেন্দ্র থেকে তৃণমূলের অভিনেত্রী প্রার্থী দেবশ্রী রায় টানা দ্বিতীয়বারের জন্য জয়ী হয়েছেন। চন্দননগর থেকে তৃণমূলের টিকিটে জয় পেয়েছেন গায়ক ইন্দ্রনীল সেন। তবে প্রথমবারে নির্বাচনী ময়দানে নেমেই পরাজয়ের স্বাদ পেলেন তৃণমূলের অভিনেতা প্রার্থী সোহম চক্রবর্তী। সিপিআইএম’এর সুজিত চক্রবর্তী’র কাছে ৬১৬ ভোটে হারেন সোহম। চাঁচোল থেকে হেরেছেন তৃণমূলের গায়ক প্রার্থী সৌমিত্র রায়।
অন্যদিকে পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার নারায়ণগড় কেন্দ্রে বাম-কংগ্রেস জোটের প্রধান নেতা, সিপিআইএম’এর পশিচমবঙ্গ রাজ্যটির সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র ১৩,৫০০ ভোটে পরাজিত হয়েছেন। তিনি হেরেছেন তৃণমূল প্রার্থী প্রদ্যুৎ ঘোষের কাছে। পাশাপাশি হাওড়া উত্তর কেন্দ্রে তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থী সাবেক ভারতীয় ক্রিকেটার লক্ষীরতন শুক্লার কাছে পরাজিত হয়েছেন বিজেপি প্রার্থী রূপা গাঙ্গুলী। বীরভূমের ময়ূরেশ্বর কেন্দ্রে পরাজিত হয়েছেন বিজেপি’র অভিনেত্রী প্রার্থী লকেট চট্টোপাধ্যায়। বসিরহাট দক্ষিণ কেন্দ্রে বিজেপির একমাত্র বিধায়ক সমীক ভট্টাচার্য হেরেছেন তৃণমূলের সেলিব্রিটি প্রার্থী ভারতীয় ফুটবলের সাবেক অধিনায়ক দীপেন্দু বিশ্বাসের কাছে। হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ে কলকাতার জোড়াসাঁকো কেন্দ্রের বর্তমান বিধায়ক তৃণমূলের স্মিতা বক্সির কাছে প্রায় ৬০০০ ভোটে পরাজিত হয়েছেন রাজ্যটির সাবেক বিজেপি সভাপতি রাহুল সিনহা। যদিও খড়গপুর সদর কেন্দ্রে ১০ বারের কংগ্রেস বিধায়ক জ্ঞান সিং সোহনপালকে হারিয়ে জয় পেয়েছেন বিজেপি’র পশ্চিমবঙ্গ শাখার সভাপতি দিলীপ ঘোষ।
বিডি-প্রতিদিন/ ১৯ মে, ২০১৬/ আফরোজ