ঘরের শত্রুর হামলা প্রতিবছরই সইতে হয় ভারতের দক্ষিণবঙ্গকে। এ বার সাগরপথে ধেয়ে আসছে বিদেশি 'শত্রু' তথা নিম্নচাপ! তার প্রভাবে ভারী থেকে অতি ভারী বৃষ্টি, এমনকী বানভাসি পরিস্থিতিরও আশঙ্কা দেখা দিয়েছে পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতা-সহ গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গে। ভারতীয় গণমাধ্যমে এ খবর প্রকাশিত হয়েছে। দেশটির আবহাওয়াবিদদের একাংশের আশঙ্কা, গতিপথের আচমকা পরিবর্তন না হলে আজ রোববার থেকেই হয়তো রাজ্যের দক্ষিণ অংশে শুরু হবে সেই নিম্নচাপের দাপট।
বঙ্গোপসাগরের অতি গভীর এক নিম্নচাপের জেরে ভারী বৃষ্টি হয়েছে কয়েক দিন আগেই। সাত মিনিটের মতো ঝড়ে বিপর্যস্ত হয়েছিল মহানগরের জনজীবন। প্রাণহানির ঘটনাও ঘটেছিল। এ বার যে গভীর নিম্নচাপটি দক্ষিণবঙ্গের দিকে ধেয়ে আসছে তার আঁতুড়ঘর আর বঙ্গোপসাগর নয়, সুদূর দক্ষিণ চীন সাগর!
পশ্চিমবঙ্গের আলিপুর আবহাওয়া অধিদফতর সূত্রের খবর, এই নিম্নচাপের জেরে গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গের পাশাপাশি অতি ভারী বৃষ্টির আশঙ্কা রয়েছে ঝাড়খণ্ডেও। ফলে দামোদর উপত্যকার নদীগুলিতে পানির স্তর বেড়ে বিপর্যয় হতে পারে। আবহাওয়া অধিদফতর আজ রবিবার থেকে ভারী বৃষ্টির পূর্বাভাস দিয়ে রেখেছে। যা নিয়ে শনিবার আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি। সেচ অধিদফতর সূত্রের খবর, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে ইতিমধ্যেই পরিস্থিতির মোকাবিলায় নেমেছে তারা। রাজ্যকে না জানিয়ে মাইথন ও পাঞ্চেত জলাধার থেকে পানি ছাড়তে নিষেধ করে চিঠি দেয়া হয়েছে দামোদর ভ্যালি কর্পোরেশন (ডিভিসি)-কে। এক কথায় দস্যু ঠেকাতে যুদ্ধকালীন তৎপরতা রাজ্যে।
আবহাওয়া অফিসের খবর, সম্প্রতি দক্ষিণ চীন সাগরে ‘দিয়ানমু’ নামে একটি ঘূর্ণিঝড় দানা বেঁধেছিল। প্রথমে ভিয়েতনামে তা আছড়ে পড়েছিল। তার পর দুর্বল হতে হতে হাজির হয়েছে মিয়ানমারে। সেখানে এসে সাধারণ নিম্নচাপে পরিণত হয়েছে ঘূর্ণিঝড়টি। কিন্তু উপগ্রহ-চিত্র বিশ্লেষণ করে আবহাওয়াবিদরা বলছেন, এ বার তার গতিপথ বাংলাদেশ উপকূল হয়ে দক্ষিণবঙ্গের দিকে এবং এই পথ চলার ফাঁকেই ফের শক্তি বাড়াতে পারে সে। সাধারণ নিম্নচাপ থেকে হয়ে উঠতে পারে গভীর নিম্নচাপ।
ঘূর্ণিঝড় সাধারণত স্থলভূমিতে আছড়ে পড়ার পর শক্তি খোয়াতে খোয়াতে বিলীন হয়ে যায়। তা হলে ভিয়েতনাম-মায়ানমারের মাটি ছোঁয়া এই নিম্নচাপ ভারতের পথে শক্তি বাড়াবে কী করে এমন প্রশ্নে ভারতের কেন্দ্রীয় আবহাওয়া বিজ্ঞান অধিদফতরের ডেপুটি ডিরেক্টর জেনারেল (পূর্বাঞ্চল) গোকুলচন্দ্র দেবনাথের ব্যাখ্যা, মায়ানমার থেকে দক্ষিণবঙ্গে আসার পথে তো সাগর পেরোতে হবে ওই নিম্নচাপকে! এই সময়েই সে সাগর থেকে জলীয় বাষ্প টেনে ফের শক্তি বাড়াবে। নিম্নচাপ বা ঘূর্ণিঝড়ের শক্তির উৎসই হল ওই জলীয় বাষ্প। তাই যত ক্ষণ তারা সাগরের উপরে থাকে, ততক্ষণ শক্তিও বাড়তে থাকে। স্থলভূমিতে ঢোকার পরে তারা বৃষ্টি ঝরাতে শুরু করে। কিন্তু নতুন শক্তির জোগান না থাকায় ক্রমশ দুর্বলও হয়ে পড়তে থাকে।
গোকুলচন্দ্র আরও বলেন, ‘দক্ষিণবঙ্গে ঢোকার পরে বৃষ্টি ঝরাতে ঝরাতে ঝাড়খণ্ডের মালভূমি এলাকায় পৌঁছবে গভীর নিম্নচাপটি। সেখানেও অতি ভারী বৃষ্টিপাত হতে পারে।’ আবহাওয়া অধিদফতরের খবর, এই সতর্কবার্তা ইতিমধ্যেই ডিভিসিকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। অতি ভারী বৃষ্টি হলে কী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে, তা অবশ্য ডিভিসি কর্তৃপক্ষ ঠিক করবেন।
হঠাৎ করে গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গে বিদেশি শত্রুর চোখ পড়ল কেন? এমনটা তো সাধারণত দেখা যায় না! আবহাওয়া বিজ্ঞানীদের ব্যাখ্যা, দক্ষিণ চীন সাগরের ঘূর্ণিঝড়টি দক্ষিণ মিয়ানমারে ঢুকেছিল বটে। কিন্তু তার অভিমুখ ছিল পশ্চিম দিকে। ফলে পশ্চিমে সরতে সরতে ক্রমশ স্থলভূমি পেরিয়ে সে বঙ্গোপসাগরে হাজির হয়েছে। এক বিজ্ঞানীর ব্যাখ্যা, বহিঃশত্রুকে ঘরে টেনে আনার পিছনে বর্ষাও অনেকটা দায়ী। বঙ্গোপসাগরে এই সময়ে বর্ষা সক্রিয়। দক্ষিণবঙ্গের উপর দিয়ে রয়েছে মৌসুমি অক্ষরেখা। ফলে সেই অক্ষরেখা সাগর থেকে বর্ষার হাওয়া টেনে আনছে। ওই অক্ষরেখা বরাবরই গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গে ঢুকে পড়তে পারে নিম্নচাপটি।
আবহাওয়াবিদদের কেউ কেউ অবশ্য বলছেন, আবহাওয়ার মতিগতি এখন বেজায় খামখেয়ালি হয়ে রয়েছে। ফলে যে কোন সময়েই পরিস্থিতির আচমকা বদল ঘটতে পারে। যার সর্বশেষ উদাহরণ গত বুধবার সন্ধ্যার ঝড়। অতি গভীর নিম্নচাপ যে আচমকা ঝড় হয়ে আছড়ে পড়তে পারে, তা আঁচ করতে পারেননি আবহাওয়া অফিসের বিজ্ঞানীরাও। সেই সূত্রেই কেউ কেউ আশঙ্কা করছেন, গভীর নিম্নচাপ আবার ঘূর্ণিঝড়ের চেহারা নেবে কিনা। এ ব্যাপারে আবহাওয়াবিদরা বলছেন, এ দিন রাত পর্যন্ত নিম্নচাপটির যে গতিপথ রয়েছে, তাতে ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হওয়ার সময় পাবে না সে। কিন্তু আচমকা মুখ ঘুরিয়ে যদি সে আরও দক্ষিণে নেমে যায়, সে ক্ষেত্রে আবার পরিস্থিতির বদল হতে পারে। আশঙ্কা বাড়তে পারে অন্ধ্র-ওড়িশা উপকূলের।
বিডি প্রতিদিন/২১ আগস্ট ২০১৬/হিমেল-১১