সিবিআই’এর হাতে তৃণমূলের প্রভাবশালী সাংসদ সুদীপ বন্দোপাধ্যায়ের আটকের প্রতিবাদে উত্তাল হয়ে পশ্চিমবঙ্গ। রাজ্য জুড়েই রাস্তা অবরোধ, রেল অবরোধ, ভাঙচুড়, বিজেপি নেতাকে মারধরের পাশাপাশি দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং, বিজেপি সভাপতি অমিত শাহের কুশপুত্তলিকা পোড়ানো-কোন কিছুই বাদ দেননি তৃণমূলের কর্মী-সমর্থকরা।
বেআইনি অর্থলগ্নিকারী সংস্থা ‘রোজভ্যালি’ থেকে বিভিন্ন সময়ে একাধিক সুবিধা নেওয়া এবং এই সংস্থার আর্থিক কেলেঙ্কারিতে যুক্ত থাকার অভিযোগে মঙ্গলবার দুপুরেই সুদীপকে আটক করে ভারতের তদন্তকারী সংস্থা। এই ঘটনার পরই মোদি ও কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ও তৃণমূলের প্রধান মমতা ব্যানার্জি। এই ঘটনায় বিজেপি’র বিরুদ্ধে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার অভিযোগ তুলে পাল্টা মোদি ও অমিত শাহকে আটকের দাবি জানান মমতা। পাশাপাশি রাজ্য জুড়ে লাগাতার আন্দোলন চালানোর ঘোষণী দেন দলনেত্রী। নেত্রীর এই বার্তা পেয়েই রাস্তায় নেমে পড়ে দলের বাধ্য নেতা-কর্মী-সমর্থকরা। ওইদিন বিকালেই কলকাতার সেন্ট্রাল এভিনিউতে অবস্থিত বিজেপির রাজ্য দফতরে হামলা চালানোর অভিযোগ ওঠে তৃণমূলের বিরুদ্ধে। দলের সিনিয়র নেতা সৌগত রায় নিজের মুখেই দলের ছেলেদের হামলার কথা স্বীকার করে নিয়েছিলেন। পরিস্থিতি সামাল দিতে শেষপর্যন্ত রাতে বিজেপি’র রাজ্য দফতরে কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন করা হয়। রাতেই হুগলির উত্তরপাড়ায় বিজেপি নেত্রী কৃষ্ণা ভট্টাচার্যের বাড়িতে তৃণমূলের একদল সমর্থক ভাঙচুর চালায় বলে অভিযোগ।
এরপর সকাল হতেই বুধবার ফের রাস্তায় নেমে পড়ে তৃণমূলের কর্মী-সমর্থকরা। রাজ্য জুড়েই বিক্ষোভ কর্মসূচীতে অংশ নেয় তৃণমূল কংগ্রেসের কর্মীরা। দফায় দফায় রাস্তা ও রেল অবরোধ করে। এদিন সকালে পশ্চিমবঙ্গ-ঝাড়খন্ড সীমানায় অবরোধ শুরু করে তৃণমূল। কুলটির বিধায়কের নেতৃত্বে অবরোধ চলে আসানসোলে ২ নম্বর জাতীয় সড়কের ওপর। অবরোধের ফলে দুই রাজ্যের সীমানায় আটকে পড়ে বহু গাড়ি। ভোগান্তি পোহাতে হয় সাধারণ মানুষকে। শেষ পর্যন্ত দুপুরে বিশাল পুলিশ বাহিনী গিয়ে অবরোধ তুলে দিলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়। এর পাশাপাশি পূর্ব ও পশ্চিম মেদিনীপুর, বর্ধমান, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা, উত্তর চব্বিশ পরগনা, আলিপুরদুয়ার, হুগলির একাধিক জায়গায় জাতীয় সড়কে বসে পড়ে বিক্ষোভ দেখানো হয়। এসময় মোদি’র বিরুদ্ধে স্লোগান দেওয়ার পাশাপাশি মোদি ও রাজনাথের কুশপুত্তলিকাও পোড়ানো হয়। কুচবিহার, কাঁকুরগাছি, নিউ আলিপুরসহ একাধিক জায়গায় ট্রেন অবরোধ করা হয়। ক্যানিং-এ বিজেপির দলীয় কার্যালয়ে ভাঙচুড় চালানোর অভিযোগ ওঠে তৃণমূলের বিরুদ্ধে। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে উত্তর কলকাতার কৈলাস ঘোষ স্ট্রিটে কেন্দ্রীয় ভারী শিল্প প্রতিমন্ত্রী গায়ক বাবুল সুপ্রিয়ের বাড়ির সামনে বিক্ষোভ দেখায় তৃণমূলের কর্মী-সমর্থকরা। রোজভ্যালির ঘটনায় বাবুল সুপ্রিয়কে কেন জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে এই প্রশ্ন তুলে বাবুলের বাড়ির সামনে বিক্ষোভ দেখানো হয় যদিও সেসময় বাড়িতে ছিলেন না বাবুল।
সুদীপের আটকের প্রতিবাদে বিক্ষোভ দেখানো হয় দিল্লিতেও। এদিন বিকেলে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের সামনে বিক্ষোভ দেখানোর চেষ্টা করায় তৃণমূল সাংসদদের আটক করা হয়। যদিও মোদির বাসভবনের সামনে যাওয়ার আগেই ৩৬ জন তৃণমূল সাংসদকে আটক করে পুলিশ। এসময় সাংসদের সঙ্গে পুলিশের প্রচণ্ড ধস্তাধস্তি শুরু হয়। মোদি ও কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে স্লোগান দিতে থাকেন তৃণমূলের সাংসদরা। যদিও পরে তাদের তুঘলক থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর থানার সামনে গিয়ে ধরনায় বসে তৃণমূলের সাংসদরা।
তৃণমূল সাংসদ সুখেন্দু শেখর রায় বলেন, ‘আমরা শান্তিপূর্ণ ভাবে বাসভবনের সামনে অবস্থান করছিলাম, কিন্তু অন্যায়ভাবে আমাদের আটক করা হয়। কেন্দ্রীয় সরকার যে প্রতিহিংসার রাজনীতি করছে তার বিরুদ্ধে আমাদের এই শান্তিপূর্ণ আন্দোলন চলবে’। ভুবনেশ্বরের খুরদায় সিবিআই আদালতের সামনেও এদিন বিক্ষোভ দেখায় তৃণমূল। এদিন দুপুরেই সিবিআই’এর বিশেষ আদালতে তোলা হয় আটক সুদীপ বন্দোপাধ্যায়কে। কিন্তু সুদীপকে আদালতে তোলার আগে থেকেই সিবিআই ও মোদি সরকারের বিরুদ্ধে দেওয়া স্লোগানে সরগরম হয়ে ওঠে আদালত চত্ত্বর। সব মিলিয়ে সকাল থেকে বিক্ষোভ-অবরোধে উত্তাল হয়ে উঠল দিল্লি ও পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য-রাজনীতি। দলের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিহিংসার রাজনীতি বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত এই আন্দোলন চলবে।
এর পাশাপাশি গতকাল সন্ধ্যায় বিজেপি রাজ্য দফতরে কেন্দ্রীয় বাহিনী নামানো নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন তৃণমূলের শীর্ষ মন্ত্রীরা। বুধবার দুপুরে রাজ্যপাল কেশরীনাথ ত্রিপাঠির সঙ্গে দেখা করে তৃণমূলের এক প্রতিনিধি দল জানায় যে রাজ্যের সঙ্গে কোনও আলোচনা না করেই কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকারের এই আচরণ যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো ধ্বংস করারই সামিল। শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে এই দলে ছিলেন সুব্রত মুখোপাধ্যায়, শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়, শোভন চট্টোপাধ্যায়, অরূপ বিশ্বাস, শশী পাঁজা, ফিরহাদ হাকিম, চন্দ্রনাথ সিংহ’এর মতো গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীরা।
এদিকে দলের সাংসদ সুদীপ বন্দোপাধ্যায়কে মিথ্যে মামলায় ফাঁসানোর অভিযোগে সিবিআই’এর বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের করল তৃণমূল কংগ্রেস। মঙ্গলবার রাতেই আনন্দপুর থানায় কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করা হয়। মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশেই থানায় অভিযোগ দায়ের করেন তৃণমূল নেত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য।
অন্যদিকে, বিজেপি দলীয় কার্যালয়ে তৃণমূলের হামলার চালানো এবং পশ্চিমবঙ্গে আইন-শৃঙ্খলার অবনতির অভিযোগ তুলে ওই রাজ্যটিতে রাষ্ট্রপতি শাসন জারির দাবি তুললেন বিজেপি নেতা সুব্রম্মনিয়াম স্বামী। বুধবার দলের এই প্রভাবশালী নেতা বলেন, আমি কেন্দ্রীয় সরকারকে বলবো পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার যদি আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে না পারে তবে কেন্দ্র যেন সংবিধানের ২৫৬ ধারা অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি শাসনের সুপারিশ করে।
পাশাপাশি কলকাতায় এক সংবাদ সম্মেলন থেকে কলকাতা পুলিশ কমিশনার রাজীব কুমারের বিরুদ্ধে বেআইনি অর্থলগ্নকারী সংস্থা ‘সারদা’র ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগ তুললেন বিজেপির কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষক কৈলাস বিজেয়বর্গীয়। তাঁর অভিযোগ রাজীব কুমার তৃণমূল নেতা-মন্ত্রীদের বাঁচাতে সারদার সমস্ত নথি পুড়িয়ে দিয়েছেন। পুলিশ কমিশনারের বিরুদ্ধে সিবিআই তদন্তেরও দাবি জানান বিজয়বর্গীয়।
বিডি-প্রতিদিন/০৪ ডিসেম্বর, ২০১৬/মাহবুব