ভারতের অসম রাজ্যে জাতীয় নাগরিকপঞ্জি (এনআরসি)-এর খসড়া প্রকাশের পর সারা ভারতজুড়ে যখন বিতর্ক তুঙ্গে ঠিক তখনই পশ্চিমবঙ্গেও এনআরসি চালু করার দাবি তুলেছে দেশটির ক্ষমতাসীন দল বিজেপি।
দলটির পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ একাধিকবার জানিয়েছেন রাজ্যে শাসন ক্ষমতায় এলে সেখানেও জাতীয় নাগরিকপঞ্জি চালু করা হবে এবং অবৈধ বাংলাদেশি নাগরিকদের দেশে ফেরত পাঠানো হবে। দিলীপ ঘোষের এই মন্তব্যের পর রাজ্যের সাধারণ মানুষের মধ্যে শঙ্কার মেঘ দেখা দিলেও বিরোধী রাজনৈতিক নেতারা দিলীপের এই মন্তব্যকে গুরুত্ব দিতে নারাজ।
দিলীপ ঘোষের পাশাপাশি বিজেপির জাতীয় সাধারণ সম্পাদক রাহুল সিনহা বা দলের রাজ্য পর্যবেক্ষক কৈলাশ বিজয়বর্গীয়’র মতো নেতারাও একাধিকবার বলছেন অবৈধ বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের বিতাড়িত করতে এরাজ্যেও এনআরসি চালু করা দরকার।
গত মাসেই কলকাতায় এক জনসমাবেশে উপস্থিত হয়ে বিজেপি’র সর্বভারতীয় সভাপতি অমিত শাহ’ও অনুপ্রবেশ ইস্যুতে রাজ্যটির মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জিকে তোপ দেগে বলেছিলেন দেশের স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে ভোট ব্যাঙ্কের স্বার্থেই মমতা অবৈধ অনুপ্রবেশকে প্রশয় দিচ্ছেন।
তবে পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতাসীন দল তৃণমূল কংগ্রেস থেকে শুরু করে জাতীয় কংগ্রেস, সিপিআইএম নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্টের শীর্ষ নেতারা এনআরসি ইস্যুতে বিজেপির সেই অবস্থানকে নস্যাৎ করে দিয়ে বলেছেন, ‘এই বিষয়টি ২০১৯ সালের নির্বাচনের আগে মানুষের মধ্যে মেরুকরণ তৈরি করা ছাড়া আর কিছুই নয়।’
বিজেপিকে ‘গরিব বিরোধী’ ও ‘বাংলা বিরোধী’ আখ্যায়িত করে সিপিআইএম বিধায়ক সুজন চক্রবর্তী বলেছেন ‘পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির ক্ষমতায় আসার কোন সম্ভাবনাই নেই। সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা তৈরি করে বিজেপি প্রায়ই রাজ্যের মানুষকে অসুবিধায় ফেলার চেষ্টা করে। তারা ফের এইধরনের প্রচেষ্টা চালাতে পারে কিন্তু রাজ্যের মানুষ তাতে সায় দেবে না।’
রাজ্যটির পুর ও নগরায়ন মন্ত্রী ও তৃণমূল কংগ্রেসের প্রভাবশালী নেতা ফিরহাদ হাকিমও অভিযোগ করেছেন যে এনআরসি’এর নামে অসমে সমাজের মধ্যে বিভেদের রাজনীতি করছে এবং সতর্ক করে দিয়েছেন যে পশ্চিমবঙ্গেও যদি গেরুয়া শিবির সুযোগ পায় তবে সেখানেও একই জিনিস করা হবে।
হাকিম জানান, ‘কোন মূল্যেই আমরা দেশের জাতীয় নিরাপত্তার সাথে আপস করবো না। কিন্তু অসমে এনআরসি'র নামে যেভাবে প্রকৃত ভারতীয়দেরকে হেনস্থা করা হচ্ছে, যেভাবে হিন্দু-মুসলিম এবং বাঙালি-অসমিয়াদের মধ্যে বিভেদের চেষ্টা করা হচ্ছে-সেটা নিন্দনীয়। আমাদের ভয় হচ্ছে যে এরাজ্যেও ঠিক সেভাবেই এনআরসি'র নামে ভিভাইড এন্ড রুল নীতির আশ্রয় না নেয়। দেশে যদি কোন রাষ্ট্র-বিরোধী শক্তি থেকে থাকে তবে কেন্দ্রীয় এজেন্সিই তাদেরকে বিতাড়িত করবে কিন্তু এনআরসি চালু করে এতগুলো মানুষকে অনিশ্চিয়তার মুখে ঠেলে দিতে আমরা রাজি নই।’
অন্যদিকে, পশ্চিমবঙ্গের মানুষকে বিভক্ত করার পরিকল্পনা বিজেপি কোনদিনই পূরণ করতে পারবে না বলে অভিমত দিয়েছেন জাতীয় কংগ্রেস বিধায়ক ও রাজ্য বিধানসভার বিরোধী দলনেতা আবদুল মান্নান। তার অভিমত এই প্রক্রিয়ার লক্ষ্যই হল একটি নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের মানুষকে দেশ থেকে বিতাড়িত করা।
তিনি জানান ‘অসমে এনআরসি'র নামে বিজেপি রাজনৈতিক কর্মসুচী নিয়েছে। তারা এখন ৪০ লাখ মানুষকে শরণার্থী পরিণতা করার চেষ্টা করছে। এমনকি এই মানুষগুলো যদি অ-ভারতীয় হিসাবে অভিযুক্ত হন তবে তাদের পরিচয়পত্র প্রমাণে বিজেপির কোন দায়বদ্ধতা নেই। এথেকেই স্পষ্ট যে এনআরসি’এর নামে তারা কি করতে চাইছে।’
এদিকে রাজনৈতিক বিশ্লেষক উদয়ন বন্দোপাধ্যায়ের অভিমত ২০১৯ সালে দেশটিতে সাধারণ নির্বাচনের আগে হিন্দু ভোটারদের মধ্যে রাজনৈতিক সুবিধা অর্জনের লক্ষ্যেই বিজেপি জাতীয় নাগরিক পঞ্জি ইস্যুটি নিয়ে সরব হয়েছে বলে মনে করছেন।
তিনি জানান ‘বিজেপি বারেবারেই বলছে যে সন্দেহজনক ভোটারদের বাংলাদেশে ফেরত পাঠিয়ে দেবে কারণ এর ফলে এই ধারনা জন্ম নেবে যে এরাজ্যে বেশিরভাগ অনুপ্রবেশকারীরাই বাঙালি মুসলিম। বিজেপি যদি এই ধারনাটি মানুষের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে তবে তারা এরাজ্যে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ করতে সক্ষম হবে।’
বিশিষ্ট এই রাজনৈতিক বিশ্লেষকের মতে ২০১৯ এর নির্বাচনে কেন্দ্রে যদি ফের বিজেপি ক্ষমতা আসে তবে পশ্চিমবঙ্গে এনআরসি চালু করার যে দাবি তা আরও জোরালো হবে। যদিও সেই কাজটি অতটা সম্ভব নয় বলেই তার ধারনা কারণ অসমের মতো রাজনৈতিক বা ভৌগলিক পরিস্থিতি পশ্চিমবঙ্গে নেই।
অসমের এনআরসি খসড়া তালিকা থেকে বাদ পড়া ৪০ লাখের বেশি নাগরিককে ফেরত দেওয়াটা কেন্দ্রের পক্ষে সহজ হবে না বলেও জানান তিনি। উদয়ন বন্দোপাধ্যায় বলেন, ‘সেই মানুষগুলো অনুপ্রবেশকারী হিসাবে প্রমাণিত হলেও তাদেরকে বিতাড়িত করা বা বিচ্ছিন্ন করে রাখাটা কেন্দ্রের পক্ষে খুবই কঠিন কাজ হবে। বড়জোর সেই মানুষগুলোর ভোটাধিকার খর্ব করা হতে পারে।’
বিডি-প্রতিদিন/আব্দুল্লাহ সিফাত তাফসীর