পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিম বর্ধমান জেলার ‘আসানসোল’ লোকসভা কেন্দ্র এবং দক্ষিণ কলকাতার ‘বালিগঞ্জ’ বিধানসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচনে রাজ্যটির ক্ষমতাসীন দল তৃণমূল কংগ্রেসের প্রার্থীরাই জয়ী হয়েছেন। অন্যদিকে বিহারে একটি মাত্র বিধানসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচনে জয়ী হয়েছে আরজেডি প্রার্থী। ছত্তিসগড় ও মহারাষ্ট্রে দুইটি বিধানসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচনেও কংগ্রেস প্রার্থীরা জয়ী হয়েছেন। পাঁচটির কোথাও খাতাই খুলতে পারল না বিজেপি বা তাদের জোটসঙ্গীরা।
পশ্চিমবঙ্গের ‘আসানসোল’ লোকসভা কেন্দ্রে রেকর্ড ভোটে জয়ী হয়েছে তৃণমূল প্রার্থী অভিনেতা শত্রুঘ্ন সিনহা। ৩ লাখ ৫৪৪ ভোটে তিনি হারিয়েছেন বিজেপি প্রার্থী ফ্যাশন ডিজাইনার অগ্নিমিত্রা পালকে। শত্রুঘ্ন সিনহা পেয়েছেন ৬ লাখ ৫২ হাজার ৫৮৬ ভোট, সেখানে অগ্নিমিত্রা পাল পান ৩ লাখ ৫২ হাজার ৪২টি ভোট। তৃতীয় স্থানে রয়েছেন বামফ্রন্টের প্রার্থী পার্থ মুখার্জি এবং চতুর্থ স্থানে রয়েছেন কংগ্রেস প্রার্থী প্রসেনজিৎ পুইতুন্ডি।
এই কেন্দ্রে মোট আটজন প্রার্থী নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। এই জয়ের ফলে বিজেপির হাত থেকে এই লোকসভা কেন্দ্রটি ছিনিয়ে নিল তৃণমূল এবং এই প্রথম এই লোকসভা কেন্দ্রটিতে জয় পেল তারা। কারণ এর আগে তৃণমূল কোনদিনই এই আসনটিতে জয় পায় নি। শুধু তাই নয়, আসানসোলের মাটিতে সর্বকালীন রেকর্ড ভোটেও জয়ী হল তৃণমূল প্রার্থী। এক্ষেত্রে ২০১৯ সালে বাবুলের জয়ের রেকর্ডকেও ছাপিয়ে গেছে।
২০১৪ ও ২০১৯ সালে পরপর দুইবার ‘আসানসোল’ লোকসভা কেন্দ্রের সাংসদ ছিলেন বাবুল সুপ্রিয়। এরপর মোদি মন্ত্রিসভায় মন্ত্রীও হন তিনি। যদিও ২০২১ সালের ৭ জুলাই মোদি মন্ত্রিসভার সম্প্রসারণে জায়গা না পাওয়ায় একরাশ অভিমান নিয়ে বিজেপির সংস্পর্শ ত্যাগ করেন এবং সাংসদ পদেও ইস্তফা দেন তিনি। পরবর্তীতে তিনি যোগ দেন তৃণমূল কংগ্রেসে। ফলে দীর্ঘ দিন আসানসোল কেন্দ্রটি সাংসদ বিহীন হয়ে পড়েছিল। স্বভাবতই এই কেন্দ্রে উপনির্বাচন জরুরি হয়ে পড়ে। আর ওই কেন্দ্রেই তৃণমূলের প্রার্থী করা হয় সাবেক কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ এবং জাহাজ মন্ত্রী, বিজেপি নেতা ও অভিনেতা ৭৬ বছর বয়সী শত্রুঘ্ন সিনহাকে।
জয়ের পরই শত্রুঘ্ন সিনহা জানান ‘আমরা সকলে মিলে চেষ্টা করেছি, দেশের অন্যতম বড় নেত্রী এবং আমাদের সকলের প্রিয় ও জনপ্রিয় মমতা ব্যানার্জির নাম আরও উজ্জ্বল করতে। এই জয়ের কৃতিত্ব দলের নেত্রী ও আসানসোলের সাধারণ মানুষের জন্য।’
অন্যদিকে ‘বালিগঞ্জ’ বিধানসভা কেন্দ্রটিতেও ভাল ব্যবধানে জয়ী হয়েছেন তৃণমূল প্রার্থী বাবুল সুপ্রিয়। ৫১ বছর বয়সী বাবুল ২০,০৫৬ ভোটে হারিয়েছেন তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী সিপিআইএম প্রার্থী সায়রা শাহ হালিমকে (যিনি সম্পর্কে বলিউড অভিনেতা নাশিরুদ্দিন শাহ’এর ভাতিজি)। বাবুলের প্রাপ্ত ভোট ৫০,৯৯৬ এবং সায়রা হালিমের প্রাপ্ত ভোট ৩০,৯৪০। এই কেন্দ্রে অনেক পিছনে থেকে তৃতীয় হয়েছে বিজেপির কেয়া ঘোষ চতুর্থ স্থানে সিপিআইএম প্রার্থী কামরুজ্জামান চৌধুরী। সেক্ষেত্রে এই কেন্দ্রে জামানত জব্দ হয়েছে বিজেপি ও কংগ্রেসের।
নিয়ম অনুযায়ী বিজেপি প্রার্থীকে ১৬ হাজারের কিছু বেশি ভোট পেতে হত। সেখানে কেয়া পেয়েছেন ১৩,১৭৪ ভোট। এবারের নির্বাচনে বালিগঞ্জ কেন্দ্রে মোট দশজন প্রার্থীর ভাগ্য নির্ধারণ হয়। এই কেন্দ্রে তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল সিপিআইএম প্রার্থীর দ্বিতীয় স্থানে উঠে আসা। ২০১৯’এর লোকসভা ও গতবছর বিধানসভার নির্বাচনে গোটা রাজ্যেই বামেদের ভোটের হার তলানিতে এসে ঠেকেছে।
কার্যত ভরাডুবি হয়েছে একটা সময় ৩৪ বছর ধরে শাসন করা বামেদের। যদিও সাম্প্রতিক পুরসভা নির্বাচন থেকেই রাজ্য রাজনীতিতে কিছুটা প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে বামেরা। এরপর বালিগঞ্জ বিধানসভার উপনির্বাচনেও সেই পরিস্থিতিতে বামেদের এই ফলাফল যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ। গত নভেম্বরে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে বালিগঞ্জ কেন্দ্রের জয়ী তৃণমূল বিধায়ক সুব্রত মুখার্জির মৃত্যুর কারণে এই কেন্দ্রটিতে উপনির্বাচন জরুরী হয়ে পড়ে। আর সেখানেই তৃণমূলের প্রার্থী করা হয় বাবুল গায়ক সুপ্রিয়কে।
গত মঙ্গলবার এই কেন্দ্রগুলিতে উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বেশ কিছু বিক্ষিপ্ত সহিংসতা ও অনিয়মের ঘটনাও ঘটে। শনিবার ছিল তার গণনা। সকাল ৮ টায় ত্রিস্তরীয় নিরাপত্তার মধ্যে দিয়ে গণনা শুরু হওয়ার পর থেকেই দুই কেন্দ্রেই ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীদের এগিয়ে যাওয়ার খবর পাওয়া যায় এবং বেলা যত গড়িয়েছে তৃণমূলের প্রার্থীরা ততই বিরোধীদের ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যায়। জয়ের খবর ছড়িয়ে পড়তেই ওই দুই কেন্দ্রে উৎসবে মেতে ওঠেন তৃণমূলের নেতা-কর্মী-সমর্থকরা।
দুই কেন্দ্রে জয়ের পরই টুইট বার্তায় উভয় কেন্দ্রের দলীয় প্রার্থীদের অভিনন্দন জানানোর পাশাপাশি সেখানকার বাসিন্দাদেরও ধন্যবাদ জানিয়েছেন তৃণমূল প্রধান মমতা ব্যানার্জি। তিনি লেখেন ‘তৃণমূল কংগ্রেসের প্রার্থীদের বিপুল ভোটে জেতানোর জন্য আমি আসানসোল সংসদীয় কেন্দ্র ও বালিগঞ্জ বিধানসভা কেন্দ্রের ভোটারদের ধন্যবাদ জানাই। আমরা মনে করি এই জয় ‘মা-মাটি-মানুষ’এর সংগঠনের সেরা নববর্ষের উপহার। আমাদের ওপর আস্থা রাখার জন্য ভোটারদের স্যালুট।’
অন্যদিকে জয়ের পরই বিজেপিকে নিশানা করে বাবুল জানান ‘আসানসোলে তৃণমূলের এই জয়ই কাব্যিক বিচার (পোয়েটিক জাস্টিস)। আজ মানুষই বিজেপির অহংকারকে ধ্বংস করে দিয়েছে। এই জয়ের পুরো কৃতিত্বটাই মমতা ব্যনার্জির প্রাপ্য।’ রাজ্য বিজেপি সভাপতি সুকান্ত মজুমদারের বক্তব্য তৃণমূলের কাছ থেকে সংখ্যালঘু ভোট সরে যাচ্ছে। ফলে বাম ও কংগ্রেসের ভোট বাড়বে।’
পশ্চিমবঙ্গের পাশাপাশি এদিন ভারতের আরও তিনটি বিধানসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচনের গণনা ছিল। কিন্তু তার কোনটিতেই সুবিধা করতে পারেনি কেন্দ্রের ক্ষমতাসীন দল বিজেপি। বিহারের ‘বোচাহান’ বিধানসভা কেন্দ্রে জয়ী হয়েছে রাষ্ট্রীয় জনতা দল (আরজেডি) প্রার্থী অমর কুমার পাসওয়ান। অন্যদিকে মহারাষ্ট্রের ‘নর্থ কোলাপুর’ বিধানসভা কেন্দ্রে জয়ী হয়েছে কংগ্রেস প্রার্থী জয়শ্রী যাদব এবং ছত্তিসগড়ের ‘খাইরাগড়’ বিধানসভা কেন্দ্রে জয়ী হয়েছে কংগ্রেস প্রার্থী যশোধা ভার্মা।
বিডি প্রতিদিন/আবু জাফর